সময় সংবাদ লাইভ রির্পোটঃস্বকীয় সৃজনের ধ্যানে পরিভ্রমণরত কবিসত্তা চলমান পার্থিব ও অপার্থিব জগতের সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা চালায়। কবি মানুষের নানাবিধ অভিঘাত নিজের মতো করে অনুভব করতে পারেন। অনুভূতি, বিচ্ছেদের মর্ম ব্যথা, স্পর্শকাতরতা, হাসি-আনন্দ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, সাধন-ভজন, সাম্য-মৈত্রী, আন্দোলন-সংগ্রাম ও জন্ম-মৃত্যুকে একান্ত নিবিড়িভাবে শব্দের তুলিতে নিজস্ব শিল্প ছাঁচে অবগঠনে নিমগ্ন থাকেন কবি। একজন শিল্পীর সত্যের অনুসন্ধানে নিগূঢ় জীবনবোধ ও তাঁর সৃষ্টির সমারোহে যে নান্দনিকতা তৈরি হয় তাই শিল্পীর শিল্পকর্ম। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য : ‘আর্ট (শিল্প) হলো সত্যের ডাকে মানুষের সৃষ্টিমুখর অন্তরের সাড়া দেওয়া’। কাল থেকে মহাকালে ভেসে যাওয়া কতক অনুষঙ্গকে সুবিন্যস্ত করে শিল্পের ফ্রেমে বন্দী করে দেন শিল্পের এ স্রষ্টা। তখন শিল্পীর সৃজন হয়ে ওঠে সকল কালের সব মানুষের। তাই কবি অতীত, চলমান ও সুদূরের সত্যানুসন্ধানে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন অনাদিকাল ধরে। কবি হয়ে ওঠেন মানুষের মুক্তির অগ্রপথিক। আমরা বলতে পারি কবি সেই ব্যক্তি, যিনি কবিত্ব শক্তির অধিকারী এবং কবিতা রচনা করেন। একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট বা ঘটনাকে রূপকধর্মী ও নান্দনিকতা সহযোগে কবিতা সৃষ্টিতে কবি ব্রত হন। আলোচ্য প্রবন্ধে কবি, কবিতা ও মানবতা বিষয়ে সাহিত্যের বিদগ্ধজনের মতামত এবং অভিমতগুলো ব্যবচ্ছেদ করে দেখার প্রয়াস থাকবে।
কবি শব্দটি ‘কু’ ক্রিয়ামূলের বংশে প্রসূত একটি শব্দ। ‘কু’ অর্থ অসাধারণ/ নবরূপে উত্তীর্ণকারী (কলিম খাঁন এবং ববি চক্রবর্তী রচিত বঙ্গীয় শব্দকোষ, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৮৫, প্রকাশক ভাষাবিন্যাস, কলকাতা, আশ্বিন-১৪১৬)। ইংরেজী শব্দ ‘পোয়েট’ (Poet), ল্যাটিন ভাষার প্রথম শব্দরূপ বিশেষ্যবাচক পুংলিঙ্গ (পয়েটা, পোয়েট ; Poeta, Poetae : আক্ষরিক অর্থে কবি) থেকে সংকলিত করা হয়েছে। কবি সেই মানুষ যিনি সাধারণ অভিজ্ঞতা/ অনুভূতি অথবা প্রচলিত শব্দকে নতুনরূপে উত্তীর্ণ করতে সক্ষম হন। সাধারণ মানুষ পৃথিবীর রূপ-রস, মানুষে মানুষে আত্মসংযোগ, ছেদ-বিচ্ছেদ, প্রেম ও প্রণয়কে যেভাবে দ্যাখেন; কবি দ্যাখেন একটু অন্যভাবে। এখানে আমরা ফরাসী কবি জঁ নিকোলা আর্তুর র্যাঁবো (১৮৫৮-১৮১৯)-এর কবি শব্দের বিষয়ে বক্তব্য উল্লেখ করতে পারি : ‘একজন কবি দর্শনীয় মাধ্যম হিসেবে নিজেকে অন্যের চোখে ফুটিয়ে তোলেন। তিনি একটি দীর্ঘ সীমাহীন এবং পদ্ধতিবিহীন, অনিয়ন্ত্রিত সকলের দৃষ্টিগ্রাহ্যতার বাইরে অবতীর্ণ হয়ে কবিতা রচনা করেন। সকল স্তরের ভালবাসা, দুঃখ-বেদনা, উন্মত্ততা-উন্মাদনার মাঝে নিজেকে খুঁজে পান তিনি। তিনি সকল ধরনের বিষবাষ্পকে নিঃশেষ করতে পারেন। সেই সঙ্গে পারেন এগুলোর সারাংশকে কবিতা আকারে সংরক্ষণ করতে। অথবা দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রণাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আকণ্ঠ বিশ^াসবোধ রচনা