সময় সংবাদ রিপোর্ট : খুলনায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়ায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলার মানুষ। আজ শনিবার খুলনা মহানগরীর সোনালী ব্যাংক চত্বরে হবে এ সমাবেশ। সমাবেশের একদিন আগে গতকাল শুক্রবার থেকে ‘বাস ধর্মঘটের’ পাশাপাশি শুরু হয় যাত্রীবাহী ‘লঞ্চ ধর্মঘট’। এর ফলে ট্রেন যোগাযোগ বাদ দিলে খুলনা মহানগর কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। চিকিৎসা কিংবা অন্যান্য জরুরি কাজে গন্তব্যে পৌঁছতে পারেনি বহু মানুষ। মারাত্মক সমস্যায় পড়েন নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া লোকজন। এজন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে।
বিএনপির অভিযোগ, দলটির গণসমাবেশ সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ঠেকাতেই সরকারি দলের নির্দেশেই ধর্মঘটের নামে গণপরিবহন বন্ধ করে দেয় বাস ও লঞ্চের মালিক-শ্রমিকরা। শুধু তাই নয়, সমাবেশে অংশগ্রহণ ঠেকাতে পথে পথে বাধা, হামলা, বাড়ি বাড়ি পুলিশের অভিযান, গ্রেপ্তার, হুমকি-ধমকি দেওয়ার মতো কাণ্ড করা হচ্ছে বলে বিএনপির স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতারা অভিযোগ করেছেন। তবে প্রতিকূল পরিবেশ ঠেলেই খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার বিএনপির নেতাকর্মীরা সমাবেশ যোগ দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। বিশেষ করে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, নড়াইল, মাগুরা, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট- এই নয় জেলার নেতাকর্মীরা মরিয়া হয়ে দলের গণসমাবেশে যোগ দিতে যাচ্ছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
খুলনা গণসমাবেশ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এই সমাবেশকে কেন্দ্রে করে খুলনায় সরকার একটা সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। পথে পথে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার করছে। খুলনার সমাবেশে যেন বাধা সৃষ্টি করা না হয়, সে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যদি কোনো রকম সমস্যা তৈরি করা হয়, তার দায় সম্পূর্ণভাবে সরকারকে নিতে হবে। তিনি অভিযোগ করেন, বৃহস্পতিবার রাতে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় খুলনায় যে বাড়িতে অবস্থান করেন, সেখানে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ রামদা, লাঠিসোটা, অস্ত্র নিয়ে শোডাউন করেছে, মোটরসাইকেল নিয়ে বিভিন্নভাবে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। এসবের নিন্দা জানান বিএনপি মহাসচিব।
দলীয় নেতাকর্মীরা জানান, সব বাধা উপেক্ষা করে শুকনা খাবার-পানি সঙ্গে নিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল, ট্রলার, ট্রেনে চড়ে যে যেভাবে পারছেন খুলনার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। আন্তঃজেলা বাস বন্ধ থাকায় নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশ গত বৃহস্পতিবার রাতে রওনা দিয়ে শুক্রবার সূর্য ওঠার আগেই খুলনায় পৌঁছেছেন।
অন্যদিকে বিভিন্ন জেলা থেকে খুলনায় পৌঁছে নেতাকর্মীদের বিকালেই দলের মহানগর কার্যালয় ও আশপাশে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে দেখা গেছে। এই অবস্থায়ও নেতাকর্মীরা রাজপথে থাকবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন খুলনা সমাবেশের দায়িত্বে থাকা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায়। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা। এসব এখন তোয়াক্কা করি না।’
