আলমগীর পারভেজ : তালেবানের হাতে রক্তপাতহীন ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি চলছে। ২০ বছর পর আবারও তালেবানের দখলে নিয়েছে দেশটির রাজধানী কাবুল। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে প্রবেশের পর দেশটির তালেবানরা বলছেন, তারা আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা গ্রহণের প্রত্যাশা করছে। একই সঙ্গে অতীতের কট্টর ইসলামি বিধি-বিধান শিথিল করার অঙ্গীকার করেছে তারা। ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের ক্ষমতায় থাকাকালীন দেশটিতে ইসলামি শরীয়াহ আইন কার্যকর করে তালেবান। এদিকে তালেবানের তড়িৎগতিতে দেশটির বেশিরভাগ এলাকার দখল নেওযায় আমেরিকার কূটনীতিকরা কাবুল দূতাবাস ছেড়ে আমেরিকার উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছেন। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার পর ২০ বছরের আফগান যুদ্ধ শেষে আবারও দেশটির ক্ষমতায় আসতে চলেছে তালেবান। আফগানিস্তানের প্রশাসনকর্মীদের উদ্দেশে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে তালেবান। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে নিযুক্ত সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের আহ্বানও জানিয়েছে দেশটির তালেবান নেতারা। সূত্র: বার্তাসংস্থা রয়টার্স, বিবিসি, টোলো নিউজ, বার্তা সংস্থা রয়টার্স, নিউ ইয়র্ক টাইমস।
এছাড়াও গতকাল রোববার তালেবানের সদস্যরা রাজধানীতে ঢুকে পড়ায় বিদেশি কূটনীতিক এবং অনেক স্থানীয় বাসিন্দা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স। বিদেশের সব সেনা প্রত্যাহারের মধ্যে মাত্র দশ দিনে গোটা আফগানিস্তান দখলে নিয়ে তালেবান রাজধানী কাবুলে ঢোকার পর প্রেসিডেন্ট আশারাফ গানি সরকারের ঘনিষ্ট সদস্যদের নিয়ে গতকাল রোববার সন্ধ্যায় দেশত্যাগ করেছেন বলে জানিয়েছে টোলো নিউজ। দেশটির সংবাদমাধ্যম টোলো নিউজ দোর্দণ্ড প্রতাপে তালেবানের কাবুল দখল করার পর দুটি সূত্রের বরাতে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানির দেশত্যাগের খবর জানিয়েছে। এর আগে তালেবান প্রতিনিধিদলের প্রেসিডেন্ট গানির প্যালেসে ঢোকার খবর পাওয়া যায়।
সূত্র দুটি বলেছে, রোববার তালেবান রাজধানী কাবুলে ঢোকার পর প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশত্যাগ করেন। এসময় প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সঙ্গে তার কিছু ঘনিষ্ট উপদেষ্টা ও সরকারের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও চলে গেছেন। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স গতকাল রোববার জানিয়েছে, আশরাফ গানি এরইমধ্যে তাজিকিস্তানের উদ্দেশ্যে কাবুল ত্যাগ করেছেন। রয়টার্স লিখেছে, এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য তারা প্রেসিডেন্টের দপ্তরে যোগাযোগ করলে সেখান থেকে বলা হয়েছে, নিরাপত্তার স্বার্থে আশরাফ গানির গতিবিধি সম্পর্কে কোনো তথ্য দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব না। তালেবানের একজন মুখপাত্র রয়টার্সকে বলেছেন, আশরাফ গানি এখন কোথায়, তারা সে বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, বিশাল আকৃতির দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট চিনুক এবং দ্রুতগতির ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টারগুলোকে দূতাবাসের স্টাফদের সরিযে নেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, একটির পর একটি হেলিকপ্টার দূতাবাসের ভেতরে নামছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই যাত্রী বোঝাই করে উড়ে যাচ্ছে। বার্তা সংস্থা এপি বলছে, গতকাল রোববার সকালে কূটনৈতিক সাঁজোয়া যানের বহর মার্কিন দূতাবাস এলাকা ত্যাগ করতে দেখা যায়। কূটনীতিবিদরা ভবন ত্যাগ করার আগে স্পর্শকাতর দলিলপত্র পুড়িয়ে ফেলছেন এবং সে কারণে দূতাবাসের ছাদ থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়।
আফগানিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ একজন কর্মকর্তা বলেছেন, তালেবান যোদ্ধারা চতুর্দিক থেকে রাজধানীতে পৌঁছে গেছেন। তবে কাবুলে কোনও ধরনের লড়াইয়ের খবর পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স। পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থিত আফগানিস্তানের সরকারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের আলোচনা চলছে জানিয়ে তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, শান্তিপূর্ণ এবং সন্তোষজনক ক্ষমতা হস্তান্তরের সম্মতি না পাওয়া পর্যন্ত তালেবান যোদ্ধাদের কাবুলের সব প্রবেশপথে অবস্থান করতে বলা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক আফগানিস্তানের শিক্ষাবিদ ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলী আহমদ জালালিকে দেশটির অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান করার তথ্য জানিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যম। তবে জালালিকে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে তালেবান মেনে নেবে কি-না সেটি এখনও পরিষ্কার নয়।
নারী অধিকার: তালেবানের একজন মুখপাত্র নারীদের অধিকারের প্রতি যোদ্ধারা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। মাত্র ১০ দিনের দ্রুতগতির আগ্রাসী অভিযানের মাধ্যমে পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় নারীদের অধিকারের ব্যাপারে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের ক্ষমতায় থাকাকালীন দেশটিতে ইসলামি শরীয়াহ আইন কার্যকর করে তালেবান। ওই সময় ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে পাথর নিক্ষেপ, চুরির জন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা এবং মেয়েদের স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ জারি করে তালেবান। তবে গতকাল রোববার নারী অধিকারের ব্যাপারে যে বিবৃতি দিয়েছে তা বিশ্বজুড়ে এই ইস্যুতে তৈরি হওয়া উদ্বেগ সাময়িক নিবারণের চেষ্টা বলে মনে করছেন অনেকে। তালেবানের একজন মুখপাত্র বলেছেন, নারীরা একাই বাড়ি থেকে বের হতে পারবেন এবং শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার অব্যাহত থাকবে।
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা: আফগানিস্তানের প্রশাসনকর্মীদের উদ্দেশে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে তালেবান। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে নিযুক্ত সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের আহ্বানও জানিয়েছে দেশটির তালেবান নেতারা। গতকাল রোববার তালেবান মুখপাত্র সোহেল শাহিন এক টুইটে বলেন, আফগানিস্তানে যারা এর আগে আগ্রাসনকারীদের জন্য কাজ করেছে বা তাদের সাহায্য করেছে, অথবা এখন যারা দুর্নীতিবাজ কাবুল প্রশাসনের বিভিন্ন পদে আসীন রয়েছে – তাদের সবার জন্য ইসলামিক আমিরাত দরজা খোলা রেখেছে এবং ক্ষমা ঘোষণা করেছে। আমরা আরেকবার তাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, যেন তারা দেশ ও জাতির জন্য কাজ করতে এগিয়ে আসেন। চলতি বছর এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগানিস্তান থেকে আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে সব মার্কিন ও ন্যাটো সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পর মে মাস থেকে আফগানিস্তান দখলে অভিযান শুরু করে তালেবানগোষ্ঠী। তার অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে দেশের ৩৪ টি প্রদেশের ২৮ টি দখল করে বর্তমানে কাবুলে অবস্থান করছে এই কট্টর ইসলামী গোষ্ঠী। ইতোমধ্যে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি পদত্যাগ করেছেন এবং দেশটিতে একটি অন্তবর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চলছে।
আফগান অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম: তালেবানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় আফগানিস্তানের অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান হিসেবে দেশটির সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলী আহমাদ জিলালির নাম এসেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যাপনায় যুক্ত এই আফগান রাজনীতিককেই অন্তর্র্বতী সরকারের নেতৃত্বে দেখা যেতে পারে বলে কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। তালেবান জিলালিকে অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান হিসেবে মেনে নিয়েছে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কূটনৈতিক সূত্রের বরাতে রয়টার্স লিখেছে, আশরাফ গানির সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর জিলালিকেই সম্ভাব্য গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি বলে মনে করা হচ্ছে, যিনি এই ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া দেখভাল করতে পারেন। গত তিন মাসে একের পর এক শহর দখল করে তালেবান যোদ্ধারা রোববার আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে প্রবেশে করে।
তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ সে সময় এক বিবৃতিতে বলেন, কাবুল যেন শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে, সেজন্য আফগান সরকারের সঙ্গে তাদের আলোচনা চলছে। শান্তিপূর্ণ ও সন্তোষজনক ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে ঐকমত্য না হওয়া পর্যন্ত তাদের যোদ্ধারা কাবুলের সব প্রবেশ পথে পাহারায় থাকবে। পরে আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল সাত্তার মিরজাকওয়াল স্থানীয় টোলো টিভিতে প্রচারিত এক ভিডিও বার্তায় বলেন, একটি অন্তর্র্বতী সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তালেবান কাবুলে হামলা করবে না। এর প্রস্তুতি নিতে তালেবান মধ্যস্থতাকারীদের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের দিকে রওনা হওয়ার খবর আসে এর পরপরই। তালেবান যোদ্ধারা কাবুলের দুয়ারে পৌঁছে যাওয়ার সময়ই যুক্তরাষ্ট্র তাদের কূটনীতিকদের হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে নেওয়া শুরু করে; কাবুল বিমানবন্দর ও দূতাবাস সুরক্ষিত করতে নতুন করে সেনাও পাঠানো হয়।
বাগরাম বিমানঘাঁটি দখলের দাবি তালেবানের: আফগানিস্তানে প্রায় ২০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও এর নেতৃত্বাধীন বাহিনীর যুদ্ধাভিযানের মূল কেন্দ্র সেই বাগরাম বিমানঘাঁটি এবং সেখানকার কারাগার দখলে নেওয়ার দাবি করেছে তালেবান। সম্প্রতি আফগান কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে মার্কিন সেনারা গভীর রাতে রাজধানী কাবুলের উপকণ্ঠে অবস্থিত এই বাগরাম ঘাঁটি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে বাগরাম ঘাঁটিতে পদার্পন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনী। বাগরামকে বিশাল ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তুলেছিল তারা। এই ঘাঁটিতে ১০ হাজার সৈন্য ধারণের ক্ষমতা রয়েছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, বারাক ওবামা ও ডনাল্ড ট্রাম্প এই বাগরাম ঘাঁটি পরিদর্শন করেছেন। বাগরামে একটি কারাগারও আছে। মার্কিন সেনারা চলে যাওয়ার সময় এই কারাগারে ৫ হাজার তালেবান বন্দি ছিল বলে ধারণা করা হয়। বিবিসি জানায়, তালেবানের কয়েকটি সূত্র বলছে, তারা সব বন্দিকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছে। বাগরাম কারাগারকে কিউবায় যুক্তরাষ্ট্রের কুখ্যাত গুয়ানতানামো বে’ কারাগারের সঙ্গে তুলনা করা হত। যুক্তরাষ্ট্র বাগরাম কারাগার তৈরি করেছিল এবং তারাই এটি পরিচালনা করত। ২০১৩ সালে এটি আফগান সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। গত তিন মাসে একের পর এক শহর দখল করে তালেবান যোদ্ধারা রোববার চারদিক থেকে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে ঢুকতে শুরু করার মধ্যে নগরীটির কাছের বাগরাম বিমানঘাঁটি দখলে নেওয়ার দাবি করল।
তালেবানের হাতে রক্তপাতহীন ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি: গত তিন মাসে একের পর এক শহর দখল করে তালেবান যোদ্ধারা আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে প্রবেশের পর রক্তপাত এড়াতে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণা এসেছে সরকারের তরফ থেকে। বিবিসি জানিয়েছে, দেশটির ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল সাত্তার মিরজাকওয়াল গতকাল রোববার স্থানীয় টোলো টিভিতে প্রচারিত এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, একটি অন্তর্র্বতী সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তালেবান কাবুলে হামলা করবে না। এর প্রস্তুতি নিতে তালেবান মধ্যস্থতাকারীরা ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের দিকে রওনা হয়েছে বলেও খবর দিয়েছে বিবিসি। রাজধানীতে প্রবেশের সময় তালেবান যোদ্ধাদের তেমন কোনো প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়নি বলে কাবুল থেকে জানিয়েছেন বিবিসির সাংবাদিক ইয়ালদা হাকিম, যিনি সেখানে কাজ করছেন এক দশকের বেশি সময় ধরে।
