সময় সংবাদ রিপোর্টঃ দেশের চলমান বন্যায় ১২ জেলার ৭৭ উপজেলার ৪৮ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলাগুলো হলো— ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার। আকস্মিক এই বন্যায় এখন পর্যন্ত দুই নারীসহ ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। বন্যাটি কতটা আকস্মিক, এর জন্য দায়ী কে?
বাংলাদেশে আমরা যেটা বলি, এল নিনো শেষ হয় কোনো একটা ডিসেম্বর মাসে। ডিসেম্বর থেকে পরের বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত এল নিনো থেকে নিরপেক্ষ অবস্থায় আসে। এবং তারপর সেটা লা লিনা-তে যায়। তো, এ বছর এল নিনোটা শেষ হয়ে গেছে এপ্রিল মাসে।
ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশে এই সময়ে বড় মানের বন্যা হয়। এই একই রকম ঘটনা ঘটেছে ১৯৮৮ সালে, ১৯৯৮ সালে। তো, এই বছরে বাংলাদেশে একটি বড় মানের বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা সেটা আমরা আবহাওয়াবিদরা অনেক আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু কথা হচ্ছে, কোন মাসে হবে সেটি নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিলো। সে ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, তাই এই বন্যাটা কোনো হঠাৎ করে বন্যা নয়। তবে মাত্রাটা অনেক বেশি হয়েছে।
তো, দুর্ভাগ্যক্রমে ভারী বৃষ্টিপাত ঘটায় এরকম চারটি ফ্যাক্টর একইসঙ্গে বাংলাদেশের ওপরে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। ঠিক এই চারটি ফ্যাক্টর একইভাবে কাজ করার জন্য রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয় ফেনী, কুমিল্লা এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ওপরে। সেটার কারণে এত বড় বন্যা। এটি আমি একাধিক পত্রিকায় বলেছি, চারটি ফ্যাক্টর এই বন্যার জন্য দায়ী।
একটা হচ্ছে, বাংলাদেশের ওপর একটি লঘুচাপ যেটাকে সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের ছোট ভাই বলা হয়। এই লঘুচাপটি বাংলাদেশের ওপর অস্বাভাবিকভাবে অবস্থান করছিল। প্রায় সাতদিন ধরে। সাধারণত একটি লঘুচাপ বাংলাদেশের ওপর অবস্থান করে গড়ে দুই দিন। এটি বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশের স্থলভাগে প্রবেশ করে পশ্চিম দিকে পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে ভারতের মধ্যভাগে চলে যায়। অথবা এটি বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা দিয়ে প্রবেশ করে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে ত্রিপুরা এবং মেঘালয় রাজ্যের ওপর দিয়ে ভারতের আসামের দিকে চলে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই লঘুচাপটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে আগস্ট মাসের ১৬ তারিখে এবং এটি ২২ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্থলভাগের ওপর অবস্থান করে। এই দীর্ঘ অবস্থানের কারণে প্রতিনিয়ত বৃষ্টিপাতটা ঘটায়।
পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?
পরিস্থিতি আসলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ২২ আগস্ট দুপুর তিনটার পর থেকে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বিভাগের ওপরে এবং ত্রিপুরার ওপরে। চট্টগ্রাম বিভাগের ওপরে এবং ত্রিপুরার ওপরে কোনো বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। আশা করা যাচ্ছে যে, এই বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে গেছে সেটি একটি সুসংবাদ। তবে, কিছুটা দুঃসংবাদ সেটি হচ্ছে, ত্রিপুরার রাজ্যের ওপর থেকে যে নদ-নদীর পানি নেমে যাচ্ছে। এটি আজকে শুক্রবার ফেনী এবং কুমিল্লার ভাটি অঞ্চলের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, শুক্রবার রাত পর্যন্ত এটি বৃদ্ধি পেতে পারে।
আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল নির্দেশ করছে, আগামী ২৪ ঘণ্টা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা খুবই কম। তো, সেক্ষেত্রে শনিবার থেকে ধীরে ধীরে বৃষ্টির পানি বা বন্যার পানি কমতে শুরু করবে। বিশেষ করে উজানের যে উপজেলাগুলোর নদীর পানি দ্রুত নেমে যাওয়া শুরু করবে। আর ভাটির উপজেলাগুলোর নদীর পানি নেমে যাওয়ার জন্য আমাদের রবিবার বা সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশের নদীগুলোর অনেক নাব্যতা কমে গেছে। এ কারণেই বৃষ্টি বা বন্যার পানি নেমে যেতে কিছুটা সময় লাগবে। আশা করা যায় রবিবার বা সোমবারের পর থেকে আশ্রয় শিবিরে থাকা কিছু মানুষ তাদের বাড়িতে ফেরা শুরু করতে পারবে।
এর জন্য দায়ী কে?
