Header Border

ঢাকা, রবিবার, ১৫ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১লা আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ (বর্ষাকাল) ২৭.০৫°সে
শিরোনাম

খিলগাঁও ও মেরাদিয়ার বুধবারের হাট নিয়ে কিছু স্মৃতি-আলমগীর পারভেজ

সম্পাদকীয় কলামঃ আমার জন্ম ঢাকা শহরের খিলগাঁও এলাকায়। ছোটবেলা থেকে এই এলাকার আকাশ বাতাসে বড় হয়েছি। আশির দশকে সিপাহীবাগ ও মেরাদিয়া এলাকা ছিল মাটির কাঁচা রাস্তা। প্রায় প্রতিদিনই এলাকায় কাদা ছোড়াছুড়ি করলাম। কাদামাটি দিয়ে ঘর বানাতাম, পুতুল বানাতাম, কাদামাটি দিয়ে পেয়ালা তৈরি করে ফোটাতাম আরো কতকিছু।
সিপাহীবাগ এলাকার বর্তমান মদন গলি এলাকায় ছিল বিশাল খেলার মাঠ। পাশে ছিল তালেব আলীর ঝিল। মদনগলি কাজী বাড়ির পাশে এই ঝিল সবাই তালুর ঝিল বলতো। খেলার সময় বল পড়ে যেত তালুর ঝিলে । আমাদের মত ছোট ছোট ছেলে ছিল সরাসরি ঝিলে নেমে বল নিয়ে আসতো।
১৯৮৫-৮৬ সালের কথা বলছি। বিকেলে নবীনবাগ ও ভুইয়াপাড়া এলাকায় ফুটবল খেলতে যেতাম। বিশাল মাঠ ছিল। মদন গলির পর থেকে আশেপাশে এলাকায় বিশাল ক্ষেত ছিল। ধানক্ষেত, টমেটো, শালগম, ফুলকপি, বাঁধাকপি ক্ষেতের সমারাহ ছিল এই এলাকায়। ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে ছিল আইল। ক্ষেতের আইল দিয়ে ধীরে ধীরে ১৫-২০ মিনিট হেঁটে যাওয়ার পর আমরা খেলার মাঠে পৌছতাম। বিকেলে খেলার মাঠে যাওয়ার সময় প্রতিদিন টমেটো ও শালগোম খেতাম। কখনো আমাদেরকে কোন টমেটো কিংবা শালগোম চাষিরা ধমক পর্যন্ত দেয় নাই।
মেরাদিয়ার ঐতিহ্যবাহী বড় বাড়ি এলাকায় ছিল খেলার মাঠ। সে খেলার মাঠে আমরা খেলতে যেতাম। কবরস্থানের পাশে একটি মাঠ ছিল। সেই মাঠে প্রায় সময় ফুটবল টুর্নামেন্ট হতো। ঢাকার প্রথম শ্রেণীর ফুটবল খেলোয়াড়রা সেখানে টুর্নামেন্ট খেলতে আসতো। আমরা ছোটরা খেলা দেখতাম। বাসাবো ক্লাবের জিদ্দি ভাই খুব ভালো খেলতো। উনি ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের খেলোয়াড় ছিল। তাছাড়া ভিক্টোরিয়া ক্লাবের কাজল ভাই, গোলকিপার টুলু ভাই, পামির ভাইসহ অনেকে খেলাধুলা করত।
সকলের খেলা দেখে খুব মুগ্ধ হতাম। আমি ছিলাম স্ট্রাইকার। কাজল ভাইয়ের টিমে যুব কল্যাণ সংসদের পক্ষ থেকে কিশোর ফুটবল লীগ, তিলপাপাড়া বক্সার মহি ও ফারুক ভাইয়ের ক্লাবে বিভিন্ন ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করতাম। গুলবাগ লিটন ভাইয়ের টিমে খেলাধুলা করেছি। উনারা সকলে আমাকে পছন্দ করত। সেই সুবাদে এরশাদ কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলার সুযোগ হয়েছিল।
