রমজান রহমত, বরকত আর মাগফেরাতের মাস। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের কাছে রমজান পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ মাস। রমজান মানুষকে মূলত সংযম শিক্ষা দেয়। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘রমজান মাসে এলে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয়, জাহান্নামের দ্বারসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়।’ এত গুরুত্বপূর্ণ রমজান মাসের মূল ইবাতদ হলো রোজা। দৃশ্যত রোজা হলো, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকা।
ধর্মীয় বিবেচনা বাদ দিলেও বছরের নির্দিষ্ট একটা সময় উপোস করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। আমরা যে সুস্থ থাকার জন্য ডাক্তারের কথা শুনে ডায়েটিং করি। রোজা তো সেই ডায়েটিংয়েরই ধর্মীয় বিন্যাস। রোজার মূল চেতনা হলো সংযম। তবে এই সংযম শুধু না খেয়ে থাকার নয়, এ সংযম হলো আত্মশুদ্ধির। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মাৎসর্য- সব ধরনের রিপু থেকে নিজেকে সংযত রাখাই, পরিপূর্ণ সংযম। শুধু জিহবার সংযম নয়, হতে হবে আত্মার সংযম। কী করলে রোজা ভাঙবে, কী করলে রোজা পোক্ত হবে; তার বিস্তারিত বিবরণ আছে ধর্মে। কিন্তু আমরা খালি সকাল-সন্ধ্যা উপোস থাকাকেই রোজা হিসেবে ধরে নিয়ে আত্মপ্রসাদে ভুগি। মুখে বলিও, এবার অনেক গরম পড়েছে, এবার দিন বড়, রোজা রাখতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। সারা বছর পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ পড়েন না, কিন্তু রমজানে খতমে তারাবিতে মসজিদে নিয়মিত যান, এমন মানুষের সংখ্যা অনেক। ইসলামে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ, মানে অবশ্য কর্তব্য। তারাবি ফরজ নয়, তবে পড়লে অনেক সওয়াব হবে। আর প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ না পড়লে গুনাহ হবে। তাই আগে বছরজুড়ে আল্লাহর বিধান মেনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে প্রকৃত মানুষের মতো জীবন যাপন করা সব মুসলমানের জন্য অবশ্য কর্তব্য। শুধু এক মাসের জন্য মৌসুমি মুসলমান হওয়া কতটা কার্যকর তা নিয়ে তর্ক হতে পারে।
রমজানে সংযমের যে ধারণা, তার সঙ্গে সংযমের প্রকৃত চেতনার মিল খুব সামান্যই। আমি অনেককে চিনি, যারা রোজা রেখে সারা দিন সময় কাটান হিন্দি সিনেমা দেখে। রোজা রেখে ঘুষ খান, মিথ্যা কথা বলেন, মানুষের ক্ষতি করেন, দুর্নীতি করেন; এমন মানুষ তো ভুরি ভুরি। বরং রমজান এলে ঘুষের রেট বেড়ে যায়। পুলিশের ঈদ বাণিজ্য চলে দেদারসে। অন্য দেশের কথা জানি না, বাংলাদেশে রমজানে সবচেয়ে অসংযমী আচরণ হয়। রমজান এলেই ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেন নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের। অন্য সব রিপু সংযমের কথা না হয় বাদই দিলাম, খালি খাওয়ার সংযমের কথাই যদি বলি, তাহলেও এরচেয়ে অসংযমের মাস আর নেই। অন্য সাধারণ মাসের তুলনায় রমজানে খাওয়ার পেছনে আমাদের দেশের মানুষের খরচ অনেক বেশি হয়। রমজানে আমরা এমন অনেক খাবার খাই, যা সারা বছর খাই না। আরবের খোরমা খেজুর ছাড়া আমাদের ইফতার হয় না। ছোলা, বেগুনি, জিলাপি, হালিম- এমন অনেক আইটেম আছে; যা সারা বছরে যা বিক্রি হয়, রমজানে হয় তার কয়েকগুণ বেশি। বছরে একটা নির্দিষ্ট সময় উপোস থাকা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কিন্তু উপোস ভেঙে আমরা ইফতারে যে খাবার খাই, তা মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। সারা দিন না খেয়ে যতটুকু উপকার হয়, ইফতারে ভাজা-পোড়া, তৈলাক্ত খাবার খেয়ে ক্ষতি হয় তার চেয়ে অনেক বেশি।
বাংলাদেশে রমজানে সবচেয়ে অসংযমী আচরণ হয়। রমজান এলেই ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেন নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের। অন্য সব রিপু সংযমের কথা না হয় বাদই দিলাম, খালি খাওয়ার সংযমের কথাই যদি বলি, তাহলেও এরচেয়ে অসংযমের মাস আর নেই। অন্য সাধারণ মাসের তুলনায় রমজানে খাওয়ার পেছনে আমাদের দেশের মানুষের খরচ অনেক বেশি হয়। ইসলাম একটি বিজ্ঞানসম্মত জীবনবিধান। একজন মানুষ যদি ইসলামের সবগুলো বিধান নিয়ম করে মেনে চলেন, তাহলে তিনি অবশ্যই শারীরিক-মানসিকভাবে সুস্থ ও উন্নত মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠবেন।
