সময় সংবাদ রিপোর্ট: বাংলাদেশ থেকে ১১ হাজার ২৩৮ কিলোমিটার দূরের মাউন্ট মঙ্গনুইয়ে ইবাদত হোসেন যখন রস টেইলরের স্টাম্প উড়িয়ে দেন বাংলাদেশে তখনো ভোরের আলো ফোটেনি, কিন্তু বে ওভালের আলোতেই যেন ঝমমল করছিল গোটা বাংলাদেশ। মুশফিকুর রহিমের ব্যাটে যখন ম্যাচ জেতানো রান এলো তখন সূর্য উঁকি দিয়েছে শীতের সকালে। বাংলাদেশের ক্রিকেটেও যেন উঠেছে নতুন দিনের সূর্য। ১৬ সেশনের ১৫টিতেই দাপট দেখিয়ে চোখ ধাঁধানো পারফরম্যান্সে টেস্ট বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নিউজিল্যান্ডকে তাদের মাঠে ৮ উইকেটে হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালের পর ঘরের মাঠে কোন প্রতিপক্ষ টেস্টে হারাতে পারল কিউইদের। ইতিহাসগড়া প্রথম ম্যাচ জিতে দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজে এগিয়ে এল টাইগাররা। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের আসরেও বাংলাদেশ পেল প্রথম জয়ের দেখা।
আগের দিনের ৫ উইকেটে ১৪৭ রান নিয়ে নেমে বাংলাদেশের পেসারদের সামনে ১০ ওভারের একটু বেশি টিকতে পেরেছে নিউজিল্যান্ড। গতকাল সকালে প্রথম ঘন্টাতেই নিউজিল্যান্ডকে ১৬৯ রানে গুটিয়ে ব্যাটসম্যানদের কাজ সহজ করে রাখেন ইবাদত-তাসকিন আহমেদরা। শেষ দিনে ইতিহাস গড়ার কাজটা তাই হয়ে গেছে খুব দ্রুতই। ৪০ রানের লক্ষ্য পেরুতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। সাদমান ইসলাম ৩ ও ৩ চারে নাজমুল হোসেন শান্ত ফেরেন ১৭ রান করে। আর কোন বিপর্যয় ছাড়া ১৬.৫ ওভারেই কাজ সেরে ফেলে লাল সবুজের প্রতিনিধিরা।
নিশ্চিতভাবেই এটি বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় অর্জন। এবং তা এলো দেশের ক্রিকেটে সিনিয়র ক্রিকেটারদের অবদান ছাড়াই। সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল ছিলেন না। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ তো অবসরেই। সিনিয়রদের মধ্যে ছিলেন কেবল মুশফিকুর রহিম। কিন্তু এই ম্যাচে তার অবদান কেবল ১২ রান ও ৩* রান। তবে উইনিং রান নেওয়া এই অভিজ্ঞ সেনানীর একটি তথ্য না দিয়ে পারছি না, ২১ বছরের টেস্ট ইতিহাসে বাংলাদেশের জেতা ১৬ ম্যাচে ১৫টিতেই মাঠের সাক্ষী মুশফিক!
