*সময় সংবাদ লাইভ রির্পোটঃ রাজধানী ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে দক্ষিণ সিটিতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। এ এলাকায় ডেঙ্গু দিনদিন ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। দক্ষিণ সিটির মধ্যে ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখা দিয়েছে যাত্রাবাড়ীতে। মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর ৮ দশমিক ২০ শতাংশই যাত্রাবাড়ীর। তারপর উত্তর সিটির মিরপুর ও উত্তরায় ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার বেশি।
এদিকে, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত এক দিনে আরও ২৯১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ২৫৯ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩২ জন। এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল ২২ আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা মোট আট হাজার ৪১ জন। একই সময়ে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র পেয়েছেন ছয় হাজার ৭৮৭ জন। এ সময়ে মৃত্যু হয়েছে ৩৬ জনের।
‘মনসুন এডিস সার্ভে ২০২১ অ্যান্ড কারেন্ট সিচুয়েশন অব ডেঙ্গু’ শীর্ষক জরিপের তথ্য তুলে ধরে গতকাল রোববার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নির্মূল কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আফসানা আলমগীর খান জানান, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, উত্তরার পর ধারাবাহিকভাবে বাসাবো, রামপুরা, খিলগাঁও, মুগদা, ওয়ারী, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মগবাজার ও পল্টনে বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে।
এ ছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের রামপুরা, উত্তরা, মিরপুর, বনশ্রী, বসুন্ধরা, কল্যাণপুর, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, বারিধারা, দক্ষিণখান এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়ারী, মতিঝিল, মুগদা, বাসাবো, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, খিলগাঁও, শান্তিনগর, সিদ্ধেশ্বরী, পল্টন, টিকাটুলী, গেন্ডারিয়া, শাহজাদপুর এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি।
জরিপে বলা হয়েছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৬টি সাইটে এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০টি সাইটে এডিসের লার্ভার বেশি উপস্থিতি পাওয়া গেছে। জরিপকালে ৩ হাজার ৪১২টি গৃহস্থালিতে এডিসের লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া যায়নি এবং ৫৮৮টি গৃহস্থালিতে লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এডিসের লার্ভার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে বহুতল ভবনে। নির্মাণাধীন ভবনেও উল্লেখযোগ্যভাবে লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডে ১০ দিন জরিপ চালিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
নগরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও ডেঙ্গু উদ্বেগ বাড়াচ্ছে বলেও এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৯ সালে গ্রামাঞ্চলে বেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়নি। এখন দেখতে পারছি, গ্রামাঞ্চলেও অনেক ডেঙ্গু রোগী। এর কারণ হলো নগরায়ণ এখন গ্রাম পর্যন্ত চলে গেছে। এসব জায়গার বাসাবাড়িতে এসি, ফ্রিজ আছে। নগরায়ণের জন্য এডিস মশার বংশ বেড়ে যাচ্ছে।
এই প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, লকডাউনের কারণে অনেক প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল। সেখানে জমে থাকা পানি থেকে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। এখন সেগুলোর কাজ শুরু হয়েছে। আস্তে আস্তে সেখান থেকে ডেঙ্গু নির্মূল করা হচ্ছে। আর প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, সেসব তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ডেঙ্গুর উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করা হচ্ছে। নির্মাণাধীন ভবনগুলোয় উল্লেখযোগ্যভাবে ডেঙ্গুর লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে।
জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করে ডা. আলমগীর খান বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১০টি ওয়ার্ডের ১৯টি এলাকার ব্রটো ইনডেক্স ৪০ এর বেশি পাওয়া গেছে। দুই সিটি করপোরেশনের ৫৬টি এলাকায় ব্রটো ইনডেক্স ছিল ২০ বা তার বেশি। ব্রুটো ইনডেক্স ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের এলিফ্যান্ট রোড, সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় ৬৬ দশমিক ৭, ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের আরকে মিশন রোড ও টিকাটুলিতে ৫০, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বনশ্রীতে ৪০ এবং ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের মিন্টো রোড ও বেইলি রোডে ৪০।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স ৫৬ দশমিক ৭ পাওয়া গেছে। এই ওয়ার্ডে রয়েছে মগবাজার, নিউ ইস্কাটন এলাকা। এছাড়া বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা ও নিকুঞ্জ নিয়ে গড়া ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের ব্রুটো ইনডেক্স ৪৮ দশমিক ৪, ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কল্যাণপুর ও দারুস সালাম এলাকায় ৪৬ দশমিক ৭, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়ায় ৪৩ দশমিক ৩ এবং মহাখালী ও নিকেতন এলাকা নিয়ে ডিএনসিসির ২০ নম্বর ওয়ার্ডে ৪০। উত্তর সিটি করপোরেশনের আফতাবনগর ও মেরুল বাড্ডা এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বংশালের ব্রুটো ইনডেক্স শূন্য পাওয়া গেছে জরিপে, অর্থাৎ এসব এলাকায় মশার উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডের ১০০টি স্থানে জরিপ চালানো হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তরের ৪১টি এবং দক্ষিণের ৫৯টি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, গত বছরের চেয়ে এ বছর মশার উপস্থিতি বেশি। এ বছর ডিএসসিসির ৩০টি এবং ডিএনসিসির ২৬টি এলাকার ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি পাওয়া গেছে। ২০২০ সালের জরিপে ডিএসসিসির ১৭টি এবং ডিএনসিসির ৯টি এলাকার ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি পাওয়া গিয়েছিল।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ডা. কবিরুল বাশার বলেন, মশার এই ঘনত্ব ঝুঁকিপূর্ণ। “জরিপে ৫৬টি এলাকায় ব্রুটো ইনডেক্স ২০ বা তার বেশি পাওয়া গেছে। মানে এখানে এইডিস মশাবাহিত রোগ হবে এবং তাই হয়েছে। এসব জায়গা থেকে প্রচুর ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে।” এইডিস মশার এই বৃদ্ধির পেছনে নগর কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি নাগরিকও দায় আছে বলে মনে করেন তিনি। “নগরবাসী তার দায় এড়াতে পারেন না। যার যার বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা তো বাড়ির বাসিন্দাদের দায়িত্ব। যার যার আঙিনা পরিষ্কার রাখলেই এইডিস মশা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।”
২৪ ঘণ্টায় ২৯১ ডেঙ্গু রোগী
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ২৫৯ জন এবং ঢাকা মহানগরীর বাইরে ৩২ জন রোগী ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর আগেরদিন শনিবার ২৭৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। গত জুলাইয়ে ২ হাজার ২৮৬ জন রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছিল এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল ১২ জনের।
২০১৯ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু মারাত্মক আকার ধারণ করায় এক লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। পরের বছর তা অনেকটা কমে আসায় হাসপাতালগুলো ১ হাজার ৪০৫ জন ডেঙ্গু রোগী পেয়েছিল।
শিশুদের বেলায় করোনার চেয়েও ডেঙ্গু ভয়ানক!