করে যখন যেখানে খুশি অগ্রসর হন। একজন অতিমানবীয় শক্তিমত্তার সাহায্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত হন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, একজন বড় ধরনের অকর্মণ্য ব্যক্তি থেকে শুরু করে কুখ্যাত অপরাধী, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিসম্পাতগ্রস্ত হিসেবেও তিনি অভিহিত হতে পারেন। যখন তিনি অজানা-অজ্ঞাত থেকে যান কিংবা তিনি বিকৃত, উন্মত্ত, বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন তারপরও শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সেগুলো দেখতে পাবেন। যদি তিনি উৎফুল্লে ভেসে অশ্রুত, নামহীন অজানা বিষয়াদি ধ্বংস করবেন, অন্যান্য আদিভৌতিক কর্মীরা তখন ফিরে আসবে এবং তারা পুনরায় সমান্তরালভাবে রচনা শুরু করবেন যা পূর্বেই নিপাতিত হয়েছিল। (Rimbaud, Rthur-1957, Louise Varese. Editor Iliumanation and Other Prose Poems)। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ (১৭৭০-১৮৫০) রোমান্টিক ধারার এই কবি বলেন, গানের বিষয়বস্তুকে আনন্দের সঙ্গে তুলে ধরা, বাইরে নির্গত হয়ে আমার আত্মাকে ঐদিন পরিশোধিত করবে যা কখনও ভুলে যাওয়ার মতো নয়। এবং এখানে লিপিবদ্ধ থাকবে। (দ্য প্রিলুড বুক ওয়ান) ম্যারিয়েন মুরে বলেন, ‘তারা প্রকৃতই সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করেন’ (পোয়েট্রি)। জনমিল্টন (১৬০৮-১৬৭৪) বলেন, ‘গ্রীক পুরাণে বর্ণিত কাবা ও সঙ্গীতাদির দেবীরা তাদের আবেগিক কর্মকা- প্রয়োগের মাধ্যমে কবিদের কাজে সহায়তা করেন’। ‘বাইরের জগতের রূপ-রস, গন্ধ-স্পর্শ, শব্দ বা আপন মনের ভাবনা-বেদনা ও কল্পনাকে যে লেখক অনুভূতি স্নিগ্ধ ছন্দোবদ্ধ তনুশ্রী দান করতে পারেন তাকে আমরা কবি নামে বিশেষায়িত করতে পারি। মোট কথা কবি জগতের ভাল-মন্দের যথাযথ চিত্র অঙ্কন করেন’। (‘সাহিত্য-দর্শন’ শ্রীশচন্দ্র দাশ, বর্ণবিচিত্রা, ঢাকা, ৬ষ্ঠ সংস্করণ ১৯৯৫; পৃষ্ঠা ৩১)। কবি শব্দ শিকারি একটি আত্মা। যে সত্তা সৌরভ ছড়াতে পারে যুগের আবহে, অন্যের না বলা কথা বলে আপন সৃষ্টিশৈলীতে, আগুনের পথে হেঁটে জীবনকে তুচ্ছ ভেবে প্রেম, মিলন ও মানবাত্মার জন্যে। কার্যত তিনিই কবি যিনি কবিতা লেখেন। তবে বিংশ শতাব্দীর প্রধান আধুনিক বাঙালী কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কবিতার কথায়’ বলেন, ‘সকলই কবি নয়। কেউ কেউ কবি; কবি কেন না তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং ভেতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকিরণ তাঁদের সাহায্য করেছে। কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয় কল্পনা ও কল্পনার ভেতরে অভিজ্ঞতার ও চিন্তার সারবত্তা তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়; নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করার অবসর পায়’। (কবিতার কথা, প্রবন্ধগ্রন্থ; প্রকাশ-১৯৬২)। কবির জীবনবোধ নদীর মতো প্রবহমান। তাই শব্দ বুননের দক্ষতাই কবিত্বের সৃষ্টি হয় না। জীবনানন্দ দাশ বলতে চান যে, যিনি কবি তাঁর কল্পনা, অভিজ্ঞতা ও অতীতের সঙ্গে গভীর বন্ধন