সময় সংবাদ লাইভ রিপোর্ট : শুদ্ধ বাংলা। সুন্দর উচ্চারণ। ‘হ্যালো স্যার, বিকাশ কাস্টমার কেয়ার থেকে আমি… বলছি’। এভাবেই শুরু। তারপর কৌশলে সর্বস্ব লুটে নেয় ‘হ্যালো পার্টি’। বিভিন্ন ব্যক্তিকে টার্গেট করেই মিশনে নামে এই চক্র। প্রতিদিন একশ’ জনকে এ রকম কল দিলে অন্তত দশ জনের ক্ষেত্রে তারা সফল হয়। অন্যদিকে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসার মতো অবস্থা হয় প্রতারণার শিকার ব্যক্তিদের।
দীর্ঘ দিন থেকে বিকাশ গ্রাহকরা প্রতারণার শিকার হলেও এবার বিকাশ এজেন্টরা বাদ পড়ছেন না এই চক্রের কবল থেকে। এই করোনাকালে যেনো তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। করোনা মহামারির সময়ে সীমিত পরিসরে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে। যে কারণে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রম বেড়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতারকচক্র হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এছাড়াও বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির নাম ব্যবহার করে পুরস্কারের প্রলোভন দেখিয়ে, শীর্ষ কর্মকর্তাদের ফোন ক্লোন করে চাকরি ও কাজের তদবির থেকে শুরু করে নানা অপকর্ম করে ‘হ্যালো পার্টি’র সদস্যরা।
সম্প্রতি এই ‘হ্যালো পার্টি’র প্রতারণার শিকার হয়েছেন ব্যবসায়ী, প্রবাসী থেকে শুরু করে বিকাশ এজেন্টরা। কৌশলে বিকাশ এজেন্টের সর্বস্ব লুটে নিয়েছে প্রতারক চক্র। সব হারিয়ে নিঃস্ব ওই ক্ষুদে ব্যবসায়ী এখন টাকা উদ্ধারে থানা পুলিশের সহযোগিতা নিচ্ছেন। মামলা করেছেন। জড়িতদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ। তবে এখন পর্যন্ত আসামিদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। প্রতারণার শিকার রাজধানীর ডেমরার সারুলিয়া এলাকার বিকাশ এজেন্ট মোহাম্মদ নোমান হোসেন।
নোমান জানান, ব্যবসা ভালোই চলছিল। ২৩শে জুন। দুপুর বেলা। হঠাৎ করেই স্থানীয় বিকাশ ডিস্ট্রিবিউটরের নম্বর থেকে একটি কল আসে। ‘হ্যালো, আমি বিকাশ ডিস্ট্রিবিউটর সারুলিয়া অফিস থেকে বলছি। আপনিতো বিকাশ এজেন্ট, কিন্তু আপনাকে বিকাশ এ্যাপসটি দেয়া হয়নি। তাই আজ একটু পর বিকাশ হেড অফিস থেকে আপনাকে কল দেব। কিছু তথ্য জানতে চাইবে। আপনাকে একটি এসএমএস দেয়া হবে। এটি সাবধানে রাখবেন। কোনোভাবেই যেনো এসএমএসটি ডিলিট না হয়। হেড অফিসের কলটি ধরে কথা বলা শেষ হলে তাকে কল দিতে বলেন ডিস্ট্রিবিউটর অফিসের নম্বর দেয়া কল দেয়া ওই ব্যক্তি।
দুই মিনিট যেতে না যেতে +১৬২৪৭ নম্বর থেকে নোমানের মোবাইলে কল আসে। পরপর দু’বার। ব্যস্ততার কারণে কল রিসিভ করা হয়নি। এরমধ্যে আবার ডিস্ট্রিবিউটর অফিসের নম্বর থেকে কল। জানতে চান, নোমান কেন কল ধরছেন না। বলা হয়, কি ব্যাপার আপনাকে কল দিচ্ছি আপনি কল ধরছেন না কেন? সরি বলে আবার কল দিতে বলেন নোমান। কল রিসিভ করতেই ওই ব্যক্তি সালাম দিয়ে শুদ্ধ বাংলায় বলতে থাকেন, আপনাকে বিকাশে এ্যাপস দিচ্ছি। আপনার বিকাশ এজেন্ট নম্বরে একটি এসএমএস যাবে। খুব সাবধান। এটি যেনো ডিলিট না হয়।
এরমধ্যেই তাকে বিকাশ শর্টকোট হতে একটি এসএমএস ও একটি ওটিপি কোড পাঠায়। তারপর কোডটি জানতে চায় ওপর প্রান্ত থেকে। নোমান কোডটি বলে দেন। তারপর বিশ্বাসযোগ্য বিভিন্ন প্রশ্ন করে। এক পর্যায়ে স্টার টু ফোর সেভেন হেষ চাপতে বলে। নির্দেশনা অনুসারে চাপতে থাকেন নোমান। এভাবে নির্দেশনা অনুসরণ করতে গিয়ে তাদের মার্চেন্ট বিকাশ পেমেন্ট ছয়টি নম্বরে ২ লাখ ৬৪ হাজার ৬শ’ ৬৩ টাকা নিয়ে যায় প্রতারক চক্র। বিকাশ একাউন্ট চেক করতেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে নোমানের। তাৎক্ষণিকভাবে ডিস্ট্রিবিউর অফিসে মো. রিয়াজের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু রিয়াজ জানান, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
