সময় সংবাদ লাইভ রিপোর্ট:করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে ২৪ মার্চ অফিস-আদালত বন্ধের ঘোষণা দেয় সরকার। ২৬ মার্চ থেকে সব গণপরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। সড়ক, রেল ও নৌ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এক মাসেরও বেশি সময় বন্ধ রাখার পর সীমিত আকারে তা চালুর কথা ভাবা হচ্ছে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ৫ মের পর সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সীমিত আকারে গণপরিবহন চালুর ঘোষণা আসতে পারে। তবে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির ওপরই নির্ভর করছে সব কিছু। সবার আগে আকাশপথ চালুর ইঙ্গিত মিলেছে।
ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলে অনুমোদনের পর প্রথমে বাস-মিনিবাস চালু হতে পারে। তবে শুরুতে আন্তঃজেলা রুটে নয়। রাজধানী ঢাকাসহ জেলা শহরে দৈনন্দিন কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে সীমিত আকারে চালুর কথা ভাবা হচ্ছে। এ ছাড়া রেল সরকারি বাহন হওয়ায় এ খাতে যাত্রী পরিবহনের বিষয়টি মাথায় নেওয়া হয়েছে। কমিউটার ও মেইল ট্রেনের ব্যাপারে প্রথমে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। আসন ফাঁকা রেখে টিকিট বিক্রির চিন্তা রয়েছে। প্রতি কোচে কতজন যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব এবং স্টেশনের পরিবর্তে
অনলাইনে কিছু টিকিট বিক্রির পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের ঘোষণা পেলে বাস্তবায়নে যাবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। আর গণপরিবহন সচল হতে থাকলে শেষভাগে সুযোগ দেওয়া হতে পারে নৌপথে যাত্রী পরিবহন। তবে কোনো চিন্তাই চূড়ান্ত নয়। এ সপ্তাহে দেশের করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করে গণপরিবহন সচলের ব্যাপারে ‘বাস্তবসম্মত’ সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে একাধিক সূত্র।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম সময় সংবাদ লাইভকে বলেন, আপাতত গণপরিবহন চালু হবে কিনা অথবা চালু হলে তা কোন পর্যায়ে থাকবেÑ এ রকম সিদ্ধান্ত হয়নি এখনো। ৫ মের পর বলা যাবে। এটি সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামগ্রিক বিবেচনায় সীমিত পরিসরে গণপরিবহন চালুর চিন্তা হলেও এতে করে কতটা স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবেÑ এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে অত্যন্ত ভেবেচিন্তে। এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সমীচীন হবে না, যাতে করে মহামারী করোনার প্রকোপ বেড়ে যায়। তা ছাড়া মে মাসে করোনার সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আবার এটাও ঠিক, জরুরি প্রয়োজনে মানুষকে যাতায়াত করতে হয়। অস্বীকার করার উপায় নেই, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সচল হলে তাদের যাতায়াতে দৈনন্দিন কার্যক্রম বেগবান করতে যাতাযাত ব্যবস্থা সহজ করার দাবি এসেছে। ইতোমধ্যে পোশাক তৈরির সংগঠনের পক্ষ থেকে বাস চালুর বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
তবে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ প্রথম ধাপে ব্যক্তিগত বাহন চালুর ব্যাপারেই বিবেচনা করছে। দ্বিতীয় ধাপে গণপরিবহন সীমিত আকারে চালুর কথাবার্তা চলছে। আর পরিবহনকর্মীরা বলছেন, পরিবহন শ্রমিকদের অনটন দূর করতে সরকারি-বেসরকারি যে কোনো পর্যায় থেকে তাদের আর্থিক সাহায্য জরুরি।
পরিবহনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানা রোজগার বন্ধ থাকায় শ্রমিকদের মধ্যে দ্রুত অর্থ উপার্জনের প্রবণতা বাড়াতে পারে। এ জন্য গাড়ি সচল করার আগে কেবল সংগঠনভিত্তিক নয়; সাধারণ মালিক-শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। এর সঙ্গে করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতা তুলে ধরে বাড়াতে হবে সচেতনতাবোধ।