এদিকে প্রতি বুধবার ছিল আমাদের জন্য একটি বিশেষ আনন্দের দিন। আমরা ঐতিহ্যবাহী মেরাদিয়া বুধবারে হাটে যেতাম। গ্রামের মিষ্টি, মুড়ালি- নিমকি- খাওয়া আর বায়োস্কোপ দেখার জন্য আমাদের উৎসাহ উদ্দিপনা খুব বেশি ছিল। বর্ষাকালে চতুর্দিকে পানি থৈ থৈ তার মাঝখানে হাট। শহরে বসবাস করে গ্রামের আনন্দটা আমরা পেতাম এই ঐতিহ্যবাহী মেরাদিয়া হাট থেকে।
এই ঐতিহ্যবাহী হাটে শীতকালে যাত্রাপালা হতো।আমরা সে যাত্রাপালাতে এসে রহিম -রুপবান সহ আরো অনেক যাত্রা দেখেছি। আমাদের পাশে টিপু- নিপু ভাইয়ের বাবা ছিলেন। উনি টোকিও দেখার আয়োজন করতেন। আমরা ছুটির ঘন্টা ছবি দেখেছিলাম।
মেরাদিয়া হাটে একটা বিশাল বটগাছ ছিল। সেই সময় অনেকে বলাবলি করত এই বট গাছে জ্বীনের বসবাস। সন্ধ্যার পর এই গাছ ডাকাডাকি করে। আমরা দশ বারো জন মিলে প্রায় সময় সন্ধ্যার পরে টর্চ লাইট নিয়ে গাছের দিকে লাইট মারতাম। খোলা জায়গায় হওয়ার ফলে সব সময় প্রচন্ড বাতাস থাকতো। রাতের প্রচন্ড বাতাসে বটগাছ নড়াচড়া করলে আমরা দৌড় দিয়ে চলে আসতাম।
একদিন সবাই দৌড় দিতে দিতে চলে আসলাম হিন্দু বাড়ির শ্মশান ঘাটে। মেরাদিয়া হাটে যাওয়ার সময় হাতের বাম পাশে ছিল হিন্দু বাড়ি। শ্মশান ঘাটে যেয়ে দেখি একজনকে পোড়াবে, কিছু দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে গেলাম।সেদিন রাতে ভয়ে বাসায় ঘুমাতে পারি নাই। প্রতিবছর শারদীয় দুর্গাপূজায় আমরা সকলে যেতাম হিন্দু বাড়িতে। একসাথে কত আনন্দ ফুর্তি করেছিলাম সেদিন। সবচেয়ে বেশি আপ্যায়ন করতো কিশোর প্রদীপের “মা”। খালাম্মা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। পূজার সময় নাড়ু খেতাম। কত নাচানাচি করেছি হিন্দু বাড়িতে। আমাদের সাথে এক বন্ধু পড়াশোনা করতো ওর নাম ঠাকুর। ঠাকুরের দাওয়াতেও হিন্দু বাড়িতে আমরা যেতাম।
মেরাদিয়া হাটে ছিল সরকারি হাসপাতাল। সেই সময়কার বিখ্যাত ডাক্তার মোতালেব সাহেব একটি কমিউনিটি হাসপাতাল করেছিলেন। সে সময় মেরাদিয়া,বাঘাপুর,নন্দীপাড়া,ফকিরখালী, কায়েত পাড়া ও ত্রিমহনী এলাকায় কৃমির প্রাদুর্ভাব খুব বেশি ছিল। তৎকালীন ওই এলাকার চেয়ারম্যান মুনসুর চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় নেদারল্যান্ড ও সুইডেনের অ্যাম্বাসেডার উপস্থিত হয়ে হাসপাতালটির উদ্বোধন করেন এবং এই দুই দেশের অনুদানে হাসপাতালটি পরিচালিত হতো। আশির দশকে আমাদের এই অঞ্চলের দুজন প্রভাবশালী চেয়ারম্যান ছিলেন এবং এই দুজনেই অত্যন্ত সৎ এবং যোগ্য ছিলেন। মুনসুর চেয়ারম্যান ও এমরান চেয়ারম্যান। উনাদের শাসন এবং বিচার ব্যবস্থা এই অঞ্চলের মানুষের কাছে সারা জীবন ইতিহাস হয়ে থাকবে।