প্রতারণার শিকার নোমান জানান, মা, বাবার দীর্ঘ ত্রিশ বছরের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে গত ফেব্রুয়ারি থেকে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। পশ্চিম সারুলিয়া এলাকার ওই দোকানের নাম বিসমিল্লাহ কম্পিউটার্স এন্ড টেলিকম। ব্যবসার সুবিধার্থে একটি এজেন্ট নম্বরসহ দু’টি পার্সোনাল নম্বরে বিকাশ একাউন্ট করেন। এজেন্ট নম্বরটি নিজের নামে এবং পার্সোনাল একাউন্টটি ছোট ভাই ও মামাতো ভাইয়ের নামে। নোমানের এজেন্ট নম্বরে ই-ক্যাশ লোড করে দেন সারুলিয়ার বিকাশের ডিস্ট্রিবিউটর ওয়ানজা লিমিটেডের মো. রিয়াজ।
অপরাধীদের খুঁজে বের করতে থানা পুলিশমুখো হয়েছেন তিনি। গত ২৫শে জুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ডেমরা থানায় মামলা করেছেন মোহাম্মদ নোমান হোসেন। এ ঘটনায় তদন্ত করছেন ডেমরা থানার পরিদর্শক মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, চক্রটি একের পর এক বিকাশ গ্রাহকদের টার্গেট করে প্রতারণা করছিলো। সম্প্রতি বিকাশ এজেন্টরাও এই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করতে তৎপরতা চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।
একই কৌশলে গত তিন মাসে প্রায় ৫৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্রের দুই সদস্য। মিন্টু মিয়া ও শোভা আক্তার। তারা স্বামী-স্ত্রী। গত ১১ই জুন পশ্চিম রামপুরা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় প্রতারণার শিকার ইউনিয়ন লেভেল এক্সেসরিজ কারখানার ম্যানেজার আব্দুল আলিম। গ্রেপ্তারের পর প্রতারক দম্পতির কাছ থেকে ২৭টি সিম কার্ড ও তিনটি মোবাইল সেট জব্দ করা হয়। প্রতারণার শিকার হয়ে গত ৪ঠা জুন টঙ্গী পশ্চিম থানায় মামলা দায়ের করেন আব্দুল আলিম। তারপর তথ্য প্রযুক্তির সহযোগিতায় প্রতারক দম্পতির অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট সূত্রে জানা গেছে, হ্যালো পার্টি, ওয়েলকাম পার্টি নামে এরকম ভিন্ন ভিন্ন চক্র রয়েছে। ওয়েলকাম পার্টির প্রশিক্ষক রিজাউল মাতুব্বরকে (৪২) কয়েক মাস আগে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। গ্রেপ্তারের পর চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে রিজাউল। গত ১২ থেকে ১৩ বছর ধরে এই প্রতারণা করে আসছিল সে ও তার সহযোগীরা। এক্ষেত্রে বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করতো। তারা মোবাইলের মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানিসহ বিকাশ কোম্পানি থেকে লটারিতে গাড়ি, বাড়ি, অর্থ পুরস্কার পেয়েছেন বলে প্রলোভন দেখাতো। তাদের ফাঁদে যারা পা দিতো তাদের কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে হাতিয়ে নিতো অর্থ। এছাড়াও সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মোবাইল নম্বর ক্লোন করে তাদের পরিচয়ে তদবির, উৎকোচ আদায় করতো চক্রের সদস্যরা। এই পার্টিতে যারা নতুন যোগ দিতো তাদের প্রশিক্ষণ দিতো রিজাউল। আমেরিকা ফেরত এক ব্যক্তির কাছ থেকে রবি কোম্পানির কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে লটারিতে গাড়ি পেয়েছেন- এমন প্রলোভন দেখিয়ে বিপুল পরিমান টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সিআইডি জানায়, ১২২টি বিকাশ অ্যাকাউন্ট নম্বরের মাধ্যমে পঞ্চান্ন লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রিজাউল। পরবর্তীতে এ ঘটনায় খিলগাঁও থানায় মামলা হলে রিজাউলকে খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।