সময় সংবাদ লাইভ রিপোর্টঃ : ইন্টারনেট ব্যবহার বা অনলাইনে মানুষের অভ্যস্ততা বাড়ার সঙ্গে দেশে সাইবার অপরাধের ঘটনাও বাড়ছে। এ ধরনের অপরাধ রোধে একাধিক আইন থাকলেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিশেষ করে নারীরা সাইবার অপরাধের শিকার বেশি হচ্ছেন বলে পুলিশের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়। এ কারণে নারীদের সুরক্ষায় পৃথক ইউনিট গঠন করে তাদের সুরক্ষা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ। পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাইবার অপরাধে সারাদেশে এখন পর্যন্ত ৬ হাজার ৯৯টি মামলা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারের ঘটনা কিছুটা কমলেও এখনও তা আশঙ্কাজনক।
* সাইবার অপরাধ দমনে দেশে চারটি আইন।
* সাইবার অপরাধের শিকার ৭৩ শতাংশই নারী
* আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হয় না ৮০ ভাগ মানুষ
বিশ্বব্যাপী এ বছর করোনার প্রাদুর্ভাবে ইন্টারনেটের বহুমাত্রিক ব্যবহার যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। ফলে সাইবার অপরাধীদেরও আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস (সিসিএ) ফাউন্ডেশন কর