সরকার সমর্থক দুই প্রভাবশালী মিলিশিয়া বাহিনীর নেতা আতা মোহাম্মদ নূর ও আবদুল রশীদ দোস্তামও পালিয়েছেন। নূর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেছেন, মাজার-ই-শরিফ যে প্রদেশের রাজধানী, সেই বলখ প্রদেশ ষড়যন্ত্র করে তালেবানের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে এক বিবৃতিতে তালেবান বলেছে, তাদের একের পর এক অঞ্চল জয়, এটাই দেখাচ্ছে যে জনগণের কাছে তারা কতটা জনপ্রিয়। তালেবানের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আফগান জনগণ ও বিদেশি সবাই নিরাপদে থাকতে পারবে বলেও আশ্বস্ত করেছে তারা। বিবৃতিতে বলা হয়, ইসলামিক আমিরাত (নিজেদেরকে এ নামেই পরিচয় দেয় তালেবান) সবসময়ই তাদের (জনগণ ও বিদেশি) জানমাল ও সম্মানের সুরক্ষা দেবে। জাতির জন্য একটি শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করবে। কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার কর্মীদেরও কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। তবে এই আশ্বাস যে কাজে দেয়নি, তা বোঝা যাচ্ছে গত এক সপ্তাহ ধরে কাবুলে বাড়তে থাকা উদ্বাস্তুদের ভিড় দেখে। বিভিন্ন প্রদেশের হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিতে ছুটে আসেন রাজধানীতে।
তালেবান নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন প্রদেশ থেকে রাজধানীতে আসা অসংখ্য আফগানকে রোববারও ট্যাক্সি থেকে মালপত্র নামাতে দেখা গেছে। অসংখ্য পরিবারকে দেখা গেছে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস মজুদ করে রাখতে শহরতলীগুলোতে ছিল মানুষের ভিড়। অসংখ্য মানুষকে খোলা আকাশের নিচে, রাস্তার ধারে বা গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় তাঁবুতে গাদাগাদি করে ঘুমাতে দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কাবুলের এক বাসিন্দা।
মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কাবুলের সুরক্ষিত ওয়াজির আকবর খান এলাকা থেকে কূটনীতিকদের বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের দলের ‘মূল’ সদস্যরা কাবুল বিমানবন্দর থেকে কাজ করছেন। এক নেটো কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন কর্মীকে কাবুলের একটি নিরাপদ এলাকায় নিয়ে রাখা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগানিস্তান থেকে মার্কিন নাগরিক এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ‘সুশৃঙ্খলভাবে ও নিরাপদে’ সরিয়ে নিতে শনিবার আরও ৫ হাজার সেনা মোতায়েনের অনুমতি দেন। যুক্তরাজ্যও আফগানিস্তানে তাদের দূতাবাস খালি করার কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। দেশটিতে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত রোববার সন্ধ্যায় আফগানিস্তান ছাড়বেন বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যমগুলো।
ইরানি এক কর্মকর্তা জানিয়েছে, তারাও সোমবারের মধ্যেই তাদের কাবুল দূতাবাস খালি করে ফেলবেন। তালেবান বাহিনী ধারণার চেয়েও দ্রুতগতিতে আফগানিস্তানের বেশিরভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিজের দেশেও ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন।
ডেমোক্র্যাট এ প্রেসিডেন্ট এখন বলছেন, নিজের ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার দায়িত্ব এখন আফগান সামরিক বাহিনীর। অন্য এক দেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে চিরকালের জন্য মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। আফগান সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে আলোচনার আয়োজন করা কাতার তালেবান বাহিনীকে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে কাবুলের বর্তমান পরিস্থিতি: পুনরায় আফগানিস্তান দখলে মরিয়া তালেবান দেশের বাকি অংশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর রোববার থেকে রাজধানী কাবুল ঘিরে ফেলেছে। সাঈদ নামে এক বাসিন্দা এদিন সকালে ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানকে কাবুলের বর্তমান পরিস্থিতির বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলছেন, মানুষজন ভীত-সন্ত্রস্ত। তারা পরিবার, তাদের স্ত্রী ও মেয়েদের নিয়ে বিশেষ করে বেশি ভয় পাচ্ছে। তালেবানের সঙ্গে সম্পৃক্ত কাবুলের কিছু বাসিন্দা এতে করে খুশি হলেও গোটা শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষজন সত্যিই বেশ ভয়ে আছে।