তাকে কবিতা লিখতে সাহায্য করে এবং সবাই কবি নয় তিনি তা বোঝাতে চান। ‘কবিতার ভেতর আনন্দ পাওয়া যায়, জীবনের সমস্যা ঘোলা জলের মুষিকাঞ্জলির ভেতর শালিকের মতো স্নান না করে আসন্ন নদীর ভেতর বিকেলের শাদা রৌদ্রের মতো সৌন্দর্য্য ও নিবাকরণের স্বাদ পাওয়া যায়’। (কবিতার কথা, জীবনানন্দ দাশ)। যাহোক, কবির বেদনাবিদ্ধ হৃদয় কবিতার জন্মভূমি কোন একটি বিশেষ উপলক্ষ অবলম্বন করে কবির আনন্দ-বেদনা, মহালোকের গভীর অনুসন্ধানমূলক নিরীক্ষণ যখন শব্দের গাঁথুনিতে প্রকাশ পায় তখনই কবিতার জন্ম হয়। ব্যক্তিগত বেদনার বিষপুষ্প থেকে কবি যখন কল্পনার সাহায্যে আনন্দ উপভোগ করেন তখন তা হয়ে ওঠে শিল্পমন্ডিত ক্যাবিক ব্যঞ্জনাময় ও মানুষের হৃদয়গ্রাহী। কবির বেদনা-অনুভূতির রূপান্তর ক্রিয়া সম্পর্কে ক্রোচে বলেন, Poetic idealisation is not a trivous embellishment, but a profound penetration in virtue of which we pass from troublous emotion to the serenity of contemplation.
কবিতা সাহিত্যের আদি ও প্রাচীনতম শাখা। কবি নিজ তাড়নাবোধ, সত্য উচ্চারণ বা সহজাত প্রবৃত্তির অনুরাগেই কবিতা লেখেন। কবিতা গ্রীক শব্দ (Poiesis : নির্মাণ/ তৈরি করা; ইরেজি : Poetry)। কবিতা হচ্ছে শব্দের ছন্দময় বিন্যাস যা একজন কবির আবেগ, উপলব্ধি, চিন্তা ও অনুভূতিকে উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের সাহায্যে উদ্ভাসিত করে। শব্দের উৎকৃষ্ট ব্যবহার ও শিল্পসম্মাত ভাবের উন্মোচন কবিতার নান্দনিকতা ফুটে ওঠে। কাঠামোগত দিক দিয়ে কবিতার ধরন নানা রকম। যুগে যুগে কবিতার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন এসেছে। দার্শনিক এরিস্টটলের কাছে কবিতা ছিল দর্শনের চেয়ে বেশি এবং ইতিহাসের চেয়ে বড় কিছু। টিএস ইলিয়েট জানতেন, ‘কবিতা রচনা হলো রক্তকে কালিতে রূপান্তর করার যন্ত্রণা’। রোমান্টিকতার কবি কিটস মনে করেন, ‘কবিতা মুগ্ধ করবে তার সূক্ষ্ম অপরিমেয়তায়, এটি ঝংকারে নয়। পাঠকের মনে হবে এ যেন তারই সর্বোত্তম চিন্তা যা ক্রমশ ভেসে উঠছে তার স্মৃতিতে’। কোলরিজের কাছে কবিতা মানে, ‘সর্বোৎকৃষ্ট শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো’। রবার্ট ফ্রস্টারের কাছে কবিতা হলো, ‘পারফরমেন্স ইন ওয়ার্ডস’। বোদলেয়ার কবিতাকেই কবিতার শেষ কথা বলে মনে করতেন। বুদ্ধদেব বসু মনে করতেন, কবিতা সম্বন্ধে ‘বোঝা কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝি না, অনুভব করি’। কবিতা বোধের বিষয় : দর্শন, ইতিহাস মানুষের অন্যান্য বিষয় থেকে কবিতা উপলব্ধির বিষয় -যাতে থাকে মানুষের অন্তরনিগূঢ় অনুভবের শৈল্পিক উপস্থাপন যা একজন কবি করে থাকেন। কবি তাঁর সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে অমরত্বের সুধা পান করতে চায়। তাই তাঁর আত্মা ঘুরে বেড়ায় আদিমকাল হতে বর্তমান ও সুদূর ভবিষ্যতের গন্তব্যে। সমাজ, রাষ্ট্র, কৃষ্টি-ঐতিহ্য, দর্শন, সত্য-সুন্দর, মানুষের বিচিত্র সৃষ্টি, প্রেম-প্রকৃতি ও মানবাত্মার মাঝে কবি এবং তাঁর কবিতা সুদৃঢ় বন্ধন তৈরিতে কালজয়ী ভূমিকা পালন করে। সমাজ ও জাতির সঙ্কটকালে কবিতা হয়ে ওঠে