আলমগীর পারভেজ: গত তিন দশকে উৎপাদন ২৫ গুণ বাড়লেও সেভাবে দাম কমেনি মাছের। মাছে-ভাতে বাঙ্গালী’ প্রবাদটি সর্বজনস্বীকৃত হলেও এখন সেই মাছই যেন সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে।এখনো অনেকে মাসে দুই-একদিন মাছ খেতে পান না। নিষেধাজ্ঞার পর চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনাসহ সারা দেশের সব নদীতে চলছে ইলিশ ধরার উৎসব। নদীতে জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে ইলিশ। বিভিন্ন বাজারে ইলিশ মাছ দেখা গেলেও দাম কিন্তু সেভাবে কমছে না। বরং গেল বছরের তুলনায় ইলিশ মাছের দাম যেন বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিন্ডিকেট করেই ইলিশসহ অন্যান্য মাছের দাম নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
সূত্র মতে, মাছ বাঙালি জাতির সংস্কৃতি ও কৃষ্টির অংশ। দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও রপ্তানি আয়ে মৎস্য খাতের অবদান অনস্বীকার্য। মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৪.৭৩ শতাংশ মৎস্য উপখাতের অবদান এবং কৃষিজ জিডিপিতে ২৫.৭২ শতাংশ। দেশের প্রায় ১৪ লাখ নারীসহ মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশেরও বেশি অর্থাৎ প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য উপখাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময়। বিগত ২০০৮ সালে মৎস্য উপখাতে গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ শতাংশ। বর্তমানে প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৪ দশমিক ৪ শতাংশ আসে মৎস্য উপখাত থেকে। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ২০১৫ সালের মধ্যে অর্জিতব্য নির্দিষ্ট ৮টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ সরকার প্রণীত দারিদ্র্যবিমোচন কৌশলপত্রে মৎস্য উপখাতকে দারিদ্র্যবিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দরিদ্রবান্ধব অর্থনৈতিক উন্নয়নে অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পানিসম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য পুকুর-দিঘি, ডোবা-নালা, নদ-নদী, খাল-বিল ও বাঁওড়। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলজুড়ে রয়েছে বিশাল হাওড় এলাকা, যা আমাদের মৎস্য সম্পদের সূতিকাগার হিসাবে পরিচিত। বাংলাদেশে ৩ দশমিক ৫ লাখ হেক্টর আয়তনের প্রায় ১৩ লাখ পুকুর-দিঘি রয়েছে। দেশের ২৪ হাজার কিমি. দীর্ঘ নদ-নদীর আয়তন প্রায় ১০ দশমিক ৩২ লাখ হেক্টর। এ ছাড়া রয়েছে ১ দশমিক ১৪ লাখ হেক্টর জলায়তনের প্রায় ১১ হাজার বিল, ৫ হাজার ৪৮৮ হেক্টর আয়তনের বাঁওড়, ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর কাপ্তাই হ্রদ, প্রায় ২.০০ লাখ হেক্টর সুন্দরবন খাড়ি অঞ্চল এবং ২৮ দশমিক ৩০ লাখ হেক্টরের বিশাল প্লাবনভূমি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত তিন দশকে বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৫ গুণ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা মাছ নিয়ে তাদের ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২০’ শিরোনামে প্রকাশিত বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলেছে, স্বাদু পানির উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। দেশে উৎপাদিত মাছের ৭৫ শতাংশ এখন বাজারজাত করছেন মৎস্যচাষিরা। এ ছাড়া কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবন করে ফিরিয়ে আনা হয়েছে ২৪ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় দেশি মাছ। সব মিলিয়ে স্বাধীনতার ৫০ বছরে মাছ উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টি করছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, গত পাঁচ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে মাছের উৎপাদন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে মাছ উৎপাদন হয় ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪১ লাখ ৩৪ হাজার টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪২ লাখ ৭৭ হাজার টন এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৩ লাখ ৮১ হাজার টন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের মৎস্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা গিয়ে দাঁড়াবে ৪৫ দশমিক ৫২ লাখ টন।
