সময় সংবাদ রিপোর্ট : চোরাই পথে আসা স্বর্ণ ধরা পড়ে বিমানবন্দর, স্থলবন্দর, নৌবন্দরে। এ ছাড়াও বন্দর ইমিগ্রেশনকে ফাঁকি দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়া স্বর্ণও ধরা পড়ে কখনো কখনো। গোয়েন্দা পুলিশ ধরে গোপন খবরের ভিত্তিতে। শুষ্ক গোয়েন্দা, গোয়েন্দা পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসারসহ বিভিন্ন সংস্থায় স্বর্ণ ধরে। আর জব্দ কিংবা আটক হওয়া এসব স্বর্ণ জমা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। গত সাড়ে ১৪ বছর ধরে সোনা নিলাম না হওয়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সোনার স্তূপ জমে গেছে।
সর্বশেষ নিলাম হয় ২০০৮ সালের ২৩ জুলাই। ধরা পড়া স্বর্ণের বেশির ভাগই আন্তর্জাতিক মানসম্মত হওয়ায় তা বাইরে বিক্রির প্রয়োজন হয়নি। স্বর্ণ চোরাচালান বাড়লেও দীর্ঘ সময় ধরে বিক্রির নিলাম হচ্ছে না। এতে রাজস্ব খাতে কোনো অর্থ এনবিআরের কোষাগারে জমা হয়নি। দীর্ঘ সময় পর রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্থায়ী খাতে জমাকৃত স্বর্ণ ও স্বর্ণাঙ্কার নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঢাকা কাস্টমস হাউসের ৪৭১ ভিজিআরের আওতায় বুলিয়ান ভল্টে জমা করা ২৫ কেজি ৩১২ গ্রাম ১০০ মিলিগ্রাম স্বর্ণ বিক্রি করা হবে। এজন্য দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কমিটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালককে সভাপতি করা হয়েছে। সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের (নির্বাহী পরিচালক) কারেন্সি অফিসার, ডিপার্টমেন্ট অব কারেন্সি ম্যানেজমেন্টের পরিচালক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রতিনিধিকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ইস্যু বিভাগের পরিচালক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়, এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি মনোনয়ের জন্য চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জানা গেছে, দেশে বছরে স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে প্রায় ২০ থেকে ৪০ টন। বাণিজ্যিকভাবে স্বর্ণ আমদানির সুযোগ দেওয়ার পরও অবৈধভাবেই দেশে স্বর্ণ আসছে বেশি। কাস্টমস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়া স্বর্ণের বার, গয়না ও মূল্যবান ধাতু আদালতের নির্দেশে মামলার আলামত হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে অস্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তা অস্থায়ী খাতেই জমা রাখা হয় এবং মামলা নিষ্পত্তি শেষে আদালতের আদেশে এর ভাগ্য নির্ধারণ হয়। অর্থাৎ মামলার রায় দাবিদারের পক্ষে গেলে তা পাওনাদারকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আর যদি দাবিদার খুঁজে না পাওয়া যায়, সেটি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়। এর মাধ্যমে ওই স্বর্ণ স্থায়ী খাতে নেওয়া হয় এবং নিলামের মাধ্যমে আর্থিক মূল্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়। এ ছাড়া স্থায়ী খাতে নেওয়া স্বর্ণের মান আন্তর্জাতিক মানের হলে সেটি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকই কিনে নেয়।
জানা গেছে, এ পর্যন্ত ৭ বার নিলামের মাধ্যমে স্বর্ণালংকার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ ২০০৮ সালের ৩০ জুন নিলামের মাধ্যমে একই বছরের ২৩ জুলাই ২১ কেজি ৮১২ গ্রাম বিভিন্ন ধরনের স্বর্ণালংকার বিক্রি করা হয়, যার আর্থিক মূল্য ছিল ৩ কোটি ৫২ লাখ ২৮ হাজার টাকা। বর্তমানে নিলামের মাধ্যমে বিক্রয়যোগ্য স্বর্ণালংকার আছে ৩৮ কেজি ৩৩২ গ্রাম। জানা যায়, স্থায়ী খাতে নেওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে স্বর্ণ পরীক্ষা করা, ওজন করা এবং এর হিসাব নিয়মিত লেজারে সংরক্ষণ করার দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কাজে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খরচ ছাড়া কোনো লাভ নেই। কারণ মামলা নিষ্পত্তি শেষে ওই স্বর্ণের আর্থিক মূল্য কাস্টমসের হাতে তুলে দেওয়া হয়, যা তাদের কমিশন আয় খাতে দেখানো হয়। পরবর্তী সময় সেটা কাস্টমসের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা হয়।
যেভাবে ভল্টে নেওয়া হয় জব্দকৃত স্বর্ণ
