সময় সংবাদ রিপোর্টঃ আরবি চান্দ্র মাসগুলোর মধ্যে বিশেষ একটি মাস হলো রজব। রজব মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘মুরাজ্জাব’। রজব শব্দের অর্থ সম্মানিত। ইসলাম আগমনের আগে জাহেলি যুগের লোকেরা এই মাসকে অন্য মাসের তুলনায় অধিক সম্মান করত। এ জন্য তারা এ মাসের নাম রেখেছিল রজব। এই মাসকে মুসলিম উম্মাহর প্রতীক্ষার মাস রমজানের আগমনীবার্তা বলা হয়। রজবের নিরুত্তাপ বহমান বাতাসে প্রাণ ফিরে পায় মু’মিনের হৃদয়। জান্নাতি খুশবুর ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। সুরের কলতানে দুলতে থাকে মাতোয়ারা মন মহান প্রভুর শানে।
রজবের পরেই ‘শাবান’ এসে আল্লাহর বান্দার হৃদয়কে প্রশান্তিময় রহমতের শীতল ছায়ায় ঢেকে দেয়। আরবি এ মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘আশ শাবানুল মুআজজম’ অর্থ- মহান শাবান মাস। রজব ও শাবান হলো জোড়া মাস। এই দুই মাসদ্বয়কে একত্রে রজবান বা রবাইন অর্থাৎ- রজবদ্বয় বলা হয়। কোনো কোনো বর্ণনায় বহুবিধ কল্যাণের সম্মিলন বলে অভিহিত করা হয়েছে। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ সা: রমজানের আগের এই দুই মাসজুড়ে বেশি বেশি নফল ইবাদত ও রোজা রাখার অভ্যাস করতেন। ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী, রজব মাস হলো আল্লাহর তায়ালার মাস, শাবান হলো নবীজীর মাস, আর রমজান হলো উম্মতের মাস। তাই ইসলামিক স্কলার আবু বকর আল-বালখি রমজানের প্রস্তুতির ব্যাপারে একটি চমৎকার উপমা তুলে ধরেছেন। রজবে মুসলিম উম্মাহ বেশি বেশি ইবাদতের মাধ্যমে মনের জমিনকে চাষাবাদ করবেন। শাবান মাসজুড়ে আরো বেশি নফল ইবাদত ও রোজার অভ্যাস তৈরি করে মনের জমিনে বীজ বপন করবেন। আর রমজানে সিয়াম সাধনা ও কিয়ামুল লাইলের মাধ্যমে সফলতার ফসল ঘরে তুলে আনবেন।
রজবের শুরু থেকেই রাসূল সা: একে একে সব ব্যস্ততা কমিয়ে এনে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল হতেন এবং প্রিয় মাস রজমানের জন্য প্রহর গুনতেন। হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, পশ্চিম আকাশে রজবের চাঁদ দেখা গেলেই রাসূল সা: আবেগময় কণ্ঠে মহান রবের দরবারে দোয়া করতেন- ‘আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফি রাজাবা ওয়া শাবান ওয়া বাল্লিøগনা রামাদান।’ অর্থ- ‘হে আল্লাহ আমাদের জন্য রজব ও শাবান মাসকে বরকতময় করে দিন। আর আমাদের হায়াত রমজান মাস পর্যন্ত পৌঁছে দিন।’ (সুনানে নাসায়ি ও মুসনাদে আহমাদ)
এভাবেই রজবের দিন-রাত অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রতীক্ষা করতেন রাসূল সা: ও সাহাবিরা। শাবান এলেই প্রতীক্ষার সাগরে জোয়ারের তীব্রতা আরো বেড়ে যেত। হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- হজরত রাসূলুল্লাহ সা: শাবান মাসের (দিন-তারিখের হিসাবের) প্রতি অধিক লক্ষ রাখতেন, যা অন্য মাসের ক্ষেত্রে রাখতেন না। (সুনানে আবু দাউদ-২৩২৫) তাই শাবান মাসে এলে আরো বেশি নফল ইবাদত ও রোজা পালন করতেন আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ সা:।
