আলমগীর পারভেজ: বিশ্বের সবচেয়ে দামি আম ‘সূর্যডিম’ নিয়ে স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। মানুষ অলিক ঘোড়ার ডিম না দেখলেও নাম শুনেছে। কিন্তু সূর্যডিমের নাম অনেকেই জানে না। এটি কোন অলিক বস্তু নয় বিশ্বের সবচেয়ে দামি আমের নাম। যা নিয়ে এখন স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশের কৃষকরা। জাপানি প্রজাতির এই মিয়াজাকি আমটি বিশ্ববাজারে ‘রেড ম্যাংগো’ কিংবা ‘এগ অব দ্য সান’ নামে পরিচিত। বিশ্ববাজারে একটি মিয়াজাকি আমের দাম প্রায় ৭০ ডলার বা ৬ হাজার টাকা। তবে বাংলাদেশে এ আম বাণিজ্যিকভাবে চাষ করতে পারলে প্রতিকেজি আমের দাম হবে এক হাজার থেকে ১২শ’ টাকা।
জানা গেছে, ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে এর আগে জিআই সনদ পেয়েছে ফজলি আম, খিরসা আম, হাঁড়িভাঙা আম, আশ্বিনা জাত ও ল্যাংড়া আম। এসব আমও ব্যাপক সুস্বাদু। রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ আমের বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। এসব আমের দামও অনেক কম। ৩০ টাকা থেকে শুরু করে ২২০ টাকা পর্যন্ত এসব আম প্রকার ভেদে বিক্রি হয়ে থাকে। এসব আম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানিও করা হয়ে থাকে। কিন্তু সূর্যডিম আম বাংলাদেশে একটি নতুন প্রজাতির আম। এ আমটির জম্ম জাপানে। সারা বিশ্বে এ আমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আর এ কারণে দামও অনেক বেশি। বাংলাদেশের মাটিতেও এ আমের ফলনও বেশি হয়ে থাকে।
একটি গাছে সর্বোচ্চ ১০ মণ পর্যন্ত আম ধরে থাকে। নিয়মিত কিটনাশক ব্যবহার করলে পোকাও ধরে না। এ আম চাষে কৃষক ব্যাপক লাভবান হতে পারেন। আর এ কারণে খাগড়াছড়ি,বান্দরবনসহ সব পাহাড়ি আঞ্চলে চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী পাঁচ সাত বছরের মধ্যে বাংলাদেশ এ আম রফতানি করতে পারবে।
বর্তমানে বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে সূর্যডিম আমের চাষ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দেশের বিভিন্ন স্থানে পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করেছে। ৭৫টি হর্টিকালচার সেন্টারে মাতৃবাগান হিসেবে রোপণ করার প্রায় চার বছর পর এসব গাছে আম এসেছে। এর মধ্যে রাজধানীর আসাদগেট, মাদারীপুরের মোস্তফাপুর, দিনাজপুর, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী ও গাজীপুরের নুরবাগের হর্টিকালচার সেন্টারে ফল এসেছে এবং পাকতে শুরু করেছে। বাজারদর বেশি হওয়ায় অনেক কৃষকও নতুন এ জাতের আম চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, জাপানের মিয়াজাকি বা সূর্যডিম আম চাষের একটি সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে। আগামী দিনে আমাদের হর্টিকালচার সেন্টারের মাধ্যমে এসব আমগাছ সারাদেশে কৃষকপর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলেন, সূর্যডিম আমটি দেখতে অনেক সুন্দর। পাকলে লাল রঙ হয় এবং পাকার আগে রঙ থাকে গোলাপি। আমটি খেতেও অনেক সুমিষ্টি। জাপানে এই আম গ্রিনহাউসের মধ্যে চাষ করা হয়। সে দেশের বিভিন্ন রাজকীয় অনুষ্ঠানে অতিথিদের এই আম দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়ে থাকে। তিনি বলেন, সূর্যডিম আমের সম্প্রসারণ নিয়ে আমরা কাজ করছি। হর্টিকালচার সেন্টারের মাধ্যমে এটিকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
অধিদপ্তরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ড. মো. মেহেদী মাসুদ বলেন, ২০১৬ সালে থাইল্যান্ড থেকে আমরা এগ অব দ্য সান বা সূর্যডিম আমের কিছু আঁটি দেশে এনেছিলাম। পরে সেগুলোকে ৭৫টি হর্টিকালচার সেন্টারে পাঠানো হয়। তার পর আঁটি থেকে হওয়া গাছগুলোকে মাতৃবাগান হিসেবে রোপণ করা হয়।
তিনি বলেন, সূর্যডিম আমের চাষ সারাদেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে আমরা কাজ করছি। এ লক্ষ্যে এক হাজার গাছের কলম করা হচ্ছে, তা চাষিদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। এর পাশাপাশি তাদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে। যারা ছাদবাগান করছেন, তাদেরও এই আমগাছ লাগানোর ব্যাপারে উৎসাহী করা হচ্ছে। তবে এখনো কলম বিক্রির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আগামী দুই বছরের মধ্যে আমরা কৃষকপর্যায়ে এই আমের চারা বিতরণ করতে পারব বলে আশা রাখছি। সে ক্ষেত্রে সূর্যডিম আমের চারার দাম ১০০ টাকার বেশি হবে না, এটি আমি বলতে পারি।
