সময় সংবাদ রিপোর্ট : বাজার থেকে সয়াবিন তেল রীতিমতো গায়েব। নতুন করে রেকর্ড দাম বাড়ানোর পরও বাজারে সয়াবিনের বোতল মিলছে না। দু-এক বোতল মিললেও কিনতে হচ্ছে আকাশছোঁয়া দামে। গত দুই সপ্তাহ ধরে চলছে এ সংকট। তেল পরিবেশক প্রতিষ্ঠানগুলো বারবার সরবরাহ স্বাভাবিকের কথা বলে এলেও খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন- তেল নেই। ঈদের আগে সংকট তীব্রতর হওয়ায় খুচরাপর্যায়ে প্রতিলিটার তেলের দাম গিয়ে ঠেকে ২০৮ টাকা পর্যন্ত। আর নিরুপায় হয়ে অতিরিক্ত দামে তেল কিনে পকেট ফাঁকা হয়েছে ভোক্তার।বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিয়মিত দাম সমন্বয় করতে না পারার কারণেই মূলত দেশে সয়াবিনের বাজারে এমন অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। একপর্যায়ে যা তীব্র আকার ধারণ করেছে। পাশাপাশি আমদানি ও সরবরাহের প্রকৃত তথ্যের ঘাটতি ও নজরদারির অভাবকেও দায়ী করেছেন তারা।ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘সয়াবিনের বাজার সামাল দিতে সরকার অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর প্রত্যাহার করেছে, আমদানিতে কর কমিয়েছে। কিন্তু আমদানি ও সরবরাহের প্রকৃত হিসাবের দিকে নজর দেওয়া হয়নি। উল্টো বলা হয়েছে, সয়াবিনের পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। তাই যদি হয়, তা হলে সয়াবিন গেল কোথায়? আমদানি ও সরবরাহের তথ্যে অবশ্যই সরকারের নিবিড় নজরদারি থাকতে হবে। সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়তে পারে না। প্রয়োজনে সরকার নিজেও আমদানি করে সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পারে। পাশাপাশি নিয়মিত যুক্তিসঙ্গতভাবে মূল্য সমন্বয় করতে হবে। দাম বাড়ানোর মতো সঠিক সময়ে দাম কমাতেও হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই জানতেন ঈদের পর দাম বাড়বে। এখন দাম বাড়ানোর ফলে সেই ব্যবসায়ীদের বেশ ভালো মুনাফা হবে। মধ্য দিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।’রাজধানীর বাজার চিত্র বলছে, সয়াবিনের কৃত্রিম সংকট তীব্রতর হওয়ায় খোলা সয়াবিনের লিটার ১৮৫ থেকে ১৮৭ টাকায় এবং বোতলজাত সয়াবিনের লিটার ১৯০ থেকে ২০০ টাকায় পৌঁছেছে। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে সংকট প্রকট আকার ধারণ করায় গত দুই সপ্তাহ ধরে এ দামেই বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেল। খুচরা দোকানে বোতলজাত সয়াবিন এক রকম উধাও। যেসব দোকানে পাওয়া যাচ্ছে সেখানে এ দামেই বিক্রি হচ্ছে। অথচ মার্চের নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী (৫ মের নতুন নির্ধারিত মূল্য কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত) প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৬০ টাকা এবং খোলা তেল ১৩৬ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। অর্থাৎ গত দুই সপ্তাহে বাজারে খোলা সয়াবিন ৫০-৫২ টাকা এবং বোতলজাত তেল ৩০-৪০ টাকা বাড়তি দামে বিক্রি হয়েছে। খোলা ও বোতলজাত তেল মিলিয়ে এ সময় রান্নার সয়াবিনের পেছনে ভোক্তার লিটারপ্রতি বাড়তি খরচ করতে হয়েছে গড়ে ৪৩ টাকা।ট্যারিফ কমিশনের তথ্যানুসারে, দেশে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে, যার ৯০ শতাংশই পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। এ হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার ৪৭৯ টন (৪৯ লাখ ৩১ হাজার ৫০৭ লিটার) তেলের চাহিদা রয়েছে। প্রতিলিটারে ৪৩ টাকা বাড়তি দাম হিসেবে দৈনিক ২১ কোটি ২০ লাখ ৫৪ হাজার ৮০১ টাকা বাড়তি মুনাফা করছেন ব্যবসায়ীরা। প্রকৃত চাহিদার হিসাবে মুনাফার এ পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে।বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায় ঈদের পর গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য সচিবের সঙ্গে বৈঠক করে দেশের বাজারে নতুন করে সয়াবিনের দাম বাড়ায় ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। এর আগে চলতি বছরের মার্চে প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৬০ টাকা এবং খোলা সয়াবিনের দাম ১৩৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দামে উত্থান দেখা দিলেই দেশের বাজারেও আমদানিনির্ভর পণ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়, কিন্তু একশ্রেণির সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ী সেটিকে পুঁজি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অল্প সময়ে অতিরিক্ত মুনাফা করার চেষ্টা করে বলে জানান বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের এমন প্রবণতা প্রায়ই দেখা যায়। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি চাহিদা, আমদানি ও সরবরাহের দিকে অবশ্যই কড়া নজর রাখতে হবে। তেলের বাজারে একক আধিপত্যও কমাতে হবে।তিনি আরও বলেন, ‘ভোজ্যতেলের ব্যাপারে দেখছি- কয়েকটি বড় বড় সাপ্লাইয়ার এটাকে নিয়ন্ত্রণ করে। অনেক সময় আন্তর্জাতিক বাজারে যে মাত্রায় দাম বাড়ছে, দেশীয় বাজারে দাম বাড়ার মাত্রার সঙ্গে যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনার একটা সমস্যা আছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।’ভোজ্যতেলের বাজারে এমন অস্থিরতা হঠাৎ শুরু হয়নি। শুরুটা হয় ২০২০ সালের শেষ দিয়ে। করোনার প্রকোপে বিশ্ববাজারের পাশাপাশি দেশীয় নিত্যপণ্যের বাজারেও অস্থিরতা দেখা দেয়। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বৈশ্বিক পণ্যবাজারে আরও উত্থান ঘটায়।উল্লেখ্য, বিশ্বে সূর্যমুখী তেলের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ জোগান দেয় এ দুটি দেশ। সূর্যমুখী তেলের সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় চাপ পড়ে প্রধান দুটি ভোজ্যতেল পাম ও সয়াবিনের ওপর। অন্যদিকে গত এপিলের শেষ দিকে ইন্দোনেশিয়া সয়াবিনের কাঁচামাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় এ চাপ আরও বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া আর্জেন্টিনাও রপ্তানি সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে। এতে বাজারে অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়।গত বৃহস্পতিবার সয়াবিনের দাম বাড়াতে বাণিজ্য সচিবের সঙ্গে মিলমালিকরা বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষে ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন এক বিজ্ঞপ্তিতে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, গতকাল থেকে বোতলজাত প্রতিলিটার সয়াবিন তেল খুচরা পর্যায়ে ১৯৮ টাকা এবং খোলা সয়াবিন তেল প্রতিলিটার ১৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ৫ লিটারের বোতলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৮৫ টাকা।দাম বাড়ানোয় আগামী সোমবারের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু এরই মধ্যে হাত সাফাই করে নিয়েছেন সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা। ভোক্তার পকেট কেটে অল্প সময়ে অতিরিক্ত মুনাফা করে নিয়েছেন তারা।রাজধানীর বাসাবো ছায়াবীথি এলাকার বাসিন্দা মো. নজরুল ইসলাম ফরিদ আক্ষেপ করে বলেন, ‘তেলের দাম বাড়ানোয় মানুষের যে কষ্ট হচ্ছে, তার চেয়েও বেশি কষ্ট হচ্ছে বাজারে তেল কিনতে গিয়ে। আমরা ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি। এখন বাজার স্বাভাবিক হলেও সাধারণ মানুষের পকেট কাটা হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীদের যা লাভ করার তা করে নিয়েছেন। লুকানো তেল বাজারে ছেড়ে সামনে আরেক দফা ব্যবসা করবেন চতুর ব্যবসায়ীরা।’