সময় সংবাদ রিপোর্ট:রেকর্ডসংখ্যক মনোনয়নপ্রত্যাশী এবার আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচনী লড়াইয়ের ময়দানে নামতে চেয়েছেন। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে মোট ৪০২৩টি। এত বিপুলসংখ্যক মনোনয়নপ্রত্যাশীর মধ্য থেকে প্রার্থী বাছাই করা চাট্টিখানি কথা নয়।
তদুপরি রয়েছে ১৪-দলীয় জোট শরিক এবং মহাজোট শরিক জাতীয় পার্টির জন্য আসন ছাড়। সব মিলিয়ে ৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করা এক মহাযজ্ঞই বটে। সেই মহাযজ্ঞে নেমেছেন খোদ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত ধারার ‘ফেসভ্যালু’ নয়, আমলনামাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন তিনি।
শুধু আওয়ামী লীগের প্রার্থীই নয়, জোট ও মহাজোট শরিকের প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তিনি এ নীতিতেই এগোচ্ছেন। ছয় মাস পর পর করা আসনভিত্তিক সারাদেশে করা মোট ৬টি জরিপের ফল এখন আওয়ামী লীগ সভাপতির হাতে। প্রতিটি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে তুলনামূলক জনপ্রিয়তা এবং জরিপে প্রাপ্ত ফল নিয়ে এখন তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন। মনোনয়ন পেতে হলে তার কঠিন সেই নিক্তিতে উত্তীর্ণ হতে হবে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান মন্ত্রিসভার একাধিক জ্যেষ্ঠ সদস্য এবং দলের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন নেতাও বাদ পড়তে যাচ্ছেন সেই নিক্তিতে উত্তীর্ণ হতে পারছেন না বলে। দলটির মনোনয়ন বোর্ডের একাধিক সদস্য এ তথ্য জানিয়েছেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জোটের আসন সমঝোতার জন্য আজ সোমবার সন্ধ্যায় জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনায় বসবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামীকাল মঙ্গলবার ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন তিনি। সব মিলিয়ে মহাজোটের ৫০টির মতো আসনে এবার প্রার্থী পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। দলটির মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের নির্বাচন অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। তার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে আসন্ন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হোক, এটাই তার আন্তরিক প্রত্যাশা। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে অন্য দলের প্রার্থীকে হারিয়ে বিজয়ী হওয়ার মতো প্রার্থীদের হাতেই একাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক তুলে দিচ্ছেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, শুধু নিজ দল আওয়ামী লীগের মনোনয়নই নয়, মহাজোট নেত্রী হিসেবে মহাজোটের প্রার্থীও চূড়ান্ত করছেন শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষস্থানীয় এক নেতা এ বিষয়ে সময় সংবাদকে বলেন, নেত্রী এবার বিভিন্ন আসনে দলীয় মনোনয়নের পাশাপাশি জোটের মনোনয়নও চূড়ান্ত করছেন। প্রার্থী তালিকা করার সময় তিনি দেখছেন, একটি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পাশাপাশি অন্যান্য দলের প্রার্থীদের কার অবস্থান কেমন? যেসব এলাকায় আওয়ামী লীগের চেয়ে মহাজোটের প্রার্থীদের অবস্থান ভালো, সেসব এলাকায় দলের প্রার্থীদের বদলে জোটের প্রার্থীকে চূড়ান্ত করছেন তিনি। আবার যেসব এলাকায় জোটের এমপিদের চেয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের অবস্থান ভালো, সেসব এলাকায় জোটের প্রার্থীকে বসিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চূড়ান্ত করছেন তিনি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ঢাকা থেকে টানা দুবার নির্বাচিত আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা দলীয় মনোনয়ন পাচ্ছেন না এবার। তিনি এর আগে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনেরও শীর্ষ নেতা ছিলেন। মূলত আওয়ামী লীগের দুপক্ষের মধ্যকার চরম বিভেদের কারণেই দলের ওই কেন্দ্রীয় নেতা এবার মনোনয়ন পাচ্ছেন না। সম্প্রতি তার আসনভুক্ত এলাকায় দলীয় কোন্দলে দুটি খুনের ঘটনাও ঘটেছে।