এখন বর্ষাকাল। এসময় ভারতীয় উপমহাদেশে ভারী বৃষ্টিপাত হয়। বন্যা হয়। এটি আসলে এককভাবে কেউ দায়ী নয়। এটির জন্য অনেকাংশে প্রকৃতি দায়ী। প্রথমত, যেহেতু খুব ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। ১৯, ২০, ২১ আগস্ট। এই তিন দিন মিলে কুমিল্লা, ফেনী এবং ত্রিপুরা রাজ্যে গড়ে ৪৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। ত্রিপুরার একটি রাজ্যে ৪৯০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, ফেনীতে ৪৪৭ মিলিমিটার এবং কুমিল্লায় ৪০৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। বুঝতে পারছি, তিন দিনের মধ্যে এই পরিমাণ বৃষ্টি একটি রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি। ত্রিপুরা কুমিল্লা এবং ফেনীর একেবারে কাছাকাছি স্থান। ত্রিপুরা পাহাড়ি এলাকা। সেখানে বৃষ্টিপাত দ্রুত নেমে গেছে। তো, এ কারণে বলব, মূলত বন্যার জন্য শতকরা ৯০ ভাগই প্রকৃতি দায়ী। এই ভারী বৃষ্টিপাতটাই। আর দশ শতাংশ বলতে পারি, কিছুটা ত্রিপুরা রাজ্যের যে জলাধারগুলো, বা হাইড্রোলিক ড্যাম বা কৃষিকাজের জন্য যেখানে পানি সংরক্ষণ করে রাখা হয় সেই ড্যামগুলোর ভূমিকা আছে। ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে সেই ড্যামগুলোর সব দরজা খুলে দিতে হয়েছে এবং সেখান থেকে হঠাৎ করে বেশি পরিমাণ পানি নিচে নেমে গেছে। সেক্ষেত্রে গোমতি বা অন্যান্য নদীগুলো অনেক ভরাট হয়ে গেছে। বেশিরভাগ দায়ী হচ্ছে প্রকৃতি আর মানবসৃষ্ট কারণ ভারতের ত্রিপুরা বাঁধের পানি ছেড়ে দিয়েছে। আরেকটা জিনিস সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশের নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। এ কারণে বৃষ্টির পানি খুব দ্রুত নেমে যেতে পারেনি। এটিও একটি দায়ী।
বাংলাদেশ কেন প্রস্তুতি নিতে পারল না?
বাংলাদেশের প্রস্তুতি বলতে আমরা যেটা বলি, আবহাওয়ার পূর্বাভাস। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এই ভারী বৃষ্টি ও বন্যার পূর্বাভাস দিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। জানি না তারা কেন ব্যর্থ হলো। কারণ, এটি হঠাৎ কোনো ঘটনা নয়। আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেলগুলো যে পূর্বাভাস দিচ্ছিল এবং আমরা জানি, যে চারটি ফ্যাক্টরই কমপক্ষে ১৫ দিন পূর্ব হতে জানা ছিল। এরপরও কেন তারা পূর্বাভাসটি সঠিকভাবে দিতে পারল না বা পৌঁছাতে পারল না মানুষের কাছে।
আমরা হয়ত ভারী বৃষ্টি বন্ধ করতে পারতাম না, বন্যাটাও বন্ধ করতে পারতাম না। কিন্তু আমরা যেটা পারতাম, এই নদীর উপকূলে বসবাস করা মানুষগুলোকে যথেষ্ট পূর্ব থেকে বলা সম্ভব হতো। তাহলে তাদের সহায়-সম্পত্তির যে ক্ষতি হলো- সেটি হতো না। এরইমধ্যে অনেক প্রাণহানি বা মৃতর সংখ্যা বাড়ছে। সেটি হয়ত অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। যদি পূর্ব থেকে এই পূর্বাভাস তথ্য ফেনী ও কুমিল্লা জেলার মানুষদের জানানো সম্ভব হতো। তারা (আবহাওয়া অধিদপ্তর) বলতে পারবে তাদের আসলে কোন
এমন পরিস্থিতি আর কয়দিন থাকবে?
আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেলগুলো বলছে, আগামী দুই-তিন দিন বিশেষ করে চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলো এবং ত্রিপুরা রাজ্যে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা খুবই কম। সেক্ষেত্রে এই বন্যা পরিস্থিতি দ্রুত উন্নত হতে থাকবে। আশা করছি, সোমবার বা মঙ্গলবারের পর থেকে মোটামুটি বন্যার পানি বেশিরভাগই নেমে যাবে। আর আগামী সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমের নিয়মিত বৃষ্টিপাত সেটি হতে থাকবে দেশের বিভিন্ন জেলায়। সেটি নিয়ে আসলে বন্যার কোনো ঝুঁকি দেখা যাচ্ছে না আপাতত।
না জানিয়ে ড্যাম বা ব্যারাজ খুলে দিলে অসুবিধা কী?