করোনা পরিস্থিতিতে পরিবহন সেক্টরে কঠিন অবস্থা দেখা দিয়েছে। মালিক-শ্রমিক সবার মধ্যেই আর্থিক সংকট বাড়ছে। ব্যাংকের ঋণের টাকায় কেনা গাড়ি চালানো মালিকরা যেমন আছেন বিপাকে, তেমনি মানবেতর জীবনযাপন করছেন শ্রমিকরা। মাসিক বেতন নয়, দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতেই জীবিকা নির্বাহ করেন অধিকাংশ পরিবহন শ্রমিক। অথচ কোম্পানিভিত্তিক পরিচালিত হলে মাসিক বেতনের সমস্যা হতো না। বর্তমানে পরিবহন শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছেন। হিমশিম খাচ্ছেন সংসার চালাতে। এমন অবস্থায় গাড়ি চলাচল শুরু হলে ক্ষতি পোষানোর মনোভাব কাজ করতে পারে তাদের মধ্যে। যাত্রী তোলার চিরচেনা প্রতিযোগিতার মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। তার চেয়ে বড় কথা, গার্মেন্টস বা বাজার সচল থাকলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে। আর পরিবহন সচল হলে টার্মিনাল-স্টপেজ ঘুরে করোনার ভাইরাস ছড়িয়ে যেতে পারে সর্বত্র। আর গাড়ি সচল হলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আসন ফাঁকা রেখে টিকিট বিক্রির নির্দেশনা তদারকি করার লোকের অভাব আছে। ঈদের সময় অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় কোনোটাই ঠেকানো যায় না। কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্বরতরা তখন বলেন, সীমিত লোকবলের কারণে কাংখিত পদক্ষেপ নিতে পারেন না। একই যুক্তিতে করোনার ঝুঁকি এড়াতে সামাজিক দূরত্ব ঠেকানো কঠিন বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক সময় সংবাদ লাইভকে বলেন, সড়ক-রেল-নৌ পরিবহন খাতে নিয়ন্ত্রণ করার মতো সরকারের সক্ষমতা আছে কিনা, সেটি দেখতে হবে। সড়ক পািরবহন বহু মালিকবেষ্টিত খাত। গাদাগাদি করে যাত্রী তোলা শ্রমিকদের অভ্যেস। অন্য দেশের মতো নয় আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা। এটি অন-অরগানাইজড। ফলে বিদেশের দৃষ্টান্ত এখানে কাজে আসবে না। নির্দিষ্ট কোম্পানির পরিবর্তে অনেক মালিক রয়েছেন এ খাতে। তাই যানবাহন চালুর আগে সব কিছু ভেবে সিদ্ধান্ত না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। কারণ, অন্য খাতের মতো পরিবহন খাতে ভর্তুকি বা প্রণোদনা নিশ্চিত করা গেছে কিনা জানা নেই। দীর্ঘদিন উপার্জন বন্ধ থাকার কারণে মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব মানার প্রবণতা থাকবে কম। তবে তাদের ভর্তুকিসহ প্রশিক্ষণদানের ব্যবস্থা করলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যেত।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ শামসুল হক আরও বলেন, গণপরিবহন চালুর ক্ষেত্রে শ্রীলংকার একটি কথা বলতে পারি। তারা একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। চালকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে। বোঝাতে হবে করোনা উত্তরকালের অবস্থা। স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি তুলে ধরার পাশাপাশি এদের মনোবল শক্ত করা দরকার। তবে সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকি দিতে হবে তার আগে। কারণ এরা বেকায়দায় আছে। নতুবা এনফোর্স করেও লাভ হবে না।
এ বিষয়ে পরিবহন মালিকদের সংগঠন সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ সময় সংবাদ লাইভকে বলেন, গণপরিবহনের মধ্যে বাসে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা কঠিন। স্বাস্থ্যগত বিষয়টি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারেন। তবে আমার কাছে গণপরিবহন চালু হতে পারে শিগগির এমন কোনো খবর নেই। ধারণা করছি, দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে শেষদিকে হয়তো এমন সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এটি মূলত সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়।