আজ খুলনা মহানগরের সোনালী ব্যাংক চত্বরে বিভাগীয় গণসমাবেশের ডাক দিয়েছে বিএনপি। জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, দলীয় কর্মসূচিতে পাঁচ নেতাকর্মীকে হত্যার প্রতিবাদ, খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয়, নিরপক্ষে সরকারের দাবিতে খুলনার এই সমাবেশ বিএনপির তৃতীয় গণসমাবেশ।
জানা গেছে, খুলনার সমাবেশের একদিন আগে গতকাল শুক্রবার থেকে ‘বাস ধর্মঘটের’ পাশাপাশি খুলনায় শুরু হয় যাত্রীবাহী লঞ্চ ধর্মঘট। ১০ দফা দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার জন্য ধর্মঘট শুরু করে লঞ্চ শ্রমিক ইউনিয়ন। এর ফলে খুলনা থেকে দক্ষিণ দিকে (দাকোপ, কয়রা, সাতক্ষীরা) যাতায়াতের সব লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
এর আগে শুক্র ও শনিবার দুই দিনের পরিবহন ধর্মঘট ডাকে জেলা বাস, মিনিবাস, কোচ, মাইক্রোবাস মালিক সমিতি। সংগঠনটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ধর্মঘটের কারণ হিসেবে নছিমন, করিমন, ভটভটি, ইজিবাইকসহ সব অবৈধ যান চলাচল বন্ধের দাবির কথা বলা হলেও বিএনপি বলছে, তাদের গণসমাবেশ বাধাগ্রস্ত করতেই এ ধর্মঘট।
সমাবেশকে সামনে রেখে গতকাল শুক্রবার খুলনা মহানগর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, সমাবেশ বানচাল করতে বিভাগজুড়ে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম মনা বলেন, বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে নগরজুড়ে পুলিশের ধরপাকড় শুরু হয়েছে। বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত ৬৩ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সভাপতি সৈয়দ মেহেদী রুমী বলেন, আমাদের নেতাকর্মীরা ট্রেন, প্রাইভেটকার, ট্রাক, মোটরসাইকেলে করে খুলনার দিকে যাচ্ছে। সরকার বাস বন্ধ রেখে আমাদের নেতাকর্মীদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না।
অভয়নগর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী গোলাম হায়দার বলেন, খুলনার গণসমাবেশে বিএনপির নেতাকর্মীরা যেন না যান, সেজন্য পুলিশ উপজেলা বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতার বাড়ির সামনে মহড়া দেয়।
কুষ্টিয়া কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে খুলনা-যশোরগামী কোনো যাত্রীবাহী বাস চলাচল না করায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। তানিয়া খাতুন নামে এক যাত্রী বলেন, হুট করে এমন বাস বন্ধের ফলে বাস টার্মিনালে এসে ফিরে যেতে হচ্ছে। রফিকুল ইসলাম নামে আরেক যাত্রী জানান, বাস বন্ধ থাকায় ট্রেনে যেতে হবে।
মেহেরপুরের সাধারণ যাত্রীরা চরম বিপাকে পড়েন। অনেকে গন্তব্যে যেতে না পেরে বাড়ি ফিরে গেছেন। কেউ কেউ ছোট যানবাহনে ভেঙে ভেঙে খুলনার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মাইক্রোবাসচালক বলেন, জেলা বিএনপির কয়েকজন নেতা কয়েক দফা যোগাযোগ করেন মাইক্রোবাস ভাড়া নিতে। কিন্তু নিষেধ থাকায় ভাড়ায় যাওয়া হয়নি।
বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, গণপরিবহন বন্ধ থাকায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে আসা পরীক্ষার্থীরা। নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে আসা এক পরীক্ষার্থী বলেন, ‘আমি বড় ভাইয়ের সঙ্গে বের হয়ে কোনো যানবাহন না পাওয়ায় হাঁটতে শুরু করেছি।
মাগুরা প্রতিনিধি জানান, বাস চলাচল বন্ধ থাকায় বিএনপি নেতাকর্মীরা মোটরসাইকেলে খুলনা যাচ্ছেন। জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আক্তার হোসেন বলেন, মাইক্রোবাস ভাড়া না পেয়ে নেতাকর্মীদের একটি অংশ বৃহস্পতিবার রাতে খুলনায় গেছেন। খুলনার সোনাডাঙ্গা থানাপুলিশ মাগুরার শ্রীপুর উপজেলা বিএনপির ১০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে বলে জানান আক্তার হোসেন।