আলমগীর পারভেজ: চীন ও ভারতের পাল্টাপাল্টি অবস্থানে বিপন্ন অবস্থায় পড়েছে ভাটির দেশ বাংলাদেশ। একদিকে চীন তিব্বতে ব্রহ্মপুত্র নদের উপর ৬০ গিগাওয়াট অন্যদিকে ভারত অরুণাচলে ১০ গিগাওয়াটের পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের ঘোষণা দেয়ায় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
এদিকে ভারতের অসংখ্য প্রকল্পের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে প্রবেশের পর ব্রহ্মপুত্রের ধারা আরো সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। এর ফলে ঘটছে চরের বিপুল বিস্তার। নতুন করে চীনের প্রকল্প হলে এই পরিস্থিতি আরো ভয়ানক হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে বলে সূত্রগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন করে দুটো দেশ বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নিলে বাংলাদেশের অবস্থা যে করুণ হবে সেটি উল্লেখ করার প্রয়োজন হয় না। ভারতের সাথে বাংলাদেশের ৫৮টি আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে। এগুলো থেকে ভারত একচেটিয়া পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। গঙ্গাচুক্তি করা হলেও ভারত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে তার হিস্যা থেকে বঞ্চিত রাখে। আর তিস্তাচুক্তিরও কোনো খবর নেই।
উল্লেখ করা যেতে পারে, ব্রহ্মপুত্র নদ তিব্বতে উৎপত্তি হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। দেশের ভেতরে পদ্মার সাথে মিশে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। উৎপত্তিস্থল থেকে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার মোট দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৭৩৭ কিলোমিটার। বাংলাদেশে এর দৈর্ঘ্য ২৭৭ কি.মি। ব্রহ্মপুত্র প্রতিবছর গড়ে ৫২৭ মিলিয়ন টন পলি বহন করে। ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে বাংলাদেশ ৬৭ শতাংশ প্রবাহ পেয়ে থাকে। বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার উপনদী ও শাখা-প্রশাখার মধ্যে রয়েছে, তিস্তা, ধরলা, করতোয়া, আত্রাই, হুরাসাগর, সুবর্ণসিঁড়ি, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী, দুধকুমার, ধরিয়া, ঘাঘট, কংস, সুতলা প্রভৃতি। ব্রহ্মপুত্রে পানির টান পড়া মানে এসব নদীও বিপন্ন হয়ে পড়া। এর ফলে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হবে।
চীনের প্রকল্প
অভিযোগ উঠেছে, তিব্বতে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর বাঁধ নির্মাণ করে বিশাল পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে চীন। এতে করে পানি সংকট ও বন্যায় ভুগতে পারে ভারত। পরিকল্পনাধীন ৬০ গিগাওয়াটের এই প্রকল্পের কাজ আগামী জানুয়ারিতে চীনের পরবর্তী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যুক্ত হবে। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাঁধ চীনের ইয়াংজি নদীতে রয়েছে। তবে প্রস্তাবিত নতুন বাঁধ এটির চেয়েও অনেক বড় হবে। ইয়াংজি নদীর বাঁধে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, তার চেয়ে তিন গুণ বিদ্যুৎ এখানে উৎপাদিত হবে। গত ৩০ নভেম্বর চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস ব্রহ্মপুত্রের একটি অংশে ৬০ গিগাওয়াট পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতাসম্পন্ন প্রকল্প নির্মাণের খবরও প্রচার করে। চীনের পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশনের চেয়ারম্যান ইয়ান ঝিয়ংকে উদ্ধৃত করে তারা জানায়, ইয়ারলাং জাংবো (ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা নদী) নদীর ওপর এই যে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পটি তৈরি হচ্ছে সব অর্থেই সেটি হতে যাচ্ছে একটি ‘সুপারড্যাম’। কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান প্রস্তাবিত ব্রহ্মপুত্র বাঁধকে চীনের জন্য ‘ঐতিহাসিক সুযোগ’ হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ভারতের মতে, তাঁদের সেই ‘ঐতিহাসিক সুযোগ’ ভারতের জন্য বিধ্বংসী হয়ে উঠবে। ভারতে পতিত হওয়ার আগে ব্রহ্মপুত্র হিমালয় থেকে যতো নিচে নামছে, তা আমেরিকার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের দ্বিগুণ। এটিই এশিয়ার সবচেয়ে বড় বাধাহীন পানির উৎস। অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, এ প্রস্তাবিত বাঁধ বাস্তবায়িত হলে চীনের ভাটির অঞ্চলের দেশগুলো পানিসংকটে পড়ে যাবে।
ভারতের প্রতিক্রিয়া
ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চীনের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে তারা অরুণাচল প্রদেশে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর ১০ গিগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির পরিকল্পনা করছে। এটি চীনকে পাল্টা জবাব হিসেবে দেখছে ভারত। চীনের ঘোষণার পরই ভারতের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, চীনা প্রকল্পের ফলে দেশের একটা অংশে বন্যার সমস্যা দেখা দিতে পারে। এরই প্রেক্ষিতে ভারতের কেন্দ্রীয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে টিএস মেহরা জানান, চীনের বাঁধ নির্মাণের ফলে যে প্রভাব পড়বে তার সঙ্গে লড়াই করার জন্যই অরুণাচল প্রদেশে ব্রহ্মপুত্র নদের উপর বাঁধ বানানো প্রয়োজন। এনিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপর্যায়ে এই নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। ভারতের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, চীন বিভিন্ন নদীতে বাঁধ দিয়ে এবং কৃত্রিম জলাধার বানিয়ে পানি আটকে রাখার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এতে বিভিন্ন স্থানে পানির অভাব দেখা দেবে এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতিকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এসব প্রকল্পের মধ্যে ভারতীয়দের কাছে ব্রহ্মপুত্র নদ হিসেবে পরিচিত ইয়ারলুং জাংবো নদীতে চীন এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় বাঁধ তৈরি করছে। চীন এশিয়ার পানি মানচিত্রের ওপর প্রাধান্য ধরে রেখেছে। চীনের জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রদেশ জিনজিয়াং এবং পানিসম্পদে সমৃদ্ধ ভূখণ্ড তিব্বতের পানিকে চীন তার ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছে। ভারতের আরো দাবি, প্রস্তাবিত এই বাঁধ বাস্তবায়িত হলে চীনের ভাটির অঞ্চলের দেশগুলো পানিসংকটে পড়ে যাবে। এর আগে চীনের বাঁধের কারণে ভারতের অরুণাচল ও হিমাচল প্রদেশে আকস্মিক বন্যা হতে দেখা গেছে। এর ফল মারাত্মক হয়ে দেখা দিচ্ছে।
এদিকে এই বাঁধের কারণে শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, বাংলাদেশের স্বাদু পানির সবচেয়ে বড় উৎস এ ব্রহ্মপুত্র। কখনো এ বৃহৎ বাঁধ যদি ভেঙে যায়, তাহলে ভাটিতে বসবাসরত লাখ লাখ মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে মারা যাবে। এছাড়াও দু’টি দেশ পাল্টাপাল্টি বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে নিলে এ নদীর একেবারে ভাটিতে অবস্থিত বাংলাদেশ বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হবে।
ভারতের প্রকল্প
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে যমুনার বিপন্ন হওয়ার প্রধান কারণ এর মূল দুই নদী ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পানির প্রবাহ থেকে বঞ্চিত হওয়া। উল্লেখ্য, তিস্তা নদী থেকে ব্রহ্মপুত্র বিপুল পরিমাণে প্রবাহ লাভ করে থাকে। ফলে তিস্তার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে যমুনাতেও সংকট দেখা দেয়। ব্রহ্মপুত্র ও তার উপনদীগুলোতে ভারত অসংখ্য সেচ ও পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করেছে। এ ছাড়াও ব্রহ্মপুত্রে রয়েছে ভারতের অন্তত ২১টি সেচ প্রকল্প। এসব সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে বিশেষত আসামের বিস্তীর্ণ জমিতে পানি সেচ দেয়া হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে একটি পশ্চিমবঙ্গে এবং একটি নাগাল্যান্ডে অবস্থিত। বাকিগুলো রয়েছে আসামে। পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে করতোয়া মিডিয়াম ইরিগেশন প্রজেক্ট ও নাগাল্যান্ডে ডুজা ইরিগেশন প্রজেক্ট। ব্রহ্মপুত্রের পানি ব্যবহার করে এসব সেচ প্রকল্পের সাহায্যে হাজার হাজার একর জমিতে কৃষিকাজ চলছে। এই প্রকল্পগুলোর কারণে যমুনায় পানির প্রবাহ প্রতিনিয়ত হ্রাস পেয়ে চলেছে। এখন ভরসা কেবল বর্ষকালীন বাড়তি পানি- যা সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা বাংলাদেশের নেই। অন্যদিকে তিস্তায় প্রকল্পসমূহের জন্য বিশাল বিশাল বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ করা হচ্ছে পানি সংক্ষণের জন্য। এরফলে তিস্তার পানি ভারতের অভ্যন্তরেই থেকে যাচ্ছে। এরফলে বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে পানিবঞ্চিত হচ্ছে। তিস্তার উপরে গজলডোবা ব্যারেজ ছাড়াও উজানে আরো অসংখ্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে তারা। এই প্রকল্পগুলোতে যে পরিমাণ পানি প্রয়োজন হয় তাতে ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় যথেষ্ট পরিমাণ পানি আসার কোন সুযোগ থাকে না।