১৯ আগস্ট রাত ১১টায় রাজধানীর মহাখালী থেকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয় ৯ বছরের ইসমাইল। মারা যায় রাত ১২টার কিছু সময় পরেই। চিকিৎসকদের ভাষ্যে ইসমাইল এসেছিল শেষ মুহূর্তে। চিকিৎসার জন্য সে ডাক্তারদের সময়ই দেয়নি। শিশু হাসপাতালে আনার পর সরাসরি তাকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হলেও তখন ইসমাইলের রক্তচাপ ও পালস পাওয়া যাচ্ছিল না। তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে মাত্র দেড় ঘণ্টা পেয়েছিলেন এখানকার চিকিৎসকরা। এখন পর্যন্ত ঢাকা শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নেওয়া অবস্থায় মারা গেছে ছয় শিশু। চিকিৎসকরা বলছেন, তাদের তিনজনের অবস্থাই ছিল ইসমাইলের মতো। এ হাসপাতালে ২১ আগস্ট সকাল ৮টা পর্যন্ত পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছে ৩৩১ শিশু। এদের মধ্যে এক বছরের নিচে ২৮ জন, ১-৫ বছরের মধ্যে ৯৬, ৫-১০ বছরের মধ্যে ১২৯ ও ১০ বছরের বেশি ভর্তি হয়েছে ৭৮ জন।
ঢাকা শিশু হাসপাতালে এখন ডেঙ্গু আক্রান্ত ৮০ শিশু ভর্তি আছে। আইসিইউতে আছে ১৪ শিশু। ২০ আগস্ট সকাল থেকে ২১ আগস্ট সকালে ভর্তি হয়েছে সাত শিশু। তার আগের ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছে ১৭ জন।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের রোগতত্ত্ববিদ ডা. কিংকর ঘোষ বলেন, জানুয়ারি থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৩৫৪ শিশু এখানে ভর্তি হয়েছে। জুলাইতে ভর্তি হয়েছে ১০৪ জন। আগস্টের ২০ দিনে ২৩৩ শিশু। গত সাত দিনে ভর্তি ৯৩ শিশু। নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে কিংকর ঘোষ বলেন, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালের ডেঙ্গু পরিস্থিতি আমি দেখেছি। কখনওই এ হাসপাতালে একসঙ্গে ৬৯ জনের বেশি ভর্তি ছিল না। এবার রেকর্ড ছাড়িয়ে আজ ৮০ জন ভর্তি আছে।
‘ওয়ার্নিং সাইন’ বেশি
মহামারি হিসেবে বিশ্বকে থমকে দিয়েছে করোনা ভাইরাস। কিন্তু করোনার চেয়েও শিশুদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে ডেঙ্গু। চিকিৎসকরা বলছেন, অন্য কোনও জটিলতা ছাড়া যদি শিশুরা করোনায় আক্রান্ত হয় তবে তাদের মৃত্যুঝুঁকি খুব একটা থাকে না। কিন্তু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে সময়মতো চিকিৎসা না পেলেই মারা যাচ্ছে শিশুরা।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। এর মধ্যে গত জুলাইতে ১২ জন আর চলতি ২১ আগস্ট সকাল পর্যন্ত মারা গেছে ২৪ জন। তবে তাদের মধ্যে কতজন শিশু বা বয়স বিবেচনায় পরিসংখ্যান জানায়নি আইইডিসিআর।
শিশুদের ক্ষেত্রে করোনার চেয়েও ডেঙ্গু ভয়ংকর মন্তব্য করে কিংকর ঘোষ বলেন, ‘শিশু হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা নেওয়া ৬০০ শিশুর চিকিৎসা দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। শুধু কোভিড নিয়ে কোনও শিশুর অবস্থা খারাপ হয়েছে বা মারা গেছে এমনটা ঘটেনি। যাদের অন্য জটিলতা ছিল তারা করোনাতে মারা গেছে। কিন্তু ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে পুরো চিত্রটা ভিন্ন। এখন ডেঙ্গু হলে সময়মতো চিকিৎসা না পেলেই একটা শিশু মারা যাবে।’
কিংকর ঘোষ আরও বলেন, “কোনও শিশুর জ্বর হলেও যখন অভিভাবকরা চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন না বা বাড়িতে অপেক্ষা করছেন- তখনই ডেঙ্গুর জটিলতা বাড়ছে। যেমন রক্তচাপ কমে যাওয়া, প্লাটিলেট কমে যাওয়া। এগুলো অনেক সময় বোঝাও যায় না। এ সময়টুকুতেই শরীরের অন্য অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। এসব কারণেই শিশুদের অবস্থা জটিল পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। যখন এসব জটিলতা নিয়ে শিশু হাসপাতালে আসে তখন সেসব ‘ম্যানেজ’ করা সমস্যা হয়ে যায়।”
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শফি আহমেদ বলেন, “জ্বর, মাথাব্যথা, পেটে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট-কাশি নিয়েও ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুরা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এবার ওরা ‘ওয়ার্নিং সাইন’ নিয়ে আসছে বেশি।” সেই সঙ্গে মেনিনজাইটিস, লিউকোমিয়ার মতো অন্যান্য জটিলতা থাকলে মৃত্যুর শঙ্কা আরও বেশি মন্তব্য করে তিনি বলেন, শিশুরা এবার আমাদের সময়ই দিচ্ছে না।