সময় সংবাদ রিপোর্টঃ বৃহস্পতিবার ঘোষিত হচ্ছে আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। অর্থনীতির সংকট সামাল দিতে এবারের বাজেটে রাজস্ব আয় বাড়াতে ভ্যাট ও করের ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণে রাজস্ব আয়ের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কিছু খাতে কর অব্যাহতি তুলে নেওয়া হবে। পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে করছাড় থাকছে না এবং কিছু ক্ষেত্রে কমানো হচ্ছে। নতুন করদাতা যুক্ত করা বা করের জাল বাড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ থাকবে। ভ্যাটের হার বাড়ানোর পাশাপাশি আওতা বাড়ানো হবে। এসব পদক্ষেপে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা মানুষের একটি বড় অংশ নতুন করে আরও চাপে পড়তে পারে।
জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এর জন্য রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকছে ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ২ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকবে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয় এবং এনবিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিজস্ব প্রয়োজন তো আছেই, আইএমএফের দিক থেকেও আগামী অর্থবছরে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের রাজস্ব বাড়ানোর শর্ত রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় কর সংগ্রহ ৮ শতাংশের কম। ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি অনুমোদনের সময় আইএমএফ বলে দিয়েছিল, বাংলাদেশকে কর-জিডিপির হার বছরে দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে।
রাজস্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে করের আওতা সম্প্রসারণ, কর প্রশাসনের সংস্কার ও আদায় প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়করণের পাশাপাশি কর অব্যাহতি ও শুল্ক-কর ছাড় আগামী তিন অর্থবছরের মধ্যে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। গত নভেম্বরে এনবিআরের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ করব্যয়ের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। ‘প্রত্যক্ষ করব্যয়’ বলতে রেয়াত, ছাড়, অব্যাহতি, হ্রাসকৃত হারে করারোপ এবং মোট করযোগ্য আয় পরিগণনা থেকে আয় বাদ দেওয়াকে বোঝায়। এনবিআর এবারই প্রথম আগামী বাজেটে কর অব্যাহতি ও শুল্ক-কর ছাড় কমিয়ে অন্তত বাড়তি ১৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের কৌশল গ্রহণ করেছে।
তৈরি পোশাক, ক্ষুদ্রঋণ, রেমিট্যান্স, পোলট্রি ও ফিশারি খাতেও করছাড় কমানো হতে পারে। নতুন বাজেটে ম্যাঙ্গো বার ও জুস, তেঁতুলের জুস, পেয়ারার জুস, আনারসের জুস ইত্যাদি উৎপাদনে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরে বাসাবাড়ি, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন খাতে নিরাপত্তাসেবা প্রায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এখন এ ধরনের নিরাপত্তাসেবা নিলে ১০ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট দিতে হয়। আগামী বাজেটে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা করছে এনবিআর।
নতুন ভ্যাট আইনে ১৫ শতাংশকে আদর্শ ভ্যাটহার ধরা হলেও নানা কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এ জন্য একাধিক হারে ভ্যাট আদায় হচ্ছে। আগামী বাজেটে এ হার কিছুটা যৌক্তিক করা হবে। এ ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় পণ্যে ভ্যাট হার বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে এনবিআরের। ২০২৬ সাল নাগাদ পর্যায়ক্রমে সব পণ্য ও সেবার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট হার আরোপের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
কর ব্যতীত প্রাপ্তি (নন-ট্যাক্স রেভিনিউ) বাড়াতে আগামী বাজেটে জেলা, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের হাটবাজারের ইজারামূল্য কিছুটা বাড়বে। সেই সঙ্গে বাড়বে জমির নামজারির মাশুলও (ফি)। মোবাইল কোর্টসহ যেসব খাতে সরকার জরিমানা ও দণ্ড আরোপ করে, সেগুলোর পরিমাণও বাড়ানোর চিন্তা করছে সরকার। এ ছাড়া উড়াল সড়ক, এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন সেতু পারাপারের টোল, সেবা ও প্রশাসনিক মাশুল বাড়ানো হতে পারে।
শূন্য শুল্কের অর্ধশতাধিক পণ্যে আগামী অর্থবছর থেকে ১ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক আরোপ হতে পারে। বর্তমানে আমদানিতে কোনো শুল্ক নেই– এমন পণ্যের সংখ্যা ৩২৯টি। এ তালিকায় আছে খাদ্যপণ্য, সার, গ্যাস, ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল, কৃষি উপকরণ ইত্যাদি। যেসব পণ্যে ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসানোর চিন্তা করা হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে– গম, ভুট্টা, সরিষা বীজ, তুলা বীজ, বিভিন্ন শাকসবজির বীজ, কয়লা, জিপসাম, ভিটামিন, পেনিসিলিন, ইনসুলিন, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক, প্লাস্টিক কয়েল, পেপার বোর্ড, স্টিল জাতীয় পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি-যন্ত্রাংশ ইত্যাদি। শুল্ক আরোপের ফলে এসব পণ্যের জন্য মানুষকে বর্তমানের চেয়ে বাড়তি খরচ করতে হতে পারে।
বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের ইলেকট্রনিক্স পণ্য খাতকে সরকার ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে আসছে। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত এসি উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে। এর মেয়াদ আর না বাড়িয়ে নতুন অর্থবছরে ৫ শতাংশ ভ্যাট বসতে পারে। ফ্রিজ উৎপাদনে ভ্যাটের হার বিদ্যমান ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। এলইডি বাল্ব, টিউব লাইট, তরল পেট্রোলিয়াম (এলপি) গ্যাস সিলিন্ডারের মতো পণ্যেও বাড়তে পারে ভ্যাট। এসব খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এর ফলে তাদের পরিচালন ব্যয় বাড়বে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে বাড়তি ব্যয়ের ভার ভোক্তাদের ওপরই চাপবে।
কিছু শর্ত প্রতিপালন সাপেক্ষে রেফারেল বা বিশেষায়িত হাসপাতাল শুল্কছাড় সুবিধায় ১ শতাংশ শুল্কে মেডিকেল যন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির সুযোগ রয়েছে। আগামী বাজেটে ২০০টিরও বেশি মেডিকেল যন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে তা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে, যা গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা ব্যয়কে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
একটি হাসপাতালকে রেফারেল বা বিশেষায়িত হাসপাতাল হতে হলে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। সরকার নির্ধারিত শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে– ন্যূনতম ১০০ শয্যাবিশিষ্ট মনো-ডিসিপ্লিনারি বা ন্যূনতম ১৫০ শয্যাবিশিষ্ট মালটি-ডিসিপ্লিনারি হতে হবে। আন্তর্জাতিক মান পূরণ করে রোগীদের জন্য উচ্চমানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এতে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার সক্ষমতাও থাকতে হবে। দেশের প্রধান রেফারেল হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে– বারডেম, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, অ্যাপোলো হাসপাতাল, জয়নুল হক সিকদার মহিলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ, ইব্রাহিম ইকবাল মেমোরিয়াল হাসপাতাল, জালালাবাদ রাজিব-রাবেয়া মেডিকেল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, সালাউদ্দিন বিশেষায়িত হাসপাতাল, আদ্-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডেল্টা হাসপাতাল এবং ল্যাবএইড বিশেষায়িত হাসপাতাল।
রাজস্ব বাড়ানোর তাগিদ থেকেই মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি সত্ত্বেও নতুন বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে না। অন্যদিকে বিত্তশালীদের কাছ থেকেও বাড়তি কর আদায়ের পদক্ষেপ থাকছে। বর্তমানে বার্ষিক আয় সাড়ে ১৬ লাখের বেশি হলে ২৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। আগামী বাজেটে সাড়ে ৩৮ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে করহার রাখা হচ্ছে ২৫ শতাংশ। তবে এর বেশি আয়ের ক্ষেত্রে তা বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে। এ ছাড়া পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে ৪০ লাখ টাকার বেশি মুনাফার ওপর ‘ক্যাপিটাল গেইন’ কর আরোপের সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এ হার হতে পারে ১৫ শতাংশ। করের আওতা বাড়াতে কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া আরও কিছু সেবায় রিটার্ন জমার সনদ প্রদান বাধ্যতামূলক হতে পারে।
মোবাইল ফোনে কথা বলা বা ইন্টারনেটের ওপর বাড়তি ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে। মোবাইল অপারেটরদের সিমকার্ড বিক্রির ওপর কর ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা হতে পারে। বর্তমানে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্কে প্রবেশে এবং রাইডে চড়তে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা রয়েছে। কোমল পানীয়, কার্বোনেটেড বেভারেজ, এনার্জি ড্রিংকস, আমসত্ত্বের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। এ ছাড়া কার্বোনেটেড বেভারেজের ওপর ন্যূনতম কর আরও ২ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ শতাংশ হতে পারে। সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক বাড়তে পারে।
সাবেক অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, দেশের কর-জিডিপির অনুপাত কম থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে শুল্ক-করছাড় ও অব্যাহতি। অনেক দিন ধরে কিছু কিছু ক্ষেত্রে করছাড় দেওয়া রয়েছে, যার ইতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে নেই। রাজস্ব আয়ের অন্যান্য উদ্যোগের পাশাপাশি এসব ক্ষেত্রে যৌক্তিকতার ভিত্তিতে করছাড় কমিয়ে আনতেই হবে। কারণ দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াতে রাজস্ব বাড়ানোর বিকল্প নেই। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এ ক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য, যোগাযোগসহ গণমানুষ জড়িত এসব জায়গায় ছাড় অব্যাহত রাখতে হবে। এমনকি উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময় প্রয়োজনে মানুষকে স্বস্তি দিতে এসব জায়গায় ভর্তুকি বাড়াতে হবে।
কর বিশেষজ্ঞ স্নেহাশীষ মাহমুদ অ্যান্ড কোং-এর অংশীদার স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, কর অব্যাহতি পর্যায়ক্রমে তুলে নিতে হবে, এটা ঠিক। তবে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকায় বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতির চাপ রয়েছে। তাই কর অব্যাহতি তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে এর সম্ভাব্য প্রভাব বিবেচনায় নিতে হবে। একই সঙ্গে উৎসে করহার যৌক্তিকীকরণ এবং অঅনুমোদনযোগ্য ব্যয় তালিকা কমিয়ে কার্যকর করহার কমানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।