সময় সংবাদ লাইভ রিপোর্টঃ পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি তার মেয়েকে নিয়ে শিশু বিশেষজ্ঞকে দেখাতে এসেছিলেন। ডাক্তারের দেখা শেষ হতেনা হতেই ওষুধ কোম্পানির এক বিক্রয় প্রতিনিধি কেড়ে নেন তার ব্যবস্থাপনাপত্র। তারপর ছবি তুলেন।
ওষুধ বিক্রয় প্রতিনিধির এমন আচরণে প্রথমে ভয় পেয়ে যান সাইফুল ইসলাম । তিনি ছবি তোলার কারণ জানতে চান। তবে কি কি ঔষধ চিকিৎসক লিখেছেন তা দেখতে ছবি তুলেছি বলে জানিয়ে দেন ওই বিক্রয় প্রতিনিধি। এভাবেই প্রতিদিনি রোগি ও তাদের অভিভাবকদের বিরক্ত করে চলেছে তারা।
এমনকি সারা বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গুলোতেও কোন নিয়ম-কানুন মানছেন না ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা (মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ)। যখন-তখন তারা দল বেধে ঢুকে পড়ছেন চিকিৎসকের কক্ষে। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গিয়ে দেখছেন রোগির জন্য দেয়া চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র। এছাড়াও ওষুধ কিনতে যাওয়া রোগিদের স্বজনদের রাস্তায় ধরে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র দেখছেন এবং ছবি তুলছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকেরা ওষুধ বিক্রয় প্রতিনিধিদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন। এতে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম দূর্ভোগ পোহাচ্ছেন ।
অভিযোগ আছে, রোগীরা চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বাইরে আসার সাথে সাথে ওষুধ বিক্রয় প্রতিনিধি ও তাদের এজেন্টরা ব্যবস্থাপত্র নিয়ে শুরু করেন টানাহেঁচড়া। নিজেদের কোম্পানির ওষুধ না লিখলে চিকিৎসকের কাছে অনেকে কৈফিয়ত চাইতে দ্বিধা করেন না। একাধিক নামিদামি ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধি একাধিক ডাক্তারের সাথে খারাপ আচরণ করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে হাসপাতালে সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা কোন আদেশ মানছেন না। তারা হাসপাতালের বাইরে ব্যাগ রেখে অনায়াসে রোগীর দর্শনার্থী সেজে ভেতরে ঢুকে পড়ছেন। আর এরই মাঝে তারা কাজ সেরে নিচ্ছেন। প্রতিদিন দুপুর ২টার পর মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ প্রবেশের অনুমতি রয়েছে। তবে শীর্ষস্থানীয় দুই-একটি ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ ছাড়া এ নিয়মনীতি কেউ মানছেন না। নানা কৌশলে সকাল ৯টায় তারা ভেতরে ঢুকে পড়েন। এরপর বিভিন্ন ভাবে রোগীর ব্যবস্থাপনা পত্রের ছবি নিতে ব্যস্ত হয়ে যায় তারা।
মেডিকেলের কলেজ হাসপাতালের বর্হিবিভাগের একধিক সূত্র জানিয়েছেন, বর্হিবিভাগে সব সময় মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের থাকে জটলা। চিকিৎসকদের কক্ষ থেকে রোগীরা বেড়িয়ে এলেই প্রেসক্রিপশন নিয়ে টানাহেঁচড়া করেন বিভিন্ন কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি। এতে অনেক রোগী ভয়ে আঁতকে ওঠেন।
চিকিৎসকের কক্ষের সামনে দায়িত্বরত কর্মচারি জানান, নির্ধারিত সময়ের বাইরে চিকিৎসকের সাথে দেখা করতে তারা কখনও সাদামাটা পোশাকে আবার কখনও রোগী সেজে চেম্বারে ঢুকে পড়েন।
জানা গেছে, বর্তমানে প্রায় এক লাখ মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানিতে চাকরি করছেন। প্রতিটি কোম্পানি থেকে বিক্রয় প্রতিনিধিদের ওপর একটি চাপ থাকে নির্দিষ্ট ওষুধের বিক্রি বাড়ানোর। আর ওষুধের বিক্রি বাড়ানো ও লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ওপর নির্ভর করে তাদের চাকরি, প্রমোশন এবং বেতন-কমিশন।
একারণে প্রেসক্রিপশনে প্রতিটি কোম্পানির প্রতিনিধিরা ওষুধ লেখাতে অনেক সময় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। চিকিৎসকদের ম্যানেজ করতে প্রয়োজনীয় উপহার কোম্পানির পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হয়। আর এ কারণেই চিকিৎসকেরা তাদের পছন্দের কোম্পানির ওষুধ লিখতে প্রভাবিত হন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বিক্রয় প্রতিনিধি জানান, প্রতি সপ্তাহে তাদের একটা টার্গেট দেয়া হয়। ওই টার্গেট অনুপাতে চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন কিনা, তাও মনিটরিং করতে হয়। প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাস করানোর জন্য মোবাইলে প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে রাখতে রোগীর প্রেসক্রিপশন দেখতে হয়। আর এ জন্য তাকে সকাল থেকে হাসপাতালে থাকতে হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চিকিৎসকরা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে উপহার নেয়া। এসব উপহার সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে ঘরের ফার্নিচার, এসি, ফ্রিজ, টেলিভিশন, ল্যাপটপসহ নানা দামি জিনিসপত্র। এছাড়াও নমুনার নামে রয়েছে একগাদা ফ্রি ওষুধ। এর ফলে চাপে পড়ে চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ লিখছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বর্হিবিভাগের একজন অধ্যাপক সময় সংবাদ লাইভকে জানান, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মেডিকেল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া আইন করেছে ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে উপহার নিলে বিভিন্ন মেয়াদে চিকিৎসা সনদ বাতিলের। তবে বাংলাদেশে অদ্যাবধি এ সংক্রান্ত কোন আইন তৈরি হয়নি।
তবে তিনি বলেন, বাজারে নতুন ওষুধ এলে ওষুধের জেনেটিক নাম এবং ব্রান্ডের নাম জানতে চিকিৎসকরা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের ওপর নির্ভর করেন। তবে তারা আজকাল এতা বেপরোয়া হয়ে উঠছে যে তারা বিভিন্ন ওষুধের নামের সীল করে দিচ্ছে যাতে করে তা লিখে।
নূর আমিন, সময় সংবাদ লাইভ