নিপীড়িত মানুষের আয়না। তখন কবিতাই জাতির অভিভাবকের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয় মানুষের জন্যে। আমরা কবি হেলাল হাফিজকে বলতে শুনি, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ মিছিলের সব হাত/ কণ্ঠ পা এক নয়/। যেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে/ কেউ আসে রাজ পথে সাজাতে সংসার’। (এখন যৌবন যার, হেলাল হাফিজ)। বিশ^ভুবনের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অসঙ্গতি কবি মানসপটে রক্ত ঝরায়। অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-নির্যাতন ও ধান্ধাবাজের বিরুদ্ধে কবিতা হয়ে ওঠে আপোসহীন প্রতিবাদের ভাষাস্বরূপ। মানুষের বিপ্লবী চেতনাকে শাণিত করে উদ্ধুদ্ধ করেন একজন কবি। ‘তুমি শুয়ে র’বে তেতালার ’পরে, আমরা রহিব নীচে,/ অথচ তোমাদের দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে!’ (কুলি মজুর, কাজী নজরুল ইসলাম)। একজন কবির দায়িত্ববোধ আধ্যাত্মিক ও মানবিক প্রসূত। সমাজ-রাষ্ট্র বা বৃহত্তর পরিসরে যুদ্ধ, হিংসা-বিদ্বেষ, অহঙ্কার ও স্বার্থপরতার বিপরীতে কবি কামনা করে অপরিমিত শান্তির বাণী। তাঁর সৃজনশীল শিল্পের পরতে পরতে দীপ্তিমান হয়ে ওঠে অপরিসীম ভালবাসা ও প্রেম। সুন্দরের প্রতি কবি একাগ্রচিত্রে আবিষ্ট থাকেন, মানুষের দুঃখবোধ ও অব্যক্ত ভাব উন্মোচনে কবি ধ্যান করেন সুন্দরের ও মানবতার। কিটস বলেন, ‘সত্য সুন্দর, সুন্দরই সত্য’। গোষ্ঠী থেকে বৈশ্বিক পরিমন্ডলে মানুষের আত্মাকে জাগ্রতকরণে, ন্যায়ভিত্তিক ও সমতা বিধানমূলক সমাজ গঠনে কবির চিন্তা সুদূরপ্রসারী। মানুষের অধিকার আদায়ে কবিরা যুগে যুগে বিপ্লবের ডাক দিয়েছেন। প্রাচীনকাল থেকেই কাব্যরস মানুষের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে। পৃথিবীতে বিভিন্ন সময়ে সংগ্রাম, বিপ্লব ও স্বাধীনতার সুফল আস্বাদনে কবি ও কবির কবিতা দিয়েছে প্রেরণা ও সাহস। রুশ বিপ্লব, ফরাসী বিপ্লব এবং ব্রিটিশ শৃঙ্খল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা, পাকিস্তানের দীর্ঘ শাসন-শোষণের শিকল থেকে মুক্তির জন্যে কবিতা মানুষের রক্তে স্বাধীনতা এবং মুক্তির চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। ফরাসী বিপ্লব পুরো বিশ্বের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব প্রভাব ফেলে ছিল। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল কৃষক ও শ্রমজীবীদের আত্মদান। এই বিপ্লবের মূলমন্ত্র ছিল সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। শ্রমজীবী মানুষের মাঝে বোধ জাগ্রতকরণে ফরাসী কবি-সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের অবদান অষ্টাদশ শতাব্দী ধরে ইউরোপে এক বিপ্লবী চেতনার জন্ম দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। কবি সত্য উদঘাটনে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালায়। সবকিছু অন্তর চোখে দ্যাখেন এবং তাঁর চোখ সারা বিশ্ব পাহারারত থাকে। সমাজের নানা অসঙ্গতি, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, নাগরিক জীবনের ব্যর্থতা, রাষ্ট্রের