ওই আসনে মনোনয় নড়াইল-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রাহক জাতীয় ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা। এ ছাড়া তিন মেয়াদে কেন্দ্রীয় কমিটিতে একই পদে থাকা দলের দুই সাংগঠনিক সম্পাদক আছেন, যারা টানা দুই মেয়াদের সাংসদ, তারাও মনোনয়নবঞ্চিত হবেন। তাদের দুজনের আসনেই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্য দুই নেতা এই প্রথম দলীয় মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন। নিজ এলাকা থেকে মনোনয়নবঞ্চিত দুই সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যে একজনকে অবশ্য ঢাকার একটি আসন থেকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ঢাকা-১৫ আসনে তার নাম আলোচনায় রয়েছে।
আওয়ামী লীগের শুধু নয়, মহাজোটের অনেক প্রভাবশালী নেতাও বাদ পড়তে যাচ্ছেন। চট্টগ্রাম নগরীর একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন থেকে জোটের মনোনয়ন হারাতে যাচ্ছেন জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী এক নেতা।ওই আসনে মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের একজন। সকল নির্বাচনী জরিপে ওই সাংগঠনিক সম্পাদক জাতীয় পার্টির প্রার্থীর চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে।
চাঁদপুরের প্রভাবশালী এক নেতা ও মন্ত্রিসভার সাবেক সদস্য, যিনি এর আগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন, আমলা থেকে রাজনীতিতে নাম লেখানো সেই নেতাও এবার দলীয় মনোনয়ন থেকে বাদ পড়তে যাচ্ছেন। মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্য থেকে সিলেটের প্রভাবশালী এক নেতা এবার মনোনয়ন পাচ্ছেন না। বেফাঁস কথাবার্তার জন্য গণমাধ্যমে তিনি প্রায়ই সংবাদের খোরাক হয়েছেন।
উত্তরবঙ্গের দুজন মন্ত্রীর নাম রয়েছে মনোনয়নবঞ্চিতদের তালিকায়।এদের মধ্যে একজন বেশ বয়স্ক। আরেকজনের ব্যাপক সামাজিক পরিচিতি রয়েছে ব্যক্তিগুণেই। তিনি খুবই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মনোনয়ন ধরে রাখতে। যমুনার ওপারের একটি জেলার জ্যেষ্ঠ এক মন্ত্রী, যিনি দশম সংসদের পর থেকে এ পর্যন্ত মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, তিনিও মনোনয়ন পাচ্ছেন না এবার। তার আসনে মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন সাবেক এক সেনা কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী একজন মন্ত্রী যিনি তুখোড় বক্তা হিসেবেও পরিচিত, তার আসনের পরিবর্তন হচ্ছে। নিজ জেলায় তার একজন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাজন মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার বিষয়ে তিনি ইতোমধ্যেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন দলের ভেতরে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য লে. কর্নেল (অব) মুহম্মদ ফারুক খান বলেন, প্রত্যেক জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের কিছু কিছু প্রার্থী পরিবর্তন হয়। এবারও হবে। এটাই দলের স্বাভাবিক নিয়ম।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ বিষয়ে বলেছেন, সব প্রক্রিয়া শেষ করে আগামী ৪-৫ দিনের মধ্যে জোটগতভাবে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা যাবে। তিনি বলেন, আমাদের দলীয় প্রার্থী-তালিকার কাজ বলা যেতে পারে ‘অলমোস্ট ক্লোজড’। এখন জোটের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করব। এর পর যে সমীকরণ দাঁড়াবে, তা ৪-৫ দিনের মধ্যে ঘোষণা করা হবে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা সময় সংবাদকে জানান, গতকালই (রবিবার) আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী তালিকা প্রেস রিলিজের মাধ্যমে ঘোষণার কথা ছিল। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত হয়, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে জোট ও দলের প্রার্থী যূথবদ্ধভাবে ঘোষণা করা হবে। এর আগে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসবেন মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনা। এর পরও আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের দুই নেতা সময় সংবাদকে বলেছেন, আজকালের মধ্যে (সোম-মঙ্গলবার) দলীয় প্রার্থী ঘোষণা হতেও পারে।
-জয়নুল আবেদীন,সময় সংবাদ ।