একই বিষয়ে যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সময় সংবাদ লাইভকে বলেন, দিনের পর দিন যানবাহন বন্ধ রাখা কঠিন। আবার এটাও ঠিক, মে মাসে সংক্রমণের মাত্রা বাড়ার আশঙ্কা আছে। এ ক্ষেত্রে প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে পরিবহন শ্রমিকদের ত্রাণ-প্রণোদনার বিষয়টি। সংগঠনগুলো তাদের শ্রমিকদের মানবিক দিক নিয়ে কথা বলছে না। পাশেও থাকে না। এদের দিয়ে গাড়ি চালাতে হলে সাহায্য নিশ্চিত করে বুঝেশুনে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে অঘোষিত লকডাউনের শুরুতেই রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে পোশাক কারখানা চালুসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিথিলতার পথে হাঁটছে সরকার। এ অবস্থায় রেল যোগাযোগ চালু করার বিষয়েও তৎপরতা শুরু হয়েছে। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী শাকসবজি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পরিবহনের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে আজ শুক্রবার থেকে তিন জোড়া বিশেষ পার্সেল ট্রেন পরিচালনা করবে। চট্টগ্রাম-ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ-ঢাকা এবং খুলনা-ঢাকা-খুলনা রুটে তিন জোড়া বিশেষ পার্সেল এক্সপ্রেস ট্রেন চলবে।
এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম-ঢাকা এবং ঢাকা-জামালপুর-ঢাকা রুটে সপ্তাহে ৭ দিন এই ট্রেন চলাচল করবে। খুলনা-ঢাকা-খুলনা রুটে সপ্তাহে দুই দিন চলাচল করবে। করোনা ভাইরাসের কারণে গত ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে মালবাহী ট্রেন চলাচল অব্যাহত ছিল।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান বলেন, রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও কিছু কিছু মালবাহী ট্রেন চালু রাখা হয়। এসব ট্রেন দিয়ে মূলত সরকারের খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেল পরিবহন করা হয়। এবার লাগেজ ভ্যানের মাধ্যমে পার্সেল ট্রেন চালু হলে সেগুলো দিয়ে শাকসবজি ও ফলমূল পরিবহন করা যাবে। তবে যাত্রীবাহী ট্রেনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত এলে ট্রেন চলবে। সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি আমরা।
সড়ক ও রেলপথের মতো নৌপথেও যাত্রী পরিবহন বন্ধ রয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২২ জেলায় চলাচলরত কোনো লঞ্চ নেই যাত্রী পরিবহনে। দেশের সর্বত্র যাত্রী পরিবহন বন্ধ। তবে নৌপথে পণ্য পরিবহন সচল রয়েছে। এর মধ্যে বন্ধ থাকা বাংলাদেশ-ভারত রুটের পণ্য পরিবহনও শুরু হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে একমত হয়েছে উভয় দেশ। মিলেছে এ সংক্রান্ত অনুমোদনও। যে কোনো সময় থেকে পণ্যবাহী জাহাজ চলবে এ দুই দেশের মধ্যে। গণপরিবহন বন্ধ রাখার সরকারি সিদ্ধান্ত শিথিল হলে নৌপথে যাত্রী পরিবহনের পথও উন্মুক্ত হতে পারে। তবে লঞ্চে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কতটুকু যাত্রী পরিবহন সম্ভব, তা নিয়ে আলোচনা চলছে বিআইডব্লিউটিএ ও লঞ্চ মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে। এ বিষয়ে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সময় সংবাদ লাইভকে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ওপরই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। যাত্রীবাহী নৌযান চালু করা হবে কিনা, তা নির্ভর করবে তাদের মতামতের ভিত্তিতে।