সময় সংবাদ রিপোর্ট : দুনিয়ার জীবন বড়ই মায়াময়, আকর্ষণীয়। এর চাকচিক্যময় হাতছানি মানুষকে প্রলুব্ধ করে। যদিও এর স্থায়িত্ব কম। ক্ষণস্থায়ী হলেও দুনিয়ার প্রেমে মানুষ মশগুল হয়ে পড়ে। অথচ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘দুনিয়ার জীবন তো প্রতারণাকর জিনিসের ভোগ ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৮৫) ‘যারা নিজেদের দ্বীনকে খেল-তামাশা হিসেবে গ্রহণ করে এবং দুনিয়ার জীবন যাদের প্রতারিত করে রাখে, আপনি তাদেরকে বর্জন করুন। আর এই কুরআন দ্বারা তাদের সতর্ক করুন, উপদেশ দিন, যাতে কোনো ব্যক্তি নিজের কৃতকর্মের কারণে ধ্বংস হয়ে না যায়।’ (সূরা আনয়াম : ৭০)। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সতর্ক করে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘হে মানুষ! নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদের প্রতারিত না করে। আর বড় প্রতারকও (শয়তান) যেন তোমাদেরকে আল্লাহর ব্যাপারে প্রতারিত না করে। শয়তান তোমাদের শত্রু। অতএব তাকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ করো। সে তো তার অনুসারী দলবলকে আহ্বান জানায়, যেন তারা সায়িরের (জাহান্নাম) পথিক হয়ে যায়।’ (সূরা ফাতির : ৫-৬)।
আমরা জানি, দুনিয়ার জীবন প্রথম ও শেষ জীবন নয়; বরং জীবনের ধারাবাহিকতায় একটি স্টেশন মাত্র। রূহের জগৎ থেকে আলমে আখেরাত অর্থাৎ রূহের জগতে আমাদের অস্তিত্বের সূচনা আর আখেরাতের জগতই আমাদের শেষ এবং আসল ঠিকানা। মাঝখানে দুনিয়ার এ জীবন। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী এ জীবনের যাত্রা সমাপ্তির মাধ্যম হলো ইন্তেকাল বা মৃত্যু। স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার যেন শেষ নেই। ক্ষণিকের এ জীবনে কত জল্পনা কল্পনা। কিন্তু মালাকুল মাউত হাজির হয়ে গেলে সব কিছুর পরিসমাপ্তি হবে।
‘বলুন, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পলায়ন করো, সে মৃত্যু তোমাদের সাথে অবশ্যই সাক্ষাৎ করবে। অতঃপর তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে অপ্রকাশ্য ও প্রকাশ্যের জ্ঞানী আল্লাহর কাছে। অতঃপর তোমরা যা আমল করতে সে সম্পর্কে তিনি তোমাদের জানিয়ে দিবেন।’ (সূরা আল-জুমা : ৮)। ‘জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদনকারী। তারপর তোমরা আমারই কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সূরা আল-আনকাবুত : ৫৭) ‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য এক নির্দিষ্ট সময় আছে। যখন তাদের সময় আসবে তখন তারা মুহূর্তকালও পিছাতে বা এগোতেও পারবে না।’ (সূরা ইউনুস : ৪৯)
হজরত আমর বিন মাইমুন রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেছেন, এক লোককে উপদেশ দিতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, পাঁচটি বিষয়ের আগে পাঁচটি বিষয়ের কদর করো। (তন্মধ্যে একটি হলো) মৃত্যু আসার আগে জীবনের। (তিরমিজি) হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, দুনিয়ার স্বাদ-গন্ধকে বিলুপ্তকারী মাউতকে তোমরা বেশি বেশি স্মরণ করো। (তিরমিজি)
আসুন একটু আত্মপর্যালোচনা করি। যারা নিজেকে মুসলিম হিসেবে দাবি করি, পরিচয় উপস্থাপন করি আমরা নিজেদেরকে কী বদলাতে পেরেছি? মাউতের জন্য আমরা কী প্রস্তুত? কেননা জীবন আর মৃত্যু; আল্লাহ তায়ালা বিনা কারণে সৃষ্টি করেননি। কুরআনের অমিয় বাণী- ‘যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য; তোমাদের মধ্যে কে আমলের দিক থেকে উত্তম? তিনি মহাপরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল। (সূরা আল-মূলক : ২) সূরা আলে ইমরানের ১০২ আয়াতে কারিমায় ঈমানদারদের উদ্দেশে আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিয়েছেন- এবং তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।