আসলে একটা ড্যামে অনেক পরিমাণ পানি সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। এখন এটি যদি হঠাৎ করে খুলে দেই তাহলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে পানি নিচে নেমে আসবে। যেহেতু পাহাড়ি এলাকা, বাঁধগুলো সাধারণত উঁচু এলাকায় নির্মিত হয়। বাঁধের দরজা খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি উচ্চগতিতে নিচের দিকে প্রবাহিত হতে থাকবে এবং তার চলার পথে সবকিছু ভেঙেচুরে এগিয়ে নিয়ে যাবে সামনের দিকে। যে কারণে ভাটির দেশের মানুষকে সতর্কতা না দিয়ে হঠাৎ করে কোনো ড্যামগুলো খুলে দেওয়া হলে সব জায়গায় ক্ষতি হতে পারে। ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে কিছু মানুষ মারা গেছে। তাদের চেয়ে বেশি মানুষ মারা যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বাংলাদেশে। যদিও আমরা জানি না ঠিক কতজন মানুষ মারা গেছে। কিন্তু আমরা ধীরে ধীরে জানতে পারছি যে, মৃতের সংখ্যা বাড়ছে।
এক্ষেত্রে আসলে যৌথ নদী কমিশনের কাজ কি?
যৌথ নদী কমিশন আছে কিন্তু সেটি যদি কোনো কাজে না লাগে। সেটি আসলে অর্থহীন। একটি প্রবাদ আছে, পুঁথিগত বিদ্যা পরহস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন, হলে প্রয়োজন। আসলে এই পুঁথিগত বিদ্যার মতোই হয়েছে আমাদের যৌথ নদী কমিশন। যৌথ নদী কমিশন আসলে কতটা ইফেক্টিভ। কানাডা এবং আমেরিকার মধ্যে একটি জয়েন্ট রিভার কমিশন আছে। বিশেষ করে কানাডার যে গ্রেট লেকস- এই লেকগুলো আসলে কানাডার বর্ডার। তাদের নিয়মিত মিটিং হয়। এই লেকগুলোর পানির গুণগত মান-দূষণ। লেকগুলোর তীরে গড়ে উঠা শিল্প-কারখানার বর্জ্য পদার্থ সেখানে পড়ছে কি না এটা হোক কানাডার সাইডে বা আমেরিকার সাইডে। তারা ঠিক একই রকমের কোয়ালিটি মেইনটেন করে। একটা উজানের দেশ আরেকটা ভাটির দেশ। ঠিক আন্তর্জাতিক পানির আইন আছে, যেটি যে নদী একাধিক দেশের ওপর প্রবাহিত হয় সে নদীর ওপর কোনো দেশ এককভাবে বাঁধ দিতে পারে না। কীভাবে বাঁধ দেওয়া যায় তারও একটা আইন আছে। এতে বলা আছে, কত পার্সেন্ট পানি তারা ধরে রাখতে পারবে এবং ভাটির দেশের মানুষদের জন্য কত পার্সেন্ট পানি ছেড়ে দিতে বাধ্য।
নদীর একটা নিজস্ব বাস্তুসংস্থান আছে বা পরিবেশ। নদীর মাধ্যে বিভিন্ন জীবজন্তু বাস করে। আন্তর্জাতিকভাবে ওদেরকে প্রটেক্ট করে। ইকোলজিক্যাল ডাইভার্সিটি সেটি কনজার্ভ করার জন্য বা সংরক্ষণের জন্য। একটা নদীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি ছেড়ে দিতে হবে। ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী আছে, যেটা ভারতের মধ্যে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত হয়। সেক্ষেত্রে একটি, যৌথ নদী কমিশন একটা নামকাওয়াস্তে একটা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের পিএইচডির বিষয় ছিল নদী। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক নদীগুলো একাধিক দেশ শেয়ার করে তার ওপর পিএইচডি গবেষণা। আশা করব, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এবং তার নেতৃত্বে যৌথ নদী কমিশনকে সচল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবেন। এবং আন্তর্জাতিক যে নদীগুলো আছে তার পানি প্রবাহ ও অন্যান্য তথ্য বিনা বাঁধায় এক দেশ অন্য দেশের কাছে শেয়ার করবে। আশা করছি, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার খুব দ্রুত ভাতরের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন এবং যৌথ নদী কমিশনকে কিভাবে কার্যকারি করা যায় সেটি ভেবে দেখবেন।