হজরত উম্মে সালমা রা: বলেন, আমি হজরত রাসূলুল্লাহ সা:-কে শাবান ও রমজান মাস ছাড়া অন্য কোনো দুই মাসে একাধারে রোজা রাখতে দেখিনি। (সুনানে আবু দাউদ-২৩৩৬)
হজরত আয়েশা রা: বলেন, আমি নবী করিম সা:-কে শাবান মাসের মতো এত অধিক নফল রোজা আর অন্য কোনো মাসে রাখতে দেখিনি। এ মাসের সামান্য কয়েক দিন ছাড়া সারা মাসই রোজা রাখতেন। (সুনানে তিরমিজি-৭৩৭)
অন্য হাদিসে ইরশাদ করা হয়েছে- হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সা:-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল সা: রমজানের পর কোন মাসের রোজা সবচেয়ে বেশি ফজিলতপূর্ণ? উত্তরে তিনি বলেন, ‘শাবান মাসের রোজা রমজানের সম্মানার্থে’। (সুনানে তিরমিজি-৬৬৩)
সাহাবি ও নবিপতœীরাও বেশ গুরুত্বসহকারে শাবানে রমজানের প্রস্তুতি নিতেন। যারা শাবানে রোজা রাখতেন না রাসূল সা: তাদের রমজানের পরে অতিরিক্ত দু’টি রোজা রাখতে উপদেশ দিতেন। এ বিষয়ে হজরত ইমরান ইবনে হুসাইন রা: থেকে একটি হাদিস বর্ণিত আছে, রাসূল সা: কোনো একজনকে বলেছিলেন, ‘হে অমুকের পিতা! তুমি কি শাবান মাসের শেষ দিকে রোজা রাখোনি? তিনি বললেন, না। এ কথা শুনে নবীজী বললেন, তাহলে তুমি রমজানের পরে দু’টি রোজা রেখে দিও।’ (বুখারি ও মুসলিম)
ঝরনার ফোয়ারার মতো আগমন ঘটে মাসের সেরা মাস রমজানের। আসমানি কিরণে উদ্ভাসিত হয় দিলের জমিন। অবারিত ধারায় প্রবাহিত হয় রহমের বৃষ্টিধারা। খুলে যায় রহমের দরজা। ইবাদতের বসন্তকাল রমজানের জন্য অপেক্ষায় থাকে বিশ্বাসীরা।
প্রিয় মুসলিম উম্মাহ! রজব শেষে শাবানও আমাদের দরজায় কড়া নেড়েছে। রমজানের আলোয় আলোকিত হতে এখনই শ্রেষ্ঠ সময় নিজেকে তৈরি করার। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত, প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততা কমিয়ে এনে রমজানের প্রস্তুতি নেয়া। কুরআন তিলাওয়াত, নফল রোজা ও তাহাজ্জুদের সময় বের করা। এখন থেকেই আল্লাহ রাব্বুুল আলামিনের কাছে আবেগময় দোয়া করা, যাতে করে তিনি আমাদেরকে আরেকটি রমজানের সাক্ষী হিসেবে কবুল করেন। মুয়াল্লা ইবনুল ফাদল বলেন, ‘তারা রমজানের ছয় মাস আগে থেকেই দোয়া করতেন যাতে করে আল্লাহ তাদেরকে রমজানে পৌঁছে দেন ও রমজানের সাক্ষী বানান।’
বিশ্বজুড়ে অশান্তির দহনে জ্বলছে প্রতিটি আত্মা। শুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে মু’মিন হৃদয়। আত্মার শুষ্কতা কাটাতে সিয়াম আসছে প্রশান্তিময় বৃষ্টি হয়ে। মরুভূমির ধুলো মলিন বালুকণা পরিণত হয় সবুজে ঘেরা বৃক্ষরাজিতে। আর সেই বৃক্ষের ছায়ায় বসে ফল-ফলাদি উপভোগ করবে বিশ্বাসী প্রাণ।