সময় সংবাদ লাইভ রির্পোটঃরূপগঞ্জের পূর্ব চনপাড়ার ৭ নম্বর ওয়ার্ড। বড় সড়ক পেরিয়ে সরু গলিপথ ধরে শেখ রাসেলনগর নামের একটি এলাকা। এ এলাকায় মন্ত্রণালয়ের একজন সচিব থাকেন। তার বাড়িটিও সবার চেনা। জিজ্ঞাসা করতেই একজন দেখিয়ে দিলেনÑ ‘ওই যে চারতলা’। প্রথম দেখাতেই বোঝা যায়, ১৩৩৬ নম্বর হোল্ডিংয়ে আধুনিক নির্মাণশৈলীর চারতলা এ ভবনটি এলাকার আরও দশটি ভবনের চেয়ে ভিন্ন। এর বাইরে আরও দুটি বাড়ি রয়েছে তারÑ যার মধ্যে একটি নির্মাণাধীন। শুধু এ তিন বাড়িই নয়, কোটি কোটি টাকার আরও অনেক সহায়-সম্পত্তি রয়েছে এ সচিবের। স্থানীয়দের জবানিতে পাওয়া গেল এসব।তথ্য। কিন্তু স্থানীয়রা যা জানেন, তার সবটুকু সত্যি নয়। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, তিনি আসলে সচিব নন, ছিলেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী; চাকরিচ্যুত হয়েছেন জালিয়াতির অপরাধে। অর্থাৎ সচিব পরিচয়টি স্রেফ নকল। তবে কোটি কোটি টাকার বিত্ত-বৈভবের খবর কিন্তু মিথ্যে নয়। আসলেই তিনি অঢেল সম্পত্তির মালিক।
তার নাম মো. আবদুস সোবহান শেখ। এলাকায় খুবই প্রভাবশালী তিনি। চাকরি দেওয়াসহ বিভিন্ন সুযোগসুবিধা বা কাজ আদায় করে দেওয়ার কথা বলে তিনি অনেকের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিলেও বিনিময়ে চাকরি বা কাজ দিতে পারেননি। টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না। স্থানীয় যাদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তারা ধরে নিয়েছেন এ প্রতিবেদকও তেমনই এক পাওনাদার।
তথ্যমতে, সোবহান শেখ ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন জালিয়াতির মামলায়। কিন্তু সচিব পরিচয়ে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। কখনো তিনি মন্ত্রীর এপিএস, কখনো তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, কখনো বনে যান সচিবের উপদেষ্টা। এসব পরিচয়ে নিজেকে সমাজে ক্ষমতাবান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এরপর সরকারি জমির লিজ, ঝামেলা মেটানো, বিভিন্ন জনকে চাকরি দেওয়ার নাম করে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। অন্তত আটজন ভুক্তভোগী এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, সোবহান শেখকে বিশ^াস করে তারা প্রতারিত হয়েছেন। সর্বস্বান্ত হয়েছেন আর্থিকভাবে। বছরের পর বছর তার পেছনে ঘুরেও সেই টাকা ফেরত পাননি। উল্টো টাকা ফেরত চাওয়ায় হুমকি দেওয়া হচ্ছে প্রাণনাশের।
পুলিশের এসআই পদে আবেদন করেছিলেন জহিরুল ইসলাম কিরণ। ১৫ লাখ টাকায় চাকরি নিশ্চিতÑ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব পরিচয় দানকারী সোবহান শেখের এমন প্রলোভনে পা দিয়ে এখন নিঃস্ব এই যুবক। তার কাছ থেকে শুরুতেই হাতিয়ে নেওয়া হয় ৯ লাখ টাকা। তিন বছর ধরে সোবহানের কাছে ধরনা দিয়েও ফেরত পাননি টাকা। বিভিন্ন সময়ে টাকা দেওয়ার কথা বললেও এখন দিচ্ছেন হুমকি-ধমকি। প্রতিবন্ধী বোন, পিতা ছাড়া সংসার বড্ড এলোমেলো। আর্থিক দুরবস্থা, পারিবারের দেখাশোনা আর সামাজিক চাপ কাবু করে ফেলেছে জহিরুল ইসলাম কিরণকে। তিনি যাদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন, তাদের চাপে গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতেও যেতে পারছেন না কিরণ। ভীষণ আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, আমার বেঁচে থাকার কোনো পথ নেই। নানা জনের কাছ থেকে ধারকর্জ করে টাকাগুলো সোবহানের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। উনি সচিব পরিচয় দিয়েছিলেন। ওই সময় তিনি যেভাবে যা বলেছেন, তার সবই করেছি। এখন বুঝতে পারছি, ভুল করেছি। বছরের পর বছর সোবহানের পেছনে পেছনে ঘুরছি। পরিবারের ভরনপোষণ, প্রতিবন্ধী বোন আর পাওনাদারের চাপে আমি কোনো পথ দেখছি না। অনেক কান্নাকাটি করেছি। সোবহানের মন গলেনি।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকার আমজাদ হোসেন ব্যাপারীকে সরকারি জমি লিজ নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন আশ্বাস দিয়ে সোবহান শেখ নিয়েছেন তিন লাখ টাকা। জমি পাননি আমজাদ, টাকাও ফেরত পাননি। আমজাদ বলেন, একটি ব্যাংকে ছোট পদে চাকরি করতাম। এখন অবসরে। ভেবেছিলাম কিছু জমি লিজ নিয়ে ব্যবসা করে সংসারে সচ্ছলতা আনব। কিন্তু এখন পাওনা টাকাই পাচ্ছি না।
