আলমগীর পারভেজ: ডলারের দাম বৃদ্ধিতে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি, টাকার মান হারাচ্ছে। ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। গত ২৯ জুলাই মুদ্রানীতি ঘোষণার পর থেকেই ডলারের দর ধারাবাহিকভাবে বাড়তে দেখা যায়।ডলারের মূল্য বাড়লে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যাবে। ডলারের দাম বেড়েছে ব্যাংকিং চ্যানেলে। একই সাথে কার্ব মার্কেটেও ডলার মূল্য চড়া। করোনাকালীন লকডাউন পরবর্তী এই সময়ে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে নেতিবাচক হিসাবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা বলছেন, এ সময়ে ডলারের দাম বেড়ে গেলে তা হবে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।
ব্যাংকিং সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ডলারের দাম বরাবরই বেড়েছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে রয়েছে। ডিলার ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনাও চলছে। মূল্যবৃদ্ধির হিসাব করলে দেখা যায়, গত ২৫ বছরে ডলারের দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। সূত্রমতে, বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে না রাখলে ডলারের দাম আরো আগেই ৯০ টাকা ছাড়িয়ে যেত। যদিও বাংলাদেশে মুদ্রার ভাসমান বিনিময় হার কার্যকর রয়েছে।
বাংলাদেশে ডলার ও টাকার বিনিময় হার স্বাধীনতার পর থেকে সরকার নির্ধারণ করে দিত। টাকাকে রূপান্তরযোগ্য ঘোষণা করা হয় ১৯৯৪ সালের ২৪ মার্চ। আর ২০০৩ সালে এই বিনিময় হারকে করা হয় ফ্লোটিং বা ভাসমান। এর পর থেকে আর ঘোষণা দিয়ে টাকার অবমূল্যায়ন বা পুনর্মূল্যায়ন করা হয় না। তবে বিনিময় হার ভাসমান হলেও পুরোপুরি তা বাজারভিত্তিক হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময়ই এতে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রেখেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে অনুসরণ করে আসছে ‘ম্যানেজড ফ্লোটিং রেট’ নীতি।
বাজারে এমনিতেই সকল পণ্যের দাম বেশি। আর ডলার মূল্য বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আমদানি পণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়বে। দেশে বড় ধরনের বিনিয়োগ না থাকার কারণে তারল্য সরবরাহ বেশি। এতে করে পণ্যের দাম বাড়ছে। আর তা নিয়ন্ত্রণ করতে বাজার (ব্যাংকগুলো) থেকে নগদ টাকা উঠিয়ে নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ডলারের এই মূল্যবৃদ্ধির খড়গ পড়ে উদ্যোক্তার ওপর। ব্যবসা কিংবা শিল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের মেশিনারিজ ও পণ্য আমদানি করতে এলসি খুলতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে ৯০, ১২০, ১৮০ ও ৩৬০ দিন আগে ব্যাংক কোনো মেশিনারিজ ও পণ্য আমদানি বাবদ ব্যয়ের হিসাব করে থাকে।
কিন্তু আলোচ্য সময়ের মধ্যে কিংবা এর পরেও ডলারের মূল্য বেড়ে গেলে তা গ্রাহকের কাঁধে চাপে। এমনকি ঋণ পুরোপুরি শোধ না হওয়া পর্যন্ত ডলারের বাড়তি দাম গ্রাহককেই দিতে হয়। এতে মোট ব্যয় যেখানে গিয়ে দাঁড়ায় তা গ্রাহক ব্যাংক থেকে নেয়নি। অথচ পরিশোধের সময় তাকে বাড়তি অর্থ দিতে হচ্ছে। তদুপরি, একেক ব্যাংকে একেক দরের বিষয়টিও মনিটর না করায় উদ্যোক্তা বিপাকে পড়েন। যার রেশ টানতে হয় ক্রেতা-ভোক্তাকেও।
সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, গত জুলাই শেষেও ডলারের দাম কমবেশি ৮৫ টাকার মধ্যে ছিল। গত বৃহস্পতিবার কোনো কোনো ব্যাংক ৮৭ টাকায়ও ডলার বিক্রি করেছে। গতকাল ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা ২৫ পয়সা। কিন্তু খোলা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৮৮ টাকা পর্যন্ত। হঠাৎ ডলারের এই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে নতুন করে চিন্তায় পড়েছেন উদ্যোক্তারা। শুধু আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিই নয়, বরং ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ব্যাংকিং খাতে নেওয়া ঋণের অঙ্কও বেড়ে যায়। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যবসায় উদ্যোগ। দিনশেষে ক্রেতার ওপরই তা বর্তায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, ২০০০ সালে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের মূল্য ছিল ৫৪ টাকা। ২০১০ সালে তা বেড়ে হয় ৭১ টাকা। ২০১৮ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের দামে ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সার সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। যদিও ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট কার্যকর থাকলে তা করা যায় না। কিন্তু সেখানেও স্থির থাকেনি ডলারের দাম। বর্তমানে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য প্রায় ৮৫ টাকা। খোলা বাজারে এই বিক্রি হচ্ছে ৮৮ টাকার বেশি।
লকডাউনের পর আমদানি আবার বাড়তে শুরু করায় ব্যাংকগুলোর ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দাম সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে এসেছে। দর নিয়ন্ত্রণে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করতে শুরু করলেও দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
১৯ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) বিদেশি মুদ্রায় লেনদেনে নিয়োজিত অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ৮৫ টাকায় ১ ডলার বিক্রি হয়। সর্বশেষ গত ২৬ আগস্ট ডলারের দাম বেড়ে দাড়ায় ৮৭ টাকায়। এর আগে কখনোই এত দামে ডলার বিক্রি হয়নি। এর আগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে করোনা ভাইরাসের প্রকোপের আগে ডলারের সর্বোচ্চ দর উঠেছিল ৮৪ দশমিক ৯৫ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, গত বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলোর চাহিদা মেটাতে ৫ কোটি ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া শ্রীলংকার সঙ্গে ডলার সোয়াপের মাধ্যমে ৫ কোটি ডলার ছাড় করা হয়। এর পরও বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৬৫৮ কোটি ডলার। যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রিজার্ভ।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামলে নিয়ে অর্থনীতির চাকা আবার গতিশীল হচ্ছে। সামনে ডলারের দর বাড়তে পারে এমন সম্ভবনা থেকে অনেক ব্যাংক ডলার কেনা বাড়িয়েছে। তাদের আশঙ্কা সামনে রেমিট্যান্স কমে যাবে। ফলে ডলারের যোগান আগের মতো থাকবে না। তাছাড়া আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যেও আবার স্বাভাবিক ধারায় ফিরবে। যে কারণে ডলারের চাহিদাও বাড়বে বলে মনে করছেন তারা। বাড়তি ডলারের যোগান দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলো তাদের নিজেদের কাছে ডলার ধরে রাখার পরিমাণ বাড়াচ্ছে।
তাছাড়া চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতেও ডলারের দর বাড়ার ঈঙ্গিত দেওয়া হয়। ফলে সর্বাধিক ব্যবহৃত এই বিদেশি মুদ্রাটির দেশের বাজারে দাম বাড়তে শুরু করে।