Header Border

ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল) ৩১.৯৬°সে

লকডাউনে মহাসংকটে নিম্ন আয়ের খেটেখাওয়া মানুষ

আলমগীর পারভেজ : লকডাউনে মহাসংকটে নিম্ন আয়ের খেটেখাওয়া মানুষ। মহামারি করোনা নিয়ন্ত্রণে ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করেছে সরকার। এরপরও প্রাদুর্ভাব থামাতে ৭ দিনের লকডাউনে যাচ্ছে দেশ। কিন্তু দেশের একটি বড় অংশ দিন আনে দিন খায়। তারা বলছেন, করোনা ভাইরাস বিপজ্জনক কিন্তু লকডাউনের কারণে জীবন-জীবিকার শঙ্কায় ভুগছেন সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ। এদিকে বাংলা নববর্ষ ও রোজার ঈদেই সবচেয়ে বেশি প্রাণচাঞ্চল্য থাকে দেশের অর্থনীতিতে। তবে আরেকবার লকডাউনের সিদ্ধান্তের ফলে গতবছরের পর এবারো ব্যবসায় লোকসানের শঙ্কা তৈরি হওয়ায় হতাশ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
গত বছর দেশে করোনা ভাইরাসের কারণে কয়েক দফার সাধারণ ছুটিতে ব্যাপক অর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। গত পহেলা বৈশাখ, ঈদে বেচা-বিক্রি কম হওয়াতে এবার আশার বীজ বুনেছিলেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ায় চলতি বছর প্রথমবারের মতো সপ্তাহব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার।
এর আগে গত শনিবার সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, আগামী ৫ এপ্রিল, সোমবার থেকে সাতদিনের জন্য লকডাউনের ঘোষণা আসতে পারে।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আজ রোববার জানানো হবে। এছাড়া লকডাউনের ব্যাপ্তি কী হবে, কী কী খোলা থাকবে আর কী কী বন্ধ থাকবে- সে বিষয়েও বিস্তারিত জানানো হবে। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এক ভিডিও বার্তায় লাকডাউন প্রসঙ্গে বলেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধের স্বার্থে সরকার দু-তিনদিনের মধ্যে সারা দেশে এক সপ্তাহের লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে লকডাউন চলাকালে শুধু জরুরি সেবা দেয় এমন প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। আর শিল্প-কলকারখানা খোলা থাকবে, যাতে শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিভিন্ন শিফটে কাজ করতে পারে।
সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে মো: জয়নুল নামের একজন বলেন, কিছুদিন আগে ঢাকায় এসে এখানে কাজ নিয়েছি। সামনে রমজান ও ঈদ। কিছু টাকা উপার্জন করে পরিবারের কাছে ফিরতে চেয়েছিলাম। লকডাউনের কারণে এখন কিছুই মাথায় আসছে না। সংসার চালাব কীভাবে?
কমলাপুরের ব্যবসায়ী রমজান বলেন, গতবছর লকডাউনের কারণে ১০ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। বছর পার না হতেই আবার লকডাউন। এবার পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তবে সরকারের উচিত রমজানের আগে লকডাউন শেষ করা। মগবাজার এলাকার রিকশা চালক আমির বলেন, লকডাউন দিলেতো আমাদের কিছুই করার নেই। তবে সরকারের উচিত আমাদের কথা ভেবে বিকল্প উপায়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা। নয়তো বাড়িতে ছেলে-মেয়ে না খেয়ে থাকবে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা মাসুদ আলম নামে একজন বলেন, লকডাউন দেয়ার দরকার ছিলো আরো ১৫ দিন আগে। করোনাতো এখন বাড়েনি এটা অনেক আগেই বেড়েছে। তখন দিলে পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে থাকত। সামনে রমজান ও ঈদ। করোনার পরিস্থিতি থেকেও ভয়াবহ পরিবার-পরিজনকে নিয়ে না খেয়ে থাকা।