ফল ধরার বিষয়ে জানতে চাইলে ড. মো. মেহেদী মাসুদ বলেন, ঠিকমতো চারাগুলো যত্ন করার কারণে দুই বছরের মাথায় অর্ধেক গাছে আম ধরেছে। একেকটি গাছে আপাতত পাঁচ-সাতটি করে আম ধরেছে। তবে আমরা এখনো এই আমের গড় উৎপাদন সেভাবে ঠিক করতে পারিনি। একটি গাছে পরিপূর্ণভাবে এই আম আসতে পাঁচ থেকে ছয় বছর সময় লেগে যায়। আমের গড় ওজন ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।
জানা গেছে, খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে মহালছড়ি উপজেলা। উপজেলার ধুমনিঘাট এলাকায় ৩৫ একর জায়গাজুড়ে ‘ক্রা এ্এ এগ্রোফার্ম’ গড়ে তুলেছেন কৃষক হ্ল্যাশিমং চৌধুরী। ২০১৬ ও ১৭ সালে মিয়াজাকি আমের চাষাবাদ শুরু করেন তিনি। মিয়াজাকির অন্য নাম সূর্যের ডিম বা এগ অব সান।
সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ১২০০ ফুট উঁচুতে ক্রা এ্এ এগ্রোফার্ম। পাহাড়ের ঢালু অংশে সারি সারি মিয়াজাকি জাতের আমের গাছ। প্রতিটি গাছের বয়স ৩ থেকে ৪ বছর। প্রতিটি গাছেই এবার আম ধরেছে। একেকটি গাছে ৩০ থেকে ৪০টি পর্যন্ত আম দেখা গেছে। প্রতিটি আমের ওজন প্রায় ৩০০ গ্রাম। পুরো আম লাল রঙে মোড়ানো। রঙিন এই আম দেখতে অনেকেই বাগানে ভিড় করছেন।
কয়েকজন দর্শনার্থী জানান, রঙিন আম দেখতেই এখানে এসেছি। মিয়াজাকি আম খাগড়াছড়িতে এর আগে কোথাও চাষ হয়নি। আমটি দেখতেও সুন্দর এবং খেতেও সুমিষ্ট।
কৃষক হ্ল্যাশিমং চৌধুরী জানান, আমার বাগানে প্রায় ৬০ প্রজাতির আম রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আমি প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে এ জাতের আমের আবাদ শুরু করেছি। চার বছর আগে দেশের বাইরে চারা সংগ্রহ করে থেকে মিয়াজাকি আমের চাষাবাদ করেছি। মিয়াজাকি মূলত বিদেশি জাতের আম। এটি বিশ্বের সবচেয়ে দামি আম হিসেবে বিবেচিত হয়।
তিনি বলেন, বিদেশি প্রজাতি হওয়ায় আমরা ভিন্নপদ্ধতি অবলম্বন করে আমটি চাষাবাদ করেছি। পাহাড়ের ঢালুতে এর আবাদ করেছি। রোপণের চার বছর পর ভালো ফলনও পেয়েছি। আমটির রঙ অত্যন্ত সুন্দর। দাম বেশি হওয়ায় এটি স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হয় না। দেশের বিভিন্ন সুপার শপে এটি পাওয়া যাবে। অনেক শৌখিন ক্রেতাও আমটি বাগান থেকে কিনে নিয়ে যান। তিনি আরও বলেন, পাহাড়ি অঞ্চলের কৃষকরা এটি চাষ করে লাভবান হতে পারবেন।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সূর্যডিম বা মিয়াজাকি হলো জাপানিজ আম। বিশ্ব বাজারে এটি ‘রেড ম্যাংগো’ নামে পরিচিত। এটি বিশ্বের সবচেয়ে দামি আম। আমটির স্বাদ অন্য আমের চেয়ে প্রায় ১৫ গুণ বেশি। আমটি খেতে খুবই মিষ্টি। আমটির গড় ওজন প্রায় ৭০০ গ্রামের মতো। বিশ্ববাজারে এর দাম প্রায় ৭০ ডলার বা ৬ হাজার টাকা। সে হিসেবে প্রতি ১০ গ্রাম আমের দাম ১ ডলারের মতো। অনেক কৃষক নতুন এ জাতের আম চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।
খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুন্সী রাশীদ আহমেদ জানান, সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে মিয়াজাকি জাতের আমের আবাদ শুরু হয়েছে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে দামি আম। গায়ের রঙ এবং আকারের কারণে এটিকে সূর্যের ডিম বলা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি ও আবহাওয়াতে মিয়াজাকির ফলন অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। প্রাকৃতিকভাবে রঙিন হওয়ায় এ আম দেখতেও বেশ সুন্দর। সুস্বাদু হওয়ায় এই আমের দামও বেশি।
তিনি জানান, বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করে আমাদের দেশের কৃষক লাভবান হবেন। চাষাবাদ পদ্ধতিতে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। বাজারে প্রচলিত আমের তুলনায় এর দাম কয়েকগুণ বেশি। পাহাড়ি অঞ্চলে কৃষকরা এ জাতের আম চাষ করে লাভবান হতে পারবেন।
খাগড়াছড়ি হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক কিশোর কুমার মজুমদার বলেন, বর্তমানে প্রচলিত জাতের পাশাপাশি বিদেশি জাতের আম চাষাবাদে কৃষকরা আগ্রহী হচ্ছেন। খাগড়াছড়িতে প্রথমবারের মতো জাপানি আম মিয়াজাকির চাষাবাদ শুরু হয়েছে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে দামি আম হিসেবে বিবেচিত। পাহাড়ের আবহাওয়ায় এটি চাষাবাদ উপযোগী। পরবর্তীতে হর্টিকালচারের সেন্টারের মাধ্যমে এটি কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়া হবে।