বাবা মুসলিম। তাই আমরাও মুসলিম। আসলে মুসলিম পরিবারে জন্ম নিলেই প্রকৃত ও পরিপূর্ণ মুসলিম হওয়া যায় না। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পালন এবং নিষেধ বর্জনই আমাদের মুসলিম বানাতে পারে। রাসুলূল্লাহ সা:-এর দেখানো পথ তথা সিরাতে মুস্তাকিমে অটল অবিচল থাকতে পারলেই আমরা নিজেদেরকে মুসলিম হিসেবে গড়ে তুলতে পারব। আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা- ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ করো। (সূরা আল-বাকারাহ : ২০৮)
আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ আমরা অহরহ অমান্য করি। অথচ দাবি করি আমরা মুসলিম। মিথ্যার সাথে আমাদের বসবাস। আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিয়েছেন- ‘এবং মিথ্যা কথা থেকে দূরে থাকো।’ ( সূরা আল-হাজ্জ : ৩০) হজরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, তোমরা মিথ্যাচার থেকে বেঁচে থাকো, কেননা মিথ্যা পাপের দিকে আর পাপ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়।
(বুখারি ও মুসলিম) দুনিয়ায় একটু সুযোগ সুবিধা কিংবা ক্ষমতা প্রতিপত্তি পেলেই আমরা অহঙ্কারী হয়ে যাই। আর আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিয়েছেন- ‘জমিনে গর্বের সাথে চলবে না। নিশ্চয়ই তুমি মাটিকে ফাটিয়ে দিতে পারবে না এবং পাহাড়ের সমান উঁচু হতেও পারবে না।’ (সূরা বনি-ইসরাইল : ৩৭) হজরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত- নবী করিম সা: বলেছেন, যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহঙ্কার রয়েছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (হাদিসের শেষ দিকে বলা হয়েছে) অহঙ্কার হলো, গর্বভরে সত্যকে অস্বীকার করা এবং মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা। (মুসলিম) এ ছাড়াও বড় কিংবা ছোট গুনাহ আমরা অহরহ করছি। হিংসা, মুনাফেকি আচরণ, জুলুম, সুদী কাজকর্ম, মদ, জুয়া, যেনা-ব্যভিচার, সন্ত্রাস, অবৈধ উপার্জন ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মতো গুনাহ করে যাচ্ছি। এর পরও দাবি করছি আমরা মুসলমান।
প্রকৃত মুসলিম হতে হলে খাঁটি ও পূর্ণ মুমিন হওয়া জরুরি। হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন- যে ব্যক্তির মধ্যে তিনটি জিনিস পাওয়া যাবে, সে ঈমানের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করেছে। এক. তার মাঝে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মহব্বত, দুনিয়ার সব বস্তু অপেক্ষা বেশি হবে। দুই. যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তিকে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মহব্বত করে এবং তিন. যে ব্যক্তি কুফরির অন্ধকার থেকে বের হয়ে ঈমান ও ইসলামের আলো গ্রহণ করার পর আবার কুফরির অন্ধকারে ফিরে যাওয়াকে এত মন্দ মনে করে যেমন মনে করে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে। (বুখারি ও মুসলিম)
কে ক’দিন এই দুনিয়ায় আছি জানি না! তাই আসুন, নিজেকে প্রস্তুত করি। অনন্তকালের জগতে যেন সফল হতে পারি। আলমে আখেরাতে যেন চিরশান্তিতে থাকতে পারি। জান্নাতের সুশীতল ছায়াতলে যেন আশ্রয় পাই। আসুন, আল্লাহর ভয়ে ভীত হই। রাসূলের আদর্শকে উসওয়ায়ে হাসানাহ হিসেবে গ্রহণ করি। হককে আঁকড়ে ধরি। সবর, ক্ষমা ও বিনয়ের গুণে গুণান্বিত হই। সালাতসহ ফরজ ইবাদতে যতœবান থাকি। সুন্নত কিংবা নফলের ব্যাপারেও যেন গাফিল না থাকি। আল্লাহ তায়ালা তাওফিক দিন। দ্বীনের আলোয় আমাদের জীবনকে আলোকিত করুন। সবাইকে ভালো ও হেফাজতে রাখুন।