গতকাল রোববার সকালে আমি বাড়ির বাইরে ছিলাম। দেখলাম এক নারী রাস্তার পাশে কাঁদছে। মানুষজন ছোটাছুটি করছে। সবাই ঘরে ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে যানবাহন খুঁজছেন। কোনো ট্যাক্সি নাই। ভাড়া বেড়েছে পাঁচ গুণ। তারপরও ট্যাক্সি কাউকে নিচ্ছে না। আমি কয়েক ঘণ্টা আগে কিছু গুলির শব্দ শুনেছি। তবে এখন গোটা শহর বেশ শান্ত। প্রত্যেকে তাদের বাড়িতে আটকে আছেন। যেসব দোকান ও ব্যাংক আগে ব্যস্ত ছিল তার বেশিরভাগ বন্ধ। স্কুলশিক্ষার্থীদের আজ পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু হচ্ছে না।
তালেবানরা আজ সকালে কাবুলের উপকণ্ঠে এসে পৌঁছেছে। এর মধ্যে কিছু কাবুলেও প্রবেশ করেছে। তারা মানুষের সাথে কথা বলছে। আপাতত অস্ত্র নেই। পুল-ই-চরখি কারাগার (আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড়) দখল করে সব বন্দিকে ছেড়ে দিয়েছে। বাবর গার্ডেনসহ কাবুলের কিছু জেলায় উড়ছে তালেবানের পতাকা। বাবর গার্ডেন একটি ঐতিহাসিক জেলা যেখানে মুঘল সম্রাট বাবরকে সমাধিস্থ করা হয়েছে। কাবুলের সাত নম্বর জেলার পুলিশ স্টেশন দখল করে অস্ত্র জমার নির্দেশ দিয়েছে তালেবান।
তালেবান যে বলছে কারো ক্ষতি হবে না, তাদের এমন আশ্বাসে আমার আস্থা নেই। আমরা জানি এরপর কি ঘটবে। তারা এখন দেশদ্রোহী খোঁজা শুরু করবে। মূলত যারা আফগান নিরাপত্তা বাহিনী এবং যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ন্যাটো সেনাদের হয়ে কাজ করেছে।
আফগান প্রেসিডেন্ট প্যালেসে ঢুকেছে তালেবান : অধিকাংশ প্রদেশ দখল করার পর রাজধানী কাবুল ঘিরে রেখে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির কার্যালয় প্রেসিডেন্ট প্যালেসে ঢুকেছে দেশটিতে বিগত বিশ বছর ধরে সরকারি ও বিদেশি বাহিনীর সঙ্গে লড়াইরত সশস্ত্র তালেবানের প্রতিনিধিরা। কাতারের রাজধানী দোহায় কিছুদিন ধরে আফগান সরকারের সঙ্গে কথিত শান্তি আলোচনায় তালেবানের যেসব প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে আট থেকে নয় জন এখন প্রেসিডেন্ট প্যালেসে রয়েছেন বলে জানাচ্ছে সিএনএন। ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের উদ্দেশে তালেবান প্রধান মোল্লা আবদুল গনি বারাদার যাত্রা করেছেন বলে জানা যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট প্যালেসে তালেবান প্রধানের উপস্থিতিতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বৈঠকে রয়েছেন এমন সূত্রের বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট প্যালেসে তালেবানের ওই প্রতিনিধিদের মধ্যে তালেবানের উপপ্রধান নেতা সিরাজুদ্দিন হাক্কানির ভাই আনাস হাক্কানিও রয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। দোহায় গত সপ্তাহে কথিত আফগান শান্তি আলোচনায় তালেবান প্রতিনিধি এবং আফগান সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, পাকিস্তান, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিদের নিয়ে ওই আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল। তালেবান কাবুলের চারপাশ ঘিরে ফেলার পর ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এ আলোচনার মধ্যে জার্মানিতে নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত আলী আহমদ জালালিকে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগের খবর দিচ্ছে আফগান গণমাধ্যমগুলো। তালেবানের একজন মুখপাত্র এক টুইট বার্তায় বলেছেন, ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাবুলের নিরাপত্তার দায়িত্ব অন্য পক্ষের (আফগান সরকারের)। তবে সরকার এই প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা না করলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে।
কাবুলের পরিস্থিতি এখন থমথমে। সরকার বলছে, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া চলছে। তালেবানও জানিয়েছে, তারা জোর করে রাজধানী কাবুল দখল করবে না। তবে কাবুলের সব প্রবেশদ্বারে তালেবান যোদ্ধাদের অবস্থান নিতে বলা হয়েছে। রয়টার্স জানাচ্ছে, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে পরামর্শ করছেন বলে গতকাল জানিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। পদত্যাগ করে তিনি তালেবান কমান্ডারের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পথ তৈরি করে দিচ্ছেন বলেও শোনা যাচ্ছে।