সময় সংবাদ লাইভ রিপোর্টঃ তিন মাস ধরে বেসরকারি ঋণের পালে যে হাওয়া বইছিল, হঠাৎ তার ছন্দপতন হয়েছে। ফের বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্নে এসে ঠেকেছে।আগের নেয়া ঋণের টাকা ফেরত আসছে না। ফলে নতুন করে ঋণ দেয়ার মতো ঝুঁকি অনেক ব্যাংকই আর নিতে চাইছে না। এ কারণে নতুন করে নতুন গ্রাহককে ঋণ দেয়া ছেড়ে দিয়েছে অনেক ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টাকা ফেরত আসবে এমন গ্রাহককেই বাছাই করেই ঋণ দেয়। কিন্তু যে গ্রাহক টাকা ফেরত দেবে না, তাকে কে ঋণ দেবে? এখন তো ঋণ নিয়ে ফেরত না দিলেও খেলাপি বলা যাচ্ছে না। ফলে ঋণের টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ যে কমিয়ে দিয়েছে, তার প্রমাণ মেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় অক্টোবরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ প্রায় এক শতাংশ কমে গেছে। অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, ব্যাংক কর্মকর্তারা সেটাকে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি বলছেন। ছোট ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমরা ব্যাংক থেকে ঋণ পাই না। ব্যাংকে গেলে বলা হয়, ঋণ দেয়া বন্ধ। সাধারণ ও ছোট উদ্যোক্তাদেরকে ব্যাংকগুলো আগেও পাত্তা দেয়নি, এখন তো বলে ঋণ দেয়ার মতো নাকি টাকা নেই।
সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ বিতরণ করার ফলে করোনাভাইরাস মহামারির মাঝে অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোর সঙ্গে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহেও গতি ফিরছিল। কিন্তু তিন মাস ধরে বেসরকারি ঋণের পালে যে হাওয়া বইছিল, হঠাৎ তার ছন্দপতন হয়েছে। ফের বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্নে এসে ঠেকেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় ব্যাংকগুলোর এই অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। যদিও এক মাস আগে অর্থাৎ গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে এই বছরের সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি ঋণ বিতরণ করেছিল ব্যাংকগুলো। আর আগস্টে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ২০ শতাংশ। জুনে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবর শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ১৪ হাজার ৩২ কোটি ২৪ লাখ টাকা, যা গত বছরের অক্টোরের চেয়ে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি। সেপ্টেম্বরের শেষে বেসরকারি খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ১৩ হাজার ৮২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত এক মাসে এক হাজার কোটি টাকাও বিতরণ করেনি ব্যাংকগুলো।
এদিকে গত এক বছরে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংক। অর্থাৎ অক্টোবরের শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ১৪ হাজার ৩২২ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ২০১৯ সালের অক্টোবরের শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২৫ হাজার ৯৫৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, টাকা ফেরত আসবে এমন গ্রাহককেই বাছাই করেই আমরা ঋণ দেই। কিন্তু যে গ্রাহক টাকা ফেরত দেবে না, তাকে কে ঋণ দেবে? এখন তো ঋণ নিয়ে ফেরত না দিলেও খেলাপি বলা যাচ্ছে না। ফলে ঋণের টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। আগের নেয়া ঋণের টাকা ফেরত আসছে না। ফলে নতুন করে ঋণ দেয়ার মতো ঝুঁকি অনেক ব্যাংকই আর নিতে চাইছে না। এ কারণে নতুন করে নতুন গ্রাহককে ঋণ দেয়া ছেড়ে দিয়েছে অনেক ব্যাংক।
শুধু বেসরকারি খাতেই নয়, সরকারি খাতেও ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমেছে। অক্টোবর মাসের শেষে সরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৯১ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা, যা গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ২৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি। গত সেপ্টেম্বরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। পরিসংখ্যান বলছে, গত ১০ বছর ধরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্ক বা ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। তবে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের পর গত বছরের নভেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো তা ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে নেমে আসে। ধারাবাহিকভাবে এই প্রবৃদ্ধি কমতে কমতে গত এপ্রিলে ৯ শতাংশের নিচে নেমে আসে। ওই মাসে বেসরকারি ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমে যায়। গত জুনে তা আরও কমে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে নেমে আসে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ছোটদের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিলের ঋণ খুব একটা বিতরণ করেনি ব্যাংকগুলো। অন্য প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণও খুব একটা বিতরণ হয়নি। এছাড়া গত কয়েক মাসে প্রণোদনার বাইরে অন্য কোনও ঋণ বিতরণ হয়নি। তবে করোনাকালে সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, সেগুলোর বাস্তবায়নে গতি আসায় গত কয়েক মাস বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছিল। তবে নিরাপদে মুনাফা পেতে বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মহামারির কারণে অর্থনীতি নিম্নগামী হলেও বেড়েই চলেছে বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ।
এদিকে করোনা পরিস্থিতিতে বিল ও বন্ডের সুদহার দুই থেকে এক-চতুর্থাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। তারপরেও কমছে না বিনিয়োগ। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার মধ্যে অন্যান্য খাতের ঋণের তুলনায় বিল ও বন্ডে বিনিয়োগে ব্যাংকগুলোর আগ্রহ তুলনামূলকভাবে বেশি। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ করে কেউই ঝুঁকি বাড়াতে চায় না। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংক খাতে আগস্টের শেষে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। গত দুই মাসে এ অলস অর্থের পরিমাণ আরও বেড়েছে।
এ বিষয়ে এক ব্যাংক কর্মকর্তা সময় সংবাদ লাইভকে বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজ ছাড়া অন্য কোনও খাতে ঋণ বিতরণ হচ্ছে না। বিশেষ করে বেসরকারি খাতের ঋণ বিতরণে কোনও অগ্রগতি নেই। তাই বেশিরভাগ ব্যাংকই এখন বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বন্ড ও বিলে তিন লাখ দুই হাজার ৭৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ব্যাংক। এর মধ্যে দুই লাখ ৪২ হাজার ২১৮ কোটি টাকার বন্ড ও ৫৯ হাজার ৮৬০ কোটি টাকার বিল বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এক বছরের ব্যবধানে বিল ও বন্ডে ৮০ হাজার ২৩৮ কোটি ৩২ লাখ টাকার বিনিয়োগ বেড়েছে ব্যাংকের। বিল ও বন্ডে ২০২০ সালের জুন শেষে দুই লাখ ৭৯ হাজার ৬০১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে ব্যাংক। আগের বছরের একই সময়ে এই বিনিয়োগ ছিল এক লাখ ৯৯ হাজার ৩৬৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
জানা গেছে, ৯১, ১৮২ ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে দেশের ব্যাংক খাত থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেয় সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, করোনা পরিস্থিতিতে সরকারি এসব বিলের সুদহার নামিয়ে এনেছে এক-চতুর্থাংশে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ছিল সাত দশমিক ১২ শতাংশ। অক্টোবরে তা নেমেছে ১ দশমিক ৫৪ শতাংশে। ট্রেজারি বিলের মতোই সুদহার কমেছে বন্ডেরও। জানুয়ারিতে দুই বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের গড় সুদহার ছিল ৮ দশমিক ২২ শতাংশ। অথচ অক্টোবরে তা ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। একইভাবে ৫, ১০, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডেরও সুদহার কমেছে।