ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানুষকে প্রকৃত মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা অর্জন করার কথা বলে ইসলাম। পারস্পরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ মুসলমানদের গুণ ও বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে কুরআন-হাদিসে। ইসলামে সব ধরনের বিভেদ ও বিভক্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং ঐক্যবদ্ধ জীবনযাপন আবশ্যক করা হয়েছে।
বর্ণিত হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে (ইসলাম) আঁকড়ে ধরো ,ঐক্যবদ্ধ হও, এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (সুরা আলে ইমরান : ১০৩)। অথচ আমাদের মুসলিম সমাজে বিভেদ ও বিভক্তি চরম পর্যায় পৌঁছেছে। এর অন্যতম কারণ পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতা। কারণ হিংসুক ও পরশ্রীকাতর ব্যক্তিরা অন্যের সফলতা, যোগ্যতা ও মর্যাদা সহ্য করতে না পেরে সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের চরিত্র হননে উঠেপড়ে লাগে। তারা নিজেদের অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ ভাবে আর অন্যদের নগণ্য মনে করে। তাদের এই মানসিকতা সামাজিক অশান্তি ও অস্থিরতা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। তাদের মানসিকতার বিরুদ্ধে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন, সে জন্য কি তারা তাদের হিংসা করে?’ (সুরা নিসা : ৫৪)
প্রকৃত মুসলমানের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ’ (বুখারি : ১০)। তিনি আরও বলেছেন, ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর না জুলুম করতে পারে, না তাকে অসহায় অবস্থায় পরিত্যাগ করতে পারে আর না তাকে হেয়প্রতিপন্ন করতে পারে। তিনি নিজের বুকের দিকে ইশারা করে বলেন, তাকওয়া এখানে, তাকওয়া এখানে, তাকওয়া এখানে। কেউ নিকৃষ্ট হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে সে তার মুসলিম ভাইকে তুচ্ছজ্ঞান করবে। প্রত্যেক মুসলমানের জীবন, ধনসম্পদ ও মানসম্মান প্রত্যেকের সম্মানের বস্তু। এর ওপর হস্তক্ষেপ করা হারাম’ (মুসলিম : ৬৭০৬)। তাই একজন মানুষ কোনো মানুষের কষ্টের কারণ হতে পারে না। হাদিসে এসেছে ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর বিশ্বাস রাখে সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।’ (বুখারি : ৫৬৭২)
ইসলাম মানবিকতা, উদারতা ও মহানুভবতার ধর্ম। পরমতসহিষ্ণুতা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। অপরের প্রতি ঘৃণা বা অবজ্ঞা প্রদর্শন ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। প্রতিটি মানুষ সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম, নারী হোক কিংবা পুরুষ, মানুষ হিসেবে আল্লাহ তায়ালা তাকে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি মানবজাতিকে সম্মানিত করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদের উত্তম জীবন উপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি আমার সৃষ্টিজগতের অনেকের ওপর’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৭০)।
বিদায় হজের এই ঐতিহাসিক ভাষণে মানুষের মর্যাদাকে সমুন্নত করে ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের পরস্পরের জীবন, ধন-মাল ও সম্মান পরস্পরের জন্য সম্মানার্হ, যেমন তোমাদের এ দিনটি সম্মানার্হ, এ মাসটি সম্মানার্হ এবং এ শহর সম্মানার্হ’ (বুখারি : ৬৭)। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করতেন। একবার আমাদের মহানবী (সা.)-এর পাশ দিয়ে একটি লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি ওই লাশের সম্মানে দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁকে বলা হলো, লাশটি তো একজন ইহুদির।’
মহানবী (সা.) বললেন, ‘সে কি মানুষ নয়?’ (মুসলিম : ৯৬১)।
মানুষের মর্যাদাহানি, কুৎসা রটনা, ঠাট্টা-বিদ্রূপ করাকেও ইসলাম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমাদের কোনো সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়কে হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে যেন বিদ্রূপ না করে’ (সুরা হুজুরাত : ১১)।
আর কোনো মানুষের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা ইসলামে অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। আল্লাহ তায়ালার ইরশাদ-‘ধ্বংস এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য, যে পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দা করে’ (সুরা হুমাজা : ১)। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! কোনো সম্প্রদায় যেন অপর কোনো সম্প্রদায়কে বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর কোনো নারীও যেন অন্য নারীকে বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপকারীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আর তোমরা একে অপরের নিন্দা করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গুনাহ। ঈমানের পর মন্দ নাম কতই না নিকৃষ্ট। যারা এমন কাজ থেকে তওবা না করে তারাই জালিম।’ (সুরা হুজুরাত : ১১)
কাউকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও হেয়প্রতিপন্ন করা মুমিনের কাজ নয়। বরং তা সংকীর্ণ মানসিকতার লক্ষণ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা একে অন্যের দোষ অনুসন্ধান করো না। পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ করো না ও পরস্পর শত্রুতা করো না। বরং হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও’ (বুখারি : ৪৮৪৯)।
মানুষের প্রতি কু-ধারণা ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত নিন্দনীয়। কোনো দলিল-প্রমাণ ছাড়া অনর্থক কারও সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করাকে ইসলাম কোনোভাবেই সমর্থন করে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা সব ধরনের অনুমান থেকে বেঁচে থাকো। কেননা কিছু কিছু অনুমান গুনাহের কারণ। আর তোমরা একজন অন্যজনের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না। আর তোমরা পারস্পরিক গিবত থেকেও বিরত থাকো’ (সুরা হুজুরাত : ১২)।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কোনো মুসলমানের নিন্দা করো না, তাদের ছিদ্র অন্বেষণ করো না। কেননা যে ব্যক্তি অপরের দোষ খোঁজে আল্লাহ তার দোষ খোঁজেন। আর আল্লাহ যার দোষ খোঁজেন, তাকে তার নিজস্ব আবাসস্থলেই অপদস্থ করেন।’ (আবু দাউদ : ৪৮৮০)
তা ছাড়া ঘৃণার পরিবর্তে সৌহার্দ্য ও ভালোবাসার প্রসার ঘটানো ইসলামের মহান শিক্ষা। রাসুল (সা.) মুমিনদের ভালোবাসা ঈমানের মাপকাঠি সাব্যস্ত করে বলেছেন, ‘ঈমান ছাড়া তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, পরস্পরকে ভালোবাসা ছাড়া তোমরা মুমিন হতে পারবে না। আমি কি তোমাদের এমন বিষয়ের কথা বলে দেব না, যাতে তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হবে? তোমরা পরস্পরকে সালাম দেবে’ (মুসলিম : ২০৩)।
আল্লাহ সবাইকে বোঝার ও আমল করার তওফিক দিন।
লেখক-মোঃ জয়নুল আবেদীন,সাংবাদিক ও কলামিষ্ট