জানা গেছে, বাংলাদেশ এখন মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমান বিশ্বে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তাছাড়া গবেষণার মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া অনেক প্রজাতির মাছ এখন চাষ করা হচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া মাছ চাষ হচ্ছে সরকারি-বেসরকারিভাবেও। এ ছাড়া মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষায় সরকার ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ এখন ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে রোল মডেল। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে ২০০৮-০৯ সালে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯২ হাজার টন, যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮-১৯ সালে ৫ লাখ ৩৩ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ গত ১২ বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৮৩ শতাংশ। বর্তমানে বঙ্গোপসাগর থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রল ফিশিং এবং আর্টিসেনাল মৎস্য আহরণের মাধ্যমে মোট ৪ দশমিক ৩৯ লাখ টন মৎস্য আহরণ করা হচ্ছে।
দেশে মাছের উৎপাদন বাড়লেও সেভাবে দাম কমেনি। বরং মাছের দাম অনেক বেড়েছে। মাছ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, তেলাপিয়া মাছের কেজি বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, রুই মাছ ২৩০ থেকে ২৮০ টাকা, বড় রুই বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়। মৃগেল ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, চিংড়ি মাঝারিটা ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, বড়টা ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা। পাবদা ৪০০-৫০০ টাকা এবং রূপচাঁদা মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮৫০ টাকা। ছোট মাছের দামও আকাশ ছোয়া। অথচ আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যে প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে মাছ থেকে। বছরে একজন মানুষের ৩০ থেকে ৪০ কেজি মাছ খাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু দাম বাড়ার কারণে অনেকে প্রাণিজ এই আমিষ পূরণ করতে পারছে না।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ মৎস্য সম্পদের মতো সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের ক্ষেত্রেও উৎপাদন বেড়েছে। দেশ আজ মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। সাধারণ মানুষ স্বল্পমূল্যে মাছ পাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু সেভাবে মাছের মাধ্যমে পুষ্টির অভাবটাও থেকে যাচ্ছে।
এদিকে চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনাসহ সারা দেশের সব নদীতে চলছে ইলিশ ধরার উৎসব। দেশের হাটগুলোতে ইলিশ মাছে সয়লাব হয়ে যায়। কিন্তু দাম নাগালের বাইরে। মাছের আড়তে ৩০০, ৫০০ ও ৭০০ টাকা কেজি দরে বিভিন্ন আকারের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু ঢাকায় সেটি দেড় থেকে দুইগুণ বেশী দামে বিক্রি হচ্ছে। ভরা মওসুমেও ইলিশের দামে আগুন। এবার যেন ‘মাছের রাজা’ বদলে ‘দামের রাজা’ হয়ে উঠেছে ইলিশ। সস্তায় ইলিশ কেনার আশায় যারা দিন গুনছিল, এবার তাদের ডিপ ফ্রিজ খালিই থাকছে। অন্য বছর ক্রেতারা হালি হালি, ডজন ডজন ইলিশ কিনলেও এবার এখনো অনেকের পাতেই ওঠেনি এক টুকরো ইলিশ! রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি মাছের আড়তে গিয়ে দেখা যায়, এক কেজি ২০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকায়, এক কেজি থেকে এক কেজি ১০০ গ্রাম এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ টাকায়। ছোট ইলিশ পাঁচ-ছয়টিতে এক কেজি ৩০০-৩৫০ টাকা এবং সাত-আটটিতে এক কেজি ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম বেশি থাকায় ক্রেতাদের আনাগোনা নেই খুব একটা। ক্রেতা আল মামুন বলেন, কারওয়ান বাজারে এসেছিলাম কম দামে ইলিশ কিনতে। কিন্তু এখানেই যে দাম চায় তা শুনে দরদাম করার সাহস পাচ্ছি না। এত দাম দিয়ে আমাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষের ইলিশ খাওয়ার সাধ্য নেই। ইলিশ খাওয়াটা জরুরি কিছুও না যে এত দাম দিয়েই খেতেই হবে।
অন্যদিকে মাছ রফতানিতে কোনো সুখবর নেই। বরং রফতানি দিন দিন কমছে। গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) বাংলাদেশ থেকে ৭০ হাজার ৯৫০ টন মাছ রফতানি হয়েছে। কিন্তু পাঁচ বছর আগেই মাছ রফতানি হয়েছিল সাড়ে ৮৩ হাজার হাজার টন। একদিকে দামও বাড়ছে অন্যদিকে রফতানির পরিমাণ কমায় মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্যের রফতানি আয়ও কমছে। গত অর্থবছরে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ ৪৬ কোটি ৯ লাখ ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে, যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৬৩ কোটি ২৪ লাখ ডলার। মৎস্য অধিদফতর বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৮৩ হাজার ৫২৪ টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি করেছিল। এরপর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭৫ হাজার ৩৩৭ টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬৮ হাজার ৩০৫ টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৮ হাজার ৯৩৫ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ৭৩ হাজার ১৭০ টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি হয়েছে।