তবে অনেকটা নীরবেই নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। প্রায় এক মাস আগে সেই নিউজিল্যান্ড-যাত্রার পূর্বে সবার মধ্যেই ছিল একধরনের আশঙ্কা। কী হতে যাচ্ছে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে! এমনিতেই মাঠের পারফরম্যান্স আর নানা ধরনের বিতর্কে টালমাটাল হয়ে ছিল দেশের ক্রিকেট। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর ঘরের মাঠেও পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ও টেস্ট সিরিজ হেরেছে বাংলাদেশ। দলের ভেতরে ও বাইরে নানা অস্থিরতার মধ্যেই গিয়ে টেস্টের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে খেলাটা ছিল বড় পরীক্ষা। সে পরীক্ষাতেই পূর্ণ নম্বর পেল বাংলাদেশ। যে নিউজিল্যান্ডকে তাদের মাটিতে কখনো হারাতে না পারা বাংলাদেশই মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে পেল ঐতিহাসিক এক জয়। আর সেই জয়ও আধিপত্য বিস্তার করে, গোটা পাঁচটা দিন ভালো খেলে।
ঐতিহাসিক তো বটেই, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এ জয় নানা কারণেই বিশেষ। সবচেয়ে বড় কথা, এ জয় এমন একটা সময় এল, যখন দেশের ক্রিকেটের অনেক প্রক্রিয়াই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। চারদিকে চলছে সমালোচনা। দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট ঠিকমতো চলছে না, জাতীয় দলের নির্বাচন প্রক্রিয়া ঠিক হচ্ছে না, দেশের মাটিতে ভালো উইকেটে ক্রিকেটাররা খেলার সুযোগ পাচ্ছেন না থেকে দেশের ক্রিকেটের নতুন প্রতিভার জোগান বন্ধ হয়ে গেছে বলেও অনেকে অভিযোগের তির ছুড়ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) দিকে। এমন পরিস্থিতিতে এ জয় বিসিবিকে নিঃসন্দেহে স্বস্তি দেবে। তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার, মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের এ জয় মুমিনুল হকের দলকে বড় এক আত্মবিশ্বাসই জোগাবে। তারা যে পারে, টেস্ট ক্রিকেটে যে বাংলাদেশ অনাহুত নয়, এ বিশ্বাসই চারদিকে ছড়িয়ে দেবে এ জয়।
নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশ গেছে দেশের ক্রিকেটে তর্কযোগ্যভাবে সেরা তিন ক্রিকেটারকে ছাড়া। সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল ও মাহমুদউল্লাহ। তারা তিনজনই নিজেদের কারণে দলের বাইরে। তামিম চোটের সঙ্গে লড়ছেন, সাকিব ছুটি কাটাতে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে আর মাহমুদউল্লাহ তো গত জুলাইয়েই টেস্ট ক্রিকেটকে হুট করে বিদায় বলে দিলেন। মুমিনুল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের টেস্ট দলটা তাই হঠাৎই বিরূপ এক বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। পাকিস্তানের বিপক্ষে ঘরের মাঠেই তারা টেস্টে দাঁড়াতে পারেনি। টপ অর্ডার ব্যাটিংয়ের অবস্থা ছিল খুব খারাপ। বলতে গেলে কেউই রানের মধ্যে ছিলেন না। সেই দলই নিউজিল্যান্ডের মাঠে গিয়ে পাশার দান উল্টে দিল। বাংলাদেশ দলে আত্মবিশ্বাস এনে দিলেন জীবনের দ্বিতীয় আর বিদেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট খেলতে নামা এক ২০ বছরের তরুণ- মাহমুদুল হাসান। ট্রেন্ট বোল্ট, টিম সাউদি, নিল ওয়াগনার, কাইল জেমিসনদের নিয়ে গড়া বিশ্বসেরা গতির আক্রমণকে কী দারুণভাবেই না সামাল দিলেন তিনি। ২২৮ বলে ৭৮ রান করে বিশ্বাসটা ছড়িয়ে দিলেন দলের মধ্যে—বলের গুণাগুণ বিচার করে খেললে বোল্ট-সাউদি-ওয়াগনার-জেমিসনদেরও সাধারণ পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায়। এরপর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন অধিনায়ক মুমিনুল হক নিজেই, সঙ্গে ছিলেন লিটন দাস। দুজনের দুটি ভালো ইনিংস বাংলাদেশকে এগিয়ে নিল। এরপর হাতে পাওয়া রসদ ব্যবহার করলেন পেসার ইবাদত হোসেন ও তাসকিন আহমেদ। প্রথম ইনিংসেও তরুণ পেসার শরীফুল ইসলাম আর অফ স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ পথ দেখিয়েছিলেন। ভাবা যায়! ঐতিহাসিকভাবে স্পিন বোলিং-নির্ভর বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডের মাটিতে তাদের বিপক্ষেই টেস্ট জিতল পেস বোলারদের সাহায্যে, এটাই তো বিরাট এক ঘটনা।
বিদেশের মাটিতে টেস্ট জয় সব সময়ই বড় ঘটনা। বাংলাদেশের জন্য তো আরও বড় বিষয়। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ২১ বছরের ইতিহাসে যা সাফল্য, সেটি ঘরের মাঠেই, নিজেদের মতো করে উইকেট বানিয়ে। ঘরের মাঠে বাংলাদেশ ইংল্যান্ডকে টেস্টে হারিয়েছে, হারিয়েছে অস্ট্রেলিয়াকেও। কিন্তু ক্রিকেটের ধ্রুপদি সংস্করণে বিদেশের মাটিতে টেস্ট মানেই বাংলাদেশের ভরাডুবি। মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্ট সে ধারণা পাল্টাতে সাহায্য করবে। টেস্টে এ মুহূর্তের সেরা দলের বিপক্ষে তাদের মাটিতেই আধিপত্য করে জয় টেস্ট নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের চিন্তার জগৎটাই হয়তো আমূলে বদলে দেবে।
বিদেশের মাটিতে এই জয় আসাটা যে বিশেষ কিছু, সেটি অধিনায়ক মুমিনুল হকের একটা কথাতেই স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, বিদেশের মাটিতে জিততে চিন্তাভাবনা পরিষ্কার হওয়া খুব জরুরি। মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে গোটা টেস্টেই চিন্তাভাবনার জায়গায় অনেক পরিপক্ব মনে হয়েছে গোটা দলকে, ‘দেশের বাইরে খেলতে গেলে পরিষ্কার মানসিকতা থাকাটা জরুরি। ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডের মতো জায়গায় যদি আগে থেকেই ধরে বসে থাকি খেলা কঠিন, তাহলে কঠিনই হবে। এসব জায়গায় ফল নিয়ে না ভেবে প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবাই উচিত। এই টেস্টে (মাউন্ট মঙ্গানুই) আমরা কেউ ফল নিয়ে ভাবিনি। ভেবেছি, প্রক্রিয়াটা যথাযথ হচ্ছে কি না!’
প্রক্রিয়া ঠিক থাকলে যে সাফল্য আসবে, এটা বুঝতে পারার কারণেই মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টের জয় দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে পালাবদলের জয় হয়ে থাকবে। অথচ নিউজিল্যান্ডে টেস্ট খেলতে যাওয়ার আগে ঘরের মাঠে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাজেভাবে হেরে যাওয়ার গ্লানি সঙ্গী ছিল বাংলাদেশের। সঙ্গী ছিল তীব্র সমালোচনার ধকল। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে শুরু হওয়া বাজে সময়ে দেশের ক্রিকেট ছিল বিষাক্ত হাওয়ায় ভরপুর। এই জয় সব কিছুই আপাতত সরিয়ে দিল এক লহমায়।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
নিউজিল্যান্ড : ৩২৮ ও দ্বিতীয় ইনিংস : ৭৩.৪ ওভারে ১৬৯ (ল্যাথাম ১৪, ইয়ং ৬৯, কনওয়ে ১৩, টেইলর ৪০, নিকোলস ০, রবীন্দ্র ১৬, বোল্ট ৮; তাসকিন ৩/৩৬, শরিফুল ০/৩০, মিরাজ ১/৪৩, ইবাদত ৬/৪৬)।
বাংলাদেশ : ১৭৬.২ ৪৫৮ ও দ্বিতীয় ইনিংস (লক্ষ্য ৪০) : ১৬.৫ ওভারে ৪২/২ (সাদমান ৩, শান্ত ১৭, মুমিনুল ১৩*, মুশফিক ৫*; বোল্ট ০/৪, সাউদি ১/২১, জেমিসন ১/১২, ওায়গনার ০/৪)।
ফল : বাংলাদেশ ৮ উইকেটে জয়ী। ম্যাচ সেরা : ইবাদত হোসেন (বাংলাদেশ)। সিরিজ : দুই ম্যাচে ১-০তে এগিয়ে বাংলাদেশ।