আলমগীর পারভেজ: তিস্তার পানি নিয়ে চুক্তির বিষয়ে শেষ পর্যন্ত আর কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মাথায় কাজ করছে তিস্তা-মহানন্দাসহ বিভিন্ন নদীর মধ্যে ‘আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প’ গড়ে তোলার কাজ। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারও সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা তিস্তার পানির ব্যাপারে কোনো ছাড় দেবে না। ফলে বাংলাদেশকে এনিয়ে বিকল্প পথ খুঁজতে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে কেবল ভারত রাষ্ট্রকেই হিসাব করার এবং প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও লেনদেন করার কথা, কোনো রাজ্যকে নয়। কিন্তু তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বরাবরই বাংলাদেশকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দিকে ঠেলে দিতে দেখা যায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে ২০১৫ সালের বাংলাদেশ সফরকালে তিস্তার পানিবণ্টনকে ‘সিনসিয়ার কমিটমেন্ট’ বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কিছুই ঘটেনি। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে মীমাংসায় আসার সম্ভাবনা থাকলেও সেটি হয়নি। পরেও এনিয়ে ‘কথার কথা’ হয়েছে এবং তা এখনো অব্যাহত আছে। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জোরের সঙ্গে বলে চলেছেন, ‘তিস্তার যেখানে পানি নেই সেখান থেকে পানি দেয়া হবে না। জলপাইগুড়ি আর শিলিগুড়ির প্রয়োজন মিটিয়ে তারপর অন্য কথা।’ এই বক্তব্যের ফলে কেন্দ্রীয় সরকার আর হালে পানি পায়নি। বিষয়টি ধীরে ধীরে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়া এবং দ্বিপাক্ষিক কিছু ইস্যুতে ভারতের ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশে হতাশা তৈরি হয়েছে।
পানি যাচ্ছে কোথায়?
তিস্তার পানি শুধু কি পশ্চিমবঙ্গের প্রয়োজন মেটাচ্ছে? বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত বাংলাদেশকে তিস্তার পানি দেয়ার যতোটা তাগিদ অনুভব করে তার চেয়ে তার মাথায় কাজ করে ‘আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প’ বাস্তবায়নের বিষয়টি। এটি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের নয়। জানা গেছে, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের জন্য মানস-শঙ্কোশ-তিস্তা-গঙ্গা সংযোগ প্রকল্পের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে তিস্তার উল্লেখযোগ্য পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। পাশাপাশি যমুনা নদীর শাখা নদী মানস ও শঙ্কোশের পানি সরিয়ে নেয়ার মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের জন্য প্রয়োজনীয় পানি রেখে বাকিটা প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে। ফলে গজলডোবা বাঁধের তিস্তা পয়েন্টে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পানি থাকছে না। স্বাভাবিক সময়ে মোটামুটি ৮ থেকে ১২ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়। বাকি পানি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে ভারতের অন্য অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যেকারণে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখান থেকে বাংলাদেশকে পানি দিতে রাজি হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের স্বাদুপানির ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হবার কারণ আছে। তাঁরা বলছেন, মমতা বন্দোপাধ্যায় বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু হলে তিনি নিজেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে বুঝাপড়া করতে পারতেন এই শর্তে যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাংলাদেশকে কিছু পানি দিতে পারে। তবে তার জন্য আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প থেকে আরো বেশি পানি ছেড়ে গজলডোবায় পশ্চিমবঙ্গকে আরো বেশি পানি দিতে হবে- যাতে বাংলাদেশকে কিছু পানি দেয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশের ভাগ্যে তার কিছুই জোটেনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭ অনুযায়ী পানি ভাটির দেশের মানুষের বিশ্বস্বীকৃত আন্তর্জাতিক অধিকার। শুধু ভাটি অঞ্চলের মানুষেরই নয়, বরং বেঁচে থাকার জন্য নদীর নিজেরও রয়েছে প্রবাহ প্রাপ্তির অধিকার। নদী অববাহিকার উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ, বনাঞ্চলসহ সব জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পানি প্রবাহ চালু রাখা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পন্থা।
বিকল্প উপায়
উৎস থেকে পানিপ্রবাহ প্রাপ্তির দিক থেকে হতাশ হয়ে বাংলাদেশকে এখন বিকল্প চিন্তার দিকে অগ্রসর হতে হচ্ছে। তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে নদীটির বিস্তৃত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুজ্জীবনে একটি প্রকল্প হাতে নেয়ার পরিকল্পনার কথা জানা গেছে। সূত্রমতে, এমন একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা ইতোমধ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে। ‘তিস্তা নদী সমন্বিত মহাপরিকল্পনা’ শীর্ষক এই প্রকল্পে প্রাথমিকভাবে ৮ হাজার ২ শো কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো, বর্ষা মওসূমের বাড়তি পানি সংরক্ষণ করা এবং তা কৃষি, যোগাযোগ, মৎস চাষ, বনায়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে কাজে লাগানো। বলা হচ্ছে, শুধু তিস্তা নয়- এর শাখা-উপশাখা, উপনদী প্রভৃতি প্রতিটি পানির উৎসকে এর আওতায় আনা হবে। এগুলিতে ব্যাপক আকারে ড্রেজিং করা হবে এবং পানির আধার গড়ে তোলা হবে। এই কার্যক্রমই প্রাধান্য পাবে। এই সঙ্গে নদীর তীর সংরক্ষণ ও স্থায়ী বাঁধ তৈরি করা হবে। ১৭০ কিলোমিটারজুড়ে ভূমি উদ্ধার করা হবে। বর্ষার উপচে পড়া পানি যাতে বন্যার সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য পরিকল্পিতভাবে পানির প্রবাহ বগুড়া-জয়পুরহাট জেলা পর্যন্ত প্রলম্বিত করা হবে। সংরক্ষিত পানিতে মাছ চাষ ও নৌযোগাযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। জীববৈচিত্র্য ও ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার করা যাবে।
চীনের সহায়তায় প্রকল্প?
এই প্রকল্পটি চীনের ঋণ সহায়তায় পরিচালিত হবে বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে চীন তিস্তা নদীতে কি ধরণের প্রকল্প হতে পারে সে বিষয়ে প্রাথমিকভাবে ধারণা নেয়ার জন্য জরিপ পরিচালনা করেছে। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রে জানা যায়, চীনারা নিজেদের খরচে প্রকল্পের স্টাডি করছে। বর্তমানে পরিকল্পনাটি ইআরডি’র আওতায় রয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ২০১৯ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেইজিং সফরের সময় তিস্তা প্রকল্পের বিষয়ে চীনের সহযোগিতা কামনা করেন। সেই সফরে চীন আশ্বাস দেয় যে তারা তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়ন করবে। তবে এটি এখনো প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে বলেও জানা গেছে।