অনৈতিক শাসন ও অবিচারের বিরুদ্ধে কবির আত্মা জেগে ওঠে আপন মহিমায়। কবি তাঁর কবিতা সময়ের সম্মুখসারি থেকে স্বজাতির প্রতিনিধিত্ব করেছে যুগ যুগ ধরে। সব মানুষকে এক করে সমতা ও মানবতার কথা বলেছে। ‘সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই’ (চন্ডীদাস)। একজন কবির এ সাহসী উচ্চারণ মানুষের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছে সেই প্রাচীনকাল থেকে। মরমী সাধক লালন সাঁই জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ, গোত্র সবকিছুর উর্ধে ওঠে মানবধর্মকে সর্বজনীন ধর্ম বলে মনে করেছেন। তিনি বলেন, ‘ব্রাহ্মণ চন্ডাল চামার মুচি/ একি জলেই সব হয় গো সুচি/ দেখে শুনে হয় না রুচি/ যমে তো কাউকে ছাড়বে না’। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাঙালী জাতির শেকড়রের বিস্তারী এক মহীরুহ। ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেও জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সুরম্য অট্টালিকায় বসে কলকাতার বস্তিবাসীর সংগ্রামী জীবন-যাপন তিনি প্রত্যক্ষ করে ছিলেন। সাধারণ মানুষের শোক-দুঃখ, ব্যথা- বেদনা অন্তর দিয়ে অনুভব করেছেন। পরবর্তীতে তিনি জোড়াসাঁকোর প্রাসাদ ছেড়ে গ্রাম-বাংলার পথে-প্রান্তরে, খাল-বিল, নদী পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন অবিরাম। সঞ্চয় করেছেন নানা অভিজ্ঞতা। তাঁর ছোটগল্প সে অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য বহন করে। তিনি মানুষে মানুষে কোনো প্রভেদ দেখতে চাননি। শান্তি নিকেতনে মাটি ও খড়ের ঘরে বাস করেছেন। জমিদারি দেখাশোনার জন্যে তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, শাহজাদপুর ও নওগাঁর পতিসরে থাকাকালে কৃষকের সঙ্গে তাঁর নিবিড় বন্ধন তৈরি হয়েছিল। মানস ধর্ম ও মানবতাবাদে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। বাংলা (১৩১২) সনে ফসল না হওয়াতে কৃষকের আটান্ন হাজার টাকার খাজনা মাফ করে দেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন প্রজাহিতৈষী জমিদার। ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনও মন্দির-কাবা নাই’। (কাজী নজরুল ইসলাম)। মানুষের পবিত্র আত্মাই সবকিছু আর এই মানব আত্মাকে সম্মান করাই কবির সৃষ্টির উদ্দেশ্য। কাজী নজরুল ইসলাম মানুষ কবিতায় উল্লেখ করেন, ‘গাহি সাম্যের গান-/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।/ নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,/ সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি/ ও কে চন্ডাল ? চমকাও কেন ? নহে ও ঘৃণ্য জীব!/ ওই হতে পারে হরিশচন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব।/ আজ চন্ডাল, কাল হতে পারে মহাযোগী-সম্রাট,/ তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে, করিবে নান্দী পাঠ’। মানুষে মানুষে যে কোনো শ্রেণী-বৈষম্য ও ভৌগোলিক সীমান্ত অতিক্রম করে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের মাধ্যমে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। মানুষই সত্য, মানুষই মহান কবির সর্বজনীন মানস ধর্মের অহিংস নীতি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কঠোর লড়াই। কবি সাম্যবাদী কবিতায় বলেন, ‘ গাহি সাম্যের গান-/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,/ যেখানে মিশেছে হিন্দু- বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।