ইসলামের পাঁচ ফরজের একটি হলো নামাজ। করোনা ভাইরাস আসার পর বার বার হাত ধোয়া আর পরিচ্ছন্ন থাকার কথা বলেছিল। আর ইসলাম কিন্তু চৌদ্দ শ’ বছর আগে দিনমান পরিচ্ছন্ন থাকার উপায় বাতলে দিয়েছে। দিনে পাঁচবার নামাজ পড়তে হলে হয় আপনাকে হয় সারাদিন পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, নয় অন্তত সব নামাজের আগে অজু করে পরিচ্ছন্ন হতে হবে। তার মানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লেই আপনি মোটামুটি সারাদিন পরিচ্ছন্ন থাকবেন। ইসলামে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে ঈমানের অঙ্গ বলা হয়। খাবার আগে হাত ধোয়া নিশ্চিত করতে আমরা কত আয়োজন করি, কত বিজ্ঞাপন বানাই। ইসলাম অনুসরণ করলে পরিচ্ছন্ন থাকতে আপনাকে আর আলাদা করে ভাবতে হবে না। পরিচ্ছন্ন থাকলে আপনি দূরে থাকবেন বিভিন্ন ভাইরাস থেকে। পরিচ্ছন্ন থাকলে ইউরিন ইনফেকশন থেকে রক্ষা পাবেন। পেটের, লিভারের, কিডনির নানা অসুখ থেকেও আপনি রক্ষা পাবেন। এত কিছু পেতে আপনাকে কিছুই করতে হবে না, শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরতে হবে। নিয়মিত নামাজ পড়তে হলে আপনাকে ভোরে উঠতে হবে।
ভোরে উঠলে যে স্বাস্থ্য ভালো থাকে, সেটা নিশ্চয়ই আলাদা করে বলার দরকার নেই। ভোরে যদি আপনি মসজিদে নামাজ পড়তে যান, মর্নিং ওয়াকটা পেয়ে যাবেন বোনাস। আর সকালের প্রকৃতিতে যে বিশুদ্ধ অক্সিজেন থাকে তার কোনো মূল্য হয় না। স্বাভাবিক সময়ে ভোরে ঘুম থেকে উঠে মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে এলে আপনার মনে যে ফুরফুরে পবিত্র ভাব আসবে তা বদলে দিতে পারে আপনার দিনটাই। কারো রক্তে চিনি বেশি, কারো বা কোলেস্টেরল। ডাক্তারের পরামর্শে কেউ হাঁটে, কেউ সাঁতরায়, কেউ জিমে যায়, কেউ ডায়েটিং করে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লে আপনাকে জিমে যেতে হবে না, মর্নিং ওয়াকও হয়তো করতে হবে না। আমি বলছি না, নিয়মিত নামাজ পড়লেই আপনার কোনো অসুখ হবে না। কিন্তু ডাক্তাররা এখন আপনাকে যা বলেন, ১৪শ বছর আগেই ইসলাম তা বলে রেখেছে।
ইসলামে মিথ্যা বলা মহাপাপ। একবার ভাবুন সব মুসলমান যদি সত্যি কথা বলেন, তাহলেই তো সমাজের অনেক সমস্যা মিটে যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের দেশে যারা ইসলামের কথা বলেন বেশি, তারাই ইসলামের অবমাননাও করেন সবচেয়ে বেশি। মজুদদারি, মানুষ ঠকানো, ঘুষ খাওয়া ইসলামে পাপ। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা সত্যিকারের ইসলাম অনুসরণ করি না। এমন অনেকে আছেন, নিয়মিত নামাজ পড়েন ঠিকই। কিন্তু নামাজ পড়েই ঘুষ খান, লোক ঠকান, দেদারসে মিথ্যা কথা বলেন। তার নামাজ কি আল্লাহ কবুল করেন? বাংলাদেশের মুসলমানদের অনেকের মধ্যে একটা প্রবণতা দেখি, সারাজীবন ঘুষ খাওয়া, লোক ঠকানো, মিথ্যা বলা- সব পাপ ইচ্ছামতো করি। আর শেষ বয়সে মক্কা শরিফে গিয়ে হজ করে হজরে আসওয়াদে চুমু খেয়ে ভাবি সারা জীবনের সব পাপ বুঝি মুছে গেল। কী হাস্যকর ভাবনা! এমন পরিকল্পনা করে পাপমোচনের ব্যবস্থা ইসলামে আছে বলে মনে হয় না। আমরা অনেকেই নামে মুসলমান। কিন্তু আচার-আচরণে ইসলামবিরোধী। ইসলাম আমাদের পরমতসহিষ্ণুতা শেখায়, পরধর্মসহিষ্ণুতা শেখায়।
শুধু ব্যক্তি নয়; পরিবার, সমাজ, ইসলামের সত্যিকারের চেতনার প্রয়োগে এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও আসতে পারে দারুণ পরিবর্তন।সরকারকে অবশ্যই দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। তবে সরকার কী করল, তা ভাবার আগে যদি আমি কী করলাম, সেটা আগে ভাবি; তাহলে সবকিছু অনেক সহজ হয়ে যায়। ইসলাম আমাদের সবাইকে নিয়ে বাঁচতে শেখায়। ঈদের কেনাকাটা কম করে বাড়তি অর্থটা কোনো দরিদ্র পরিবারকে দিয়ে দেই,সেই পরিবারটি বেঁচে যায়। যদি বাজারটা একটু কম করে, পাশের জনকে সাহায্য করি; তার পেটে দুটি দানা পড়ে। রমজান হোক সত্যিকারের সংযমের, এবারের রমজান হোক মানবতার।