সময় সংবাদ রিপোর্ট:একটি মামলায় জাল-জালিয়াতির তদন্তে নেমে উচ্চ আদালতে ১৭টি মামলায় জালিয়াতির তথ্য পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এসব মামলার আসামি জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে হাইকোর্ট থেকে ইতোমধ্যে জামিন নিয়েছেন। যে পরিমাণ মাদকসহ আসামিরা গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ আছে, আসামিদের দাখিল করা জামিন আবেদনে তার চেয়ে অনেক কম উদ্ধারের তথ্য দেখানো হয়। বিষয়টি উদ্ঘাটনের পর আসামিদের জামিন বাতিল করে জালিয়াতির বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নিতে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ও অ্যাটর্নি জেনারেলকে চিঠি দিয়েছেন পুলিশের ওই তদন্ত কর্মকর্তা। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস ইতোমধ্যে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজুকে দায়িত্ব দিয়েছে।
জানতে চাইলে মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে বড় চক্র জড়িত। ১৭টি জালিয়াতির ঘটনায় ৬ আইনজীবীর নাম উল্লেখ আছে। এ ছাড়া অনলাইনে সার্চ দিলে অনেক মামলার তথ্য আসছে না। কারণ, সেকশন থেকেই হয়তো ভুয়া জামিন আদেশ চলে গেছে। ইতোমধ্যে অনেক মামলায় জামিনের মেয়াদও বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে ঢুকে সার্চ দিলে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য আসছে না। অর্থাৎ এসব তথ্য আপলোড করা হয়নি। ধারণা করছি, জালিয়াতচক্রের সদস্য হিসেবে সেকশনের কেউ কেউ সম্পৃক্ত থাকতে পারে। তিনি মনে করেন, এ ক্ষেত্রে কান টানলে মাথাও চলে আসবে। সরকারের এ আইন কর্মকর্তা বলেন, এ তো শুধু মাদক মামলার জালিয়াতির তথ্য উদ্ঘাটন হয়েছে। তদন্ত করলে দেখা যাবে জঙ্গি, হত্যা, নাশকতাসহ অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রেও এ ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। তাই আমি মনে করি, অপ্রত্যাশিত জামিন মনে হলেই প্রসিকিউশনের আইনজীবীর, সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তার ও বিচারকের তা খতিয়ে দেখা উচিত। তা হলেই কেবল এসব জালিয়াতির ঘটনা ধরা সম্ভব হবে। জালিয়াতি ধরা পড়া মামলাগুলোর বিষয়ে শিগগিরই আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, গত বছরের ১৪ এপ্রিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিণ বিভাগের) কোতোয়ালি জোনাল টিম সদস্যরা অভিযান চালিয়ে চানখাঁরপুলের নাজিমউদ্দিন রোডের একটি বাড়ির ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে ৮১টি জাল সিল উদ্ধার করে। এসব সিলের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগের গোল সিল, সহকারী রেজিস্ট্রারের সিল, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের সিল, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা আদালতের সিল, বিভিন্ন কারাগারের ডেপুটি জেলারদের সিল এবং জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে অপরাধীদের জামিনে বের করার তথ্যসংবলিত মামলার কাগজপত্রও ছিল। এ ঘটনায় ওই বাসার ভাড়াটিয়া খুলনার রূপসা থানার দুর্জনীমহলের বাসিন্দা বনি আমিন মোল্লা (৪৯) এবং সাতক্ষীরা কলারোয়ার তুলসীডাঙ্গার বাসিন্দা হাইকোর্টের আইনজীবী (আইডি নং-৪ হাজার ২১৩) অ্যাডভোকেট মো. আ. সামাদকে গ্রেপ্তার করেন কোতোয়ালি জোনাল টিমের এসআই মো. মামুন হাসান এবং বাদী হয়ে বংশাল থানায় একটি মামলা করেন। পরবর্তী সময়ে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (দক্ষিণ বিভাগের) কোতোয়ালি জোনাল টিমের পুলিশ পরিদর্শক মো. আলমগীর হোসেন পাটোয়ারী। আসামিদের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত মামলাবিষয়ক কাগজপত্রের তদন্তে নামেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের অনুমতি নিয়ে বেশ কিছু মামলার জামিনের আবেদন, এজাহার, জব্দ তালিকা ও আদেশনামা পর্যালোচনা করেন। এতে তিনি দেখতে পান, জালিয়াতচক্রের সদস্যরা ভুয়া তথ্য দাখিল করে আসামিদের কারামুক্ত করেছেন। হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার জেনারেল ও অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর ওই তদন্ত কর্মকর্তার পাঠানো চিঠিতে এমন ১৭টি মামলার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এসব মামলায় ভয়ঙ্কর জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করেছেন তিনি।
জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, গ্রেপ্তারকৃত দুই আসামির কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী হাইকোর্টের বেশ কিছু মামলার তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করি। ১৭টি মামলায় আসামিরা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন পর্যালোচনায় এমন তথ্য-প্রমাণ মিলেছে। এসব জাল-জালিয়াতির সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃত দুই আসামির যোগসাজশ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার চার্জশিটে এসব জালিয়াতির বিষয় উল্লেখ থাকবে। এ ছাড়া নতুন করে যে ১৭টি মামলায় জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে, সেগুলোয় আসামিদের জামিন বাতিল করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ও অ্যাটর্নি জেনারেলকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জালিয়াতি ধরা পড়া ১৭টি মামলার প্রত্যেকটিই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের। সব মামলাতেই জব্দকৃত মাদকের পরিমাণ অনেক কম দেখিয়ে আসামিরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। চিঠিতে উল্লিখিত তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালের ২২ আগস্ট ৬ হাজার পিস ইয়াবা বড়িসহ হাতেনাতে ধরা পড়েন টেকনাফ মৌলভীপাড়ার মো. হাসান। এ ঘটনায় রাজধানীর সবুজবাগ থানায় মামলা (নং ৩১) হয়। পরবর্তী সময়ে হাসান ১৮০ পিস ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে দেখিয়ে হাইকোর্ট থেকে ক্রিমিনাল মিসকেস (কেস নং ৮৩৮৭/২০১৭) করে গত বছরের ৫ মার্চ জামিন নেন। চট্টগ্রামের জোরারগঞ্জ থানার মামলা নং ৪০। ২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট মামলাটি দায়ের হয়। মামলার এজাহারনামীয় আসামি মো. স্বপন ৪ হাজার পিস ইয়াবাসহ হাতেনাতে ধরা পড়েন। গত বছরের ২ এপ্রিল স্বপন ক্রিমিনাল মিসকেস (কেস নং ১৩১৯৯/২০১৭) দায়ের করে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেন। জামিন আবেদনে আসামির কাছ থেকে ২০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার দেখানো হয়। রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানায় ২০১৫ সালের ৬ আগস্ট হেরোইন উদ্ধারের একটি মামলা (নং ৩) হয়। মামলার আসামি গোদাগাড়ীর সরংপুরের মো. তাজুল ইসলামের কাছ থেকে ৩ কেজি এবং অপর আসামি রেজাউল করিমের কাছ থেকে ২০০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করা হয়। কিন্তু তাজুল ইসলামের পক্ষে হাইকোর্টে ক্রিমিনাল মিসকেস ১৪৩৪৩/১৭ দায়ের করে জামিন চাওয়া হয়। জামিন আবেদনে তাজুলের কাছ থেকে ২০০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার দেখানো হয়। গত বছরের ১৩ মার্চ হাইকোর্ট তাকে জামিন দেন। কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার মামলা নং ৩৯ (০১) ১৭-এর আসামি কুমিল্লার কোতোয়ালি থানার সতরা মুন্সীবাড়ীর সামছুর রহমান। তার কাছ থেকে এক হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার হলেও হাইকোর্টে দায়ের করা জামিনের আবেদনে ৪০ পিসের তথ্য দেওয়া হয়। এ জাল তথ্যসংবলিত ক্রিমিনাল মিসকেস নং ১৩৮০৬/১৭-এর মাধ্যমে গত বছরের ৩ এপ্রিল হাইকোর্ট থেকে জামিন নেন তাজুল। এমন ১৭টি মামলার তথ্য তুলে ধরেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। এসব জালিয়াতির বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার মো. গোলাম রব্বানী বলেন, সবগুলো ঘটনা আগেই ঘটে গেছে। তদন্ত কর্মকর্তা যাচাই-বাছাই করে চিঠি দিয়েছেন। এখন প্রত্যেকটি ঘটনায় রেজিস্ট্রার অফিসের পক্ষ থেকে মামলা হবে। আমরা আইনগত পদক্ষেপ নেব।