/গাহি সাম্যের গান!/ কে তুমি ?- পার্সী ? জৈন ? ইহুদী ? সাঁওতাল, ভীল, গারো ?/ কন্ফুসিয়াস ? চার্বাক-চেলা ? বলে যাও, বলো আরো!’ কবি পাপ কবিতায় আরো বলেন, ‘সাম্যের গান গাই!-/ যত পাপী তাপী সব মোর বোন, সব হয় মোর ভাই’। এ বিশ্ব পরিমন্ডলে কবি সকল অসহায়, অনাদৃতদের পাশে দাঁড়িয়ে মানবতার চরম সাক্ষ্য দিয়েছেন। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ সকল ধর্মের মানুুষের রক্ত একই ধারায় প্রবাহিত। ‘আমার এ ঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর, আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর’। (কবি জসীম উদ্দীন)। কবি মানুষের জন্যে আরো ব্যাকুল প্রাণ, মানুষের জন্যে, মানুষকে আপন করার জন্যে সবকিছুকে বিলীন করতে চান।
কামিনী রায় পরার্থে কবিতায় বলেন, ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে/ আসে না কেহ অবনী ‘পরে,/ সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’। কবি মানুষকে নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে পরের কল্যাণে নিবেদিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কবি সুকান্ত মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর। গণমানুষের কবি অন্নহীন মানুষের কথা বলেছেন। নতুন প্রজন্মের জন্যে একটি সুন্দর পৃথিবী রেখে যাওয়ার দৃঢ় শপথ নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;/ জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে চলে যেতে হবে আমাদের।/ চলে যাবো-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/ এ বিশ্বকে শিশুর জন্যে বাসযোগ্য করে যাবো আমি/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। পৃথিবীর সকল মানুষকে মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে কবিরাই এগিয়ে এসেছে। আমাদের দেশে স্বাধিকার আন্দোলনে বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও মানুষের সকল অধিকার উন্মোচনে বাঙালীর শেকড় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন কিংবদন্তীর সমতুল্য। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ ও তাদের শোষণ-ত্রাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি কবিরা প্রতিবাদ করেছে ব্রজকণ্ঠে। পৃথিবীর বুকে যুদ্ধ, বিবাদ এবং উৎকণ্ঠা প্রশমনে কবির বাণী শান্তির বার্তা নিয়ে আসে। কবির সৃজন জগতের অমর বাণী সমাজের কুসংস্কার, অন্ধতা ও সংকীর্ণতা থেকে পৃথিবীকে আলোকিত করে।
একজন কবির সৃজন সময়কে ধারণ করে বয়ে চলে মানুষের মাঝে, সমাজে, গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের পরতে পরতে; যা মানবাধিকার রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
মোঃ আব্দুর রাজ্জাক,কবি ও প্রাবন্ধিক।