এদিকে, লকডাউনের খবরে জীবিকা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেলের চালকরা। তারা বলছেন, দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রতিরোধে গত ৩১ মার্চ সরকার ১৮টি নতুন নির্দেশনা দেয়। নির্দেশনার পরপরই সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বি আরটিএ) অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা বন্ধ করে দেয় দুই সপ্তাহের জন্য। রাইড শেয়ারিং বন্ধ করে দিলেও খ্যাপ (যাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে) মারতেন তারা। এতে ট্রাফিক পুলিশ বাধা দিলেও কোনোমতে দিন চলে যাচ্ছিল তাদের। কিন্তু এখন লকডাউন ঘোষণার পর এ ব্যবস্থাও বন্ধ হওয়ার পথে। আগামী দিনগুলোতে কীভাবে সংসার চালাবেন, তা নিয়ে চিন্তিত তারা।
এদিকে বাংলা নববর্ষ ও রোজার ঈদেই সবচেয়ে বেশি প্রাণচাঞ্চল্য থাকে দেশের অর্থনীতিতে। তবে আরেকবার লকডাউনের সিদ্ধান্তের ফলে গতবছরের পর এবারো ব্যবসায় লোকসানের শঙ্কা তৈরি হওয়ায় হতাশ স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেছেন, শুধু পহেলা বৈশাখেই দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। রোজার ঈদে হয় এর কয়েকগুণ বেশি। স্থানীয় জামা-কাপড়, শাড়ি, লুঙ্গি, প্যান্ট, শার্টসহ স্থানীয় পোশাকের ৭০ শতাংশই বিক্রি হয় এ দুই উৎসবে। গত বছরের পর এবারের উৎসব থেকেও লাভের টাকা না উঠে আসলে পথে বসতে হবে কয়েক লাখ উদ্যোক্তাকে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সেক্রেটারি মনসুর আহমেদ জানান, পহেলা বৈশাখ ও রোজার ঈদে স্থানীয় বাজারে অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হয়। অধিকাংশ কারখানা বন্ধ থাকায় গত বছর উৎসব হয়নি। এবারো উৎসব না হলে ভবিষ্যত কি হবে আমরা বলতে পারছি না। গতবার লোকসানের পর এবার আবার নতুন করে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তবে সাম্প্রতিক আরোপিত লকডাউনের ফলে ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন তারা। লকডাউনের কারণে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান বন্ধ হলে সম্বল হারানোর শঙ্কায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এখন ব্যাংক ঋণ, শ্রমিকদের বেতন, কারখানার ভাড়া ও নিজের পরিবার নিয়ে  শঙ্কিত এই উদ্যোক্তারা।
নতুন লকডাউন ঘোষণার কারণে কেরাণীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীর বাবুবাজার, নারায়ণগঞ্জের গাউছিয়া, কিশোরগঞ্জের ভৈরব, ঢাকার ইসলামপুর, টাঙ্গাইল-সিরাজগঞ্জের তাঁত পল্লীসহ স্থানীয় পোশাক উৎপাদন ও বিপণণের কেন্দ্রগুলো বিপাকে পড়েছে। মূলধন হারিয়ে টিকে থাকায় শঙ্কায় সীমিত পরিসরে হলেও পোশাকের দোকান খোলার দাবি করছেন তারা।
গত বছরের মতো এবারও পহেলা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতরের উৎসব না থাকলে ফ্যাশন হাউসগুলোর ৬-৭ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির মধ্যে পড়বে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ফ্যাশন ডিজাইনার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও অঞ্জনস শোরুমের মালিক শাহীন আহমেদ। তিনি জানান, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এ বছর আমাদের লক্ষ্যমাত্রা তিন হাজার কোটি টাকা। সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। ঈদে আরো বড় প্রস্তুতির চিন্তা সবার। এই খাতে আমাদের ফ্যাক্টরি, শোরুম, মাল সাপ্লাইয়ার, তাঁত শ্রমিক, সেলাইকর্মীসহ ৫ লাখের বেশি লোক জড়িত। এদের ৮০ শতাংশই নারী। অন্যদিকে দেশীয় ফ্যাশন হাউস সাদাকালোর চেয়ারম্যান মো. আজহারুল হক আজাদ জানান, পহেলা বৈশাখে  বেঁচাকেনা বন্ধ থাকলে আমাদের অন্তত ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হবে।