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার হাসান আল মামুনকে সরকারি চাকরি দেওয়ার প্রলোভনে নিয়েছিলেন ৫ লাখ টাকা। চাকরি দিতে না পেরে জাজিরা সদরের টিঅ্যান্ডটি মোড়ের সরকারি জমি লিজ এনে দেবেন বলে নিয়েছেন আরও ৩ লাখ টাকা। প্রতিশ্রুত কিছুই পাননি হাসান আল মামুন। বলেন, আমার সরকারি চাকরির বয়স শেষ। সোবহানের প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে সব হারিয়েছি। এখন টাকাও দিচ্ছে না, দিচ্ছে হুমকি-ধমকি।
শেখ রাসেলনগরের বাড়িতে আব্দুস সোবহান শেখ থাকেন না। সেখানে পাওয়া গেল তার প্রথম স্ত্রী ও সন্তানকে। তারা সোবহানের বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি। প্রতিবেশীরা বলেন, প্রায় দিনই এ বাড়িতে পাওনাদারদের আসতে দেখা যায়। কিন্তু সোবহান সাহেব ইদানীং এখানে তেমন একটা আসেন না।
রাজধানী ও এর আশপাশে সোবহান শেখের রয়েছে বাড়ি, প্লট, ওয়ার্কশপ, আধুনিক সেলুনসহ নানা ব্যবসা। গাজীপুরের বাসন থানার হক মার্কেট এলাকায় রয়েছে বহুতল ভবন। সেখানেও স্থানীয়রা তাকে চেনেন সচিব হিসেবে। সোবহানের বিরুদ্ধে তাদেরও রয়েছে প্রতারণার বিস্তর অভিযোগ। চাকরি দেওয়ার কথা বলে সেখানেও অনেকের কাছ থেকে কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়েছেন। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ১৪ নং ওয়ার্ডের চন্দ্রপাড়া গ্রামের এক ভুক্তভোগী জানান, চাকরি দেওয়ার কথা বলে এক যুগেরও বেশি সময় আগে বিএনপি সরকারের আমলে টাকা নিয়েছেন সোবহান। চাকরি হয়নি, টাকাও ফেরত পাননি। সূত্র বলছে, রাজধানীর সায়েদাবাদেও চারতলা একটি বাড়ি রয়েছে তার। এছাড়া নাখালপাড়ায় টিনশেড ঘরসহ জমি, গুলিস্তানের এরশাদ মার্কেটে বেশ কয়েকটি দোকান এবং গোপালগঞ্জের কাশিয়ানিতে বাড়ি, জমি ও দোকান রয়েছে তার। আরও বেশ কয়েকটি প্লট, বাড়ি ও ফ্লাটের তথ্য পাওয়া গেলেও সেসব সম্পদের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, চতুর আব্দুস সোবহান বিপুল পরিমাণ টাকা আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। এত এত সম্পদের সাথে একাধিক বিয়েও করেছেন তিনি। রাজধানীর লালমাটিয়ার ব্লক বিতে রয়েছে ফ্ল্যাট। সেখানে তার এক স্ত্রী থাকেন। সেই বাসায় গিয়ে অবশ্য সোবহান শেখকে পাওয়া যায়নি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুস সোবহান শেখ সময় সংবাদ লাইভকে বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ, সন্তানরা ঠিকমতো খেতে পায় না। কোনো টাকা-পয়সা নাই। কোনো বাড়ি বা জমি নেই।’
চনপাড়ার চারতলা বাড়িটি আপনার, এমন তথ্যপ্রমাণ রয়েছেÑ এ কথায় সোবহান বলেন, ‘ছোট্ট একটু জমি। সরকারি জমি, দলিলপত্র নেই। বাস্তুহারা। ধারকর্জ করে ইট গেঁথেছি। কোনোরকমে একটা বাড়ি তুলেছি। পাশে দুটি সরকারি পুনর্বাসন প্লট রয়েছে। সেখানে খুব কষ্ট করে বাড়ি তুলতেছি। এখনো কমপ্লিট হয়নি।’
গাজীপুরের বাড়ির বিষয়ে বলেন, ‘বাড়িটি অল্প টাকায় কিনেছিলাম। এরপর ধারকর্জ করে তিনতলা করেছি। খুব অল্প ভাড়া পাই।’
লালমাটিয়ার ফ্ল্যাট ও অন্যান্য ব্যবসার বিষয়ে বলেন, ‘লালমাটিয়ার ফ্ল্যাটটি সরকারি জমিতে স্ত্রী লটারিতে পেয়েছিলেন। একটা সেলুন ও ওয়ার্কশপ রয়েছে। মানুষ দিয়ে করাই। কোনোরকমে বেঁচে আছি। কাল কি খাব, তা জানি না।’
চাকরি দেওয়ার নামে টাকা আত্মসাতের বিষয়টি প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে সোবহান শেখ বলেন, ‘সামান্য কিছু টাকা একটা বিষয়ে নিয়েছিলাম একজনের কাছ থেকে। সেই টাকা গ্রামের জমি বিক্রি করে শোধ করে দেব।’ পরে তিনি আরও কিছু মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করলেও ভুক্তভোগীদের গালমন্দও করেন। প্রতারণার মামলার বিষয়ে বলেন, ‘মামলায় জালিয়াতির বিষয়ে কিছু লেখা নেই। ওইটা ছিল হয়রানিমূলক মামলা।’
সময় সংবাদ লাইভ।