মেরাদিয়া গরুর হাট শুরু হওয়ার পর সমগ্র খিলগাঁও
সবুজবাগ থানা,মুগদা থানা (তৎকালীন সময়ে মতিঝিল থানার অধীনে ছিল) এলাকাবাসীর মনে স্বস্তি ফিরে এসেছিল। কারণ সকলের কোরবানি গরুর জন্য যেতে হতো গাবতলী হাটে। আমরা যারা ধর্মপ্রাণ মুসলমান আমাদের জন্য কোরবানির ঈদ অত্যন্ত পবিত্র এবং আনন্দের।
গত ১০ বছর যাবত আমার জানামতে কোরবানি হাট শেষ হওয়ার সাথে সাথে তাৎক্ষণিক সমগ্র বর্জ্য সেখান থেকে সিটি কর্পোরেশন নিয়ে যায়। কারন সিটি কর্পোরেশন বর্জ্য সরানোর জন্য হাট কর্তৃপক্ষ নিকট থেকে একটি সিকিউরিটি মানি রাখে। যদি বর্জ্য সরানো না হয় সঠিক সময়ে, তাহলে হাত কর্তৃপক্ষ এই টাকা আর পাবে না। গত বছরেও তাৎক্ষণিকভাবেই ময়লা সড়ানো হয়েছে। তাছাড়া ৩-৪ দিনের এই ঐতিহ্যবাহী হাট জনদুর্ভোগের পরিবর্তে খিলগাঁও থানা এলাকার মানুষের মনে আনন্দউচ্ছাস বেশি ছিল।
আমার জানামতে ঐতিহ্যবাহী বুধবারে হাট ও কোরবানি গরুর হাট বসতো সরকারী জায়গায়। এখন প্রশ্ন হল রামপুরা থানা, মসজিদ ও খেলার মাঠ কে অনুদান করল। সরকারি ক্লিনিকটি কোথায় গেল? সরকারি জায়গা কোথায় চলে গেল?
আমার প্রশ্ন এত বছর বন্ধ হয়নি কেন? রামপুরা থানার পাশে এই মাঠটির মালিক কে? কারা দখল করল। মাঠ করতে যেয়ে দীর্ঘদিনের সবুজায়নে ঘেরা গাছ কারা কাটলো? তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নাই কেন? বনশ্রী এলাকার ১০০টি পরিবারের জন্য হাজার হাজার মানুষের স্বপ্ন ভেঙ্গে ফেলা যাবে না। তাছাড়া কোরবানি ঈদ মুসলমানদের জন্য।
প্রতিদিন তো অবৈধভাবে রাস্তায় বাজার বসে। সে ক্ষেত্রে তো সমস্যা হয় না। সমস্যা না হওয়ার কারণ কি?
অতি দ্রুত সরকারি জায়গা উদ্ধার করে ঐতিহ্যবাহী মেরাদিয়া হাট ও কোরবানি ঈদের গরু ছাগলের হাট করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট অনুরোধ করছি।
-আলমগীর পারভেজ
বার্তা সম্পাদক
সময় সংবাদ লাইভ

আপনার মতামত লিখুন :

আরও পড়ুন

প্রকৃতি কবি দেলোয়ার হোসেনের “তুমি যেন এক অপার্থিব কাব্য”
কবি বন্ধু দেলোয়ারের ’’অপেক্ষার সীমানায়’’
ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য
ইসলাম মানবিকতা,উদারতা ও মহানুভবতার ধর্ম
রমজান সংযম শেখায়,নামাজ শেখায় কল্যাণ
উন্নত সমাজ গঠনে সামাজিক সংগঠনের বিকল্প নেই

আরও খবর