তবে গত বছরের লোকসান কাটাতে এবার পহেলা বৈশাখ ও ঈদকে কেন্দ্র করে বছরজুড়েই প্রস্তুতি নিয়েছে স্থানীয় ফ্যাশনগুলো। দেশীদশ, ইয়েলো, সেইলর, জেন্টলপার্ক, ইনফিনিটিসহ দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলোর বিক্রির ৫০ শতাংশের বেশি হয় এই দুই উৎসবে। লকডাউন ঘোষণা হওয়ায় বাস্তবতা মেনে নিয়ে অনলাইনে বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছে ব্র্যান্ডগুলো।
জানা গেছে, পহেলা বৈশাখকে ঘিরে প্রতিবছর অর্থনীতিতে যে প্রাণচাঞ্চল্য হয় তার বড় অংশই এসএমই খাতের। গত বছরের মতোই এবারো প্রস্তুতি নিয়ে সংকটে পড়েছেন লাখ লাখ ছোট পুঁজির উদ্যোক্তা। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন জানান, নববর্ষ উপলক্ষে পোশাক ছাড়াও আসবাবপত্র ফুল, খেলনাসহ বিপুল পরিমাণ কার্ড ছাপানোর কাজ করেন ছোট উদ্যোক্তারা । এ বছর কার্ড ছাপানো হয়নি। ফলে শ্রমিকরা অলস সময় পার করছেন। বেকার হয়ে পড়েছেন। বৈশাখের এই সময়ে প্রচুর ইলিশের বাণিজ্য হয়। সেটিও বন্ধ হয়ে গেল। ঢাকা মহানগরীতে আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ৩৭টি বাজার আছে। করোনা ভাইরাসের কারণে নববর্ষের উদযাপন বাতিল হওয়ায় আমাদের আড়াই লাখ শ্রমিক জীবন-জীবিকার হুমকিতে পড়লেন।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছর পহেলা বৈশাখকে ঘিরে বাংলা একাডেমিতে ১০ দিনের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সারাদেশের শিল্প নগরীতেও বসে একই ধরনের মেলা। এসব মেলায় কয়েক লাখ উদ্যোক্তা সারা বছরের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করেন। গত বছরের মতো এবারও মেলা বাতিল হওয়ায় বড় ধরণের ক্ষতির মধ্যে পড়বেন বুটিক থেকে শুরু করে জামদানি শাড়ি, ফার্নিচার, জুতাসহ স্থানীয় ফ্যাশন সামগ্রী বিক্রি করা কয়েক লাখ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা।
তবে আকস্মিক লকডাউনের ঘোষণায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবার সব ব্যবসায়ীর চোখ ছিল সামনের পহেলা বৈশাখ আর ঈদের দিকে। এজন্য অনেকেই ব্যাংক কিংবা অন্যভাবে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন। এমন অবস্থায় লকডাউনের এমন সিদ্ধান্তে তারা হতবাক। তারা কী করবেন বুঝতে পারছেন না।
এ প্রসঙ্গে পাটজাত পণ্যের ব্র্যান্ডশপ তুলিকার স্বত্বাধিকারী চৌধুরী জানান, লকডাউনের খুব খারাপ প্রভাব পড়বে। তবে লকডাউনের ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। আমাদের তো ফ্যাক্টরি খোলা রাখতে হবে। সামনে ঈদ আসছে। এভাবে যদি লকডাউন হয়, তাহলে আমাদের ওয়ার্কার আসবে কোথা থেকে। কীভাবে কী করবো, বুঝতে পারছি না আসলে। তিনি বলেন, লকডাউন আমরা অ্যাপ্রিশিয়েট করি না। এই লকডাউন কতদিন চলবে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, এই ঈদটা যদি আমাদের মাটি হয়, তাহলে ছোট উদ্যোক্তারা আর দাঁড়াতে পারবেন না।

আপনার মতামত লিখুন :

আরও পড়ুন

নতুন শিক্ষাক্রমে এসএসসি পরীক্ষা হবে ৫ ঘণ্টার
থাইল্যান্ড গেলেন প্রধানমন্ত্রী
তাপদাহে হিট অ্যালার্টের মেয়াদ আরও বাড়াল আবহাওয়া অফিস
বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বাড়াল সরকার
উপজেলায় এমপি মন্ত্রীর সন্তান-স্বজনরা প্রার্থী হলে ব্যবস্থা
সব বিরোধী দলের উপজেলা নির্বাচন বর্জন

আরও খবর