সাধারণত কাস্টমস, শুল্ক গোয়েন্দা বা অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা স্বর্ণ আটক করে। আর স্বর্ণ আটকের পর আইন অনুযায়ী নিকটস্থ কাস্টমস গুদামে স্বর্ণগুলো জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। এজন্য কোনো সংস্থা স্বর্ণ আটক করার পর বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি কর্তৃক সার্টিফিকেটধারী স্বর্ণকারের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিতে হয়। আটককৃত স্বর্ণ পাকা বা খাঁটি কিনা সেটা নিশ্চিত হতেই এই বিধান। সার্টিফিকেট ও আটক প্রতিবেদনসহ নিকটস্থ কাস্টমসের মূল্যবান শুল্ক গুদামে সাময়িকভাবে জমা রাখতে নিয়ে যাওয়া হয় স্বর্ণগুলো। তখন কাস্টমস হাউসের গুদামের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরও একবার স্বর্ণকার ডেকে স্বর্ণগুলো যাচাই-বাছাই করে বুঝে নেন।
কাস্টমস হাউসের গুদাম কর্মকর্তা এ সময় স্বর্ণ আটককারী সংস্থাকে একটি রিসিভ বা জিআর নম্বর (গোডাউন রেজিস্টার নম্বর) দেন। আর সেই জিআর নম্বরে (রেজিস্টার নম্বরে) লেখা থাকে, কার কাছ থেকে পণ্যগুলো জমা রাখা হলো, কে জমা দিল, কত নম্বর সিরিয়ালে পণ্যটি রাখা হলো, পণ্যের বর্ণনা ও মূল্য। আর আটক প্রতিবেদনে বর্ণনাসহ গুদাম কর্মকর্তা পণ্যগুলো বুঝে পেয়েছেন বলেও উল্লেখ থাকে এ সংক্রান্ত নথিতে।
এদিকে স্বর্ণ যখন কাস্টমস গুদামে যায়, অন্যদিকে একই সঙ্গে চলতে থাকে মামলার প্রক্রিয়া। আটককৃত স্বর্ণের বিষয়ে সাধারণত দুটি মামলা দায়ের করা হয়। একটি ফৌজদারি মামলা, অপরটি কাস্টমস আইনে বিভাগীয় মামলা। ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে নিকটস্থ থানায় গিয়ে কাস্টমসের এফআইআর (ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট) ও আটক হওয়া নিয়ে তৈরি প্রতিবেদন দাখিল করে মামলা দায়ের করা হয়। তবে এসব মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই আটককৃত স্বর্ণ শুল্ক গুদাম থেকে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা রাখতে হয়। এ লক্ষ্যে কাস্টমসের গুদাম কর্মকর্তা আগেই বিভাগীয় কমিশনারের অনুমতি নেন।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে স্বর্ণ নিয়ে যাওয়ার আগে কাস্টমসের গুদাম কর্মকর্তা নিকটস্থ থানায় নিরাপত্তার জন্য পুলিশের সহায়তা চান। এরপর পুলিশের একটি ইউনিট ও কাস্টমসের একটি ইউনিট সর্বোচ্চ নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে স্বর্ণ নিয়ে যায়। আটককৃত স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়ে যেতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিয়োগকৃত চালক এবং গাড়িও রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনে ঢুকতেই রয়েছে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এরপর ভল্টে যেতেও রয়েছে পাঞ্চ কার্ড, কলাপসিবল গেট ও তিনটি ডিজিটাল ও ম্যানুয়াল নিরাপত্তা সংবলিত প্রবেশ পথ। এ নিয়ে ছয় স্তরের নিরাপত্তা পেরিয়েই ভল্টে পৌঁছা যায়। আটককৃত স্বর্ণ সে পর্যন্ত পৌঁছলেই যে তা ভল্টে রেখে দেওয়া হবে তা নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজেরও রয়েছে স্বর্ণ পরীক্ষা করার জন্য নিজস্ব নিয়োগকৃত স্বর্ণকার। যিনি প্রত্যেকটি স্বর্ণ এক এক করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রত্যেকটি স্বর্ণের ক্যারেট ও মান নির্ণয় করেন। এতেও ব্যবহার করা হয় ম্যানুয়াল ও ডিজিটাল উভয় মাধ্যম। কষ্টিপাথরে স্বর্ণের খাঁটিত্ব নিরূপণ করার প্রচলিত ধারা রয়েছে। তার সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিখুঁত মাপের ব্যবস্থাও নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আটককারী সংস্থার দাবির সঙ্গে ব্যাংকে আনা স্বর্ণের পরিমাণ ও গুনগত মান নিশ্চিত করেই স্বর্ণগুলো আলাদা আলাদা আলমারিতে রাখেন ভল্ট কর্মকর্তারা।
এ সময় ভল্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা স্বর্ণের বিবরণ লেখেন। এরপর স্বর্ণের যাবতীয় বিবরণসহ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কাস্টমস হাউসের গোডাউন কর্মকর্তাকে একটি প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়। যে প্রত্যয়নপত্রে স্বর্ণকার, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে দায়িত্বরতরা ও কাস্টমসের গুদাম কর্মকর্তাও স্বাক্ষর করেন। আর সেই প্রত্যয়নপত্রেও স্বর্ণের মান, মূল্য, পরিমাণ সব কিছু লেখা থাকে। এরপর কাস্টমস কর্মকর্তা প্রত্যয়নপত্রটি তার নথিতে লিপিবদ্ধ করেন এবং তার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বিষয়টি অবহিত করেন। কেবল যে নিরাপত্তা বেষ্টনী তা-ই নয়, ভল্টে গচ্ছিত মূল্যবান জিনিসপত্র নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট রয়েছে। যারা সার্বক্ষণিক ভল্টের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করেন। এর পাশাপাশি পুরো ভল্ট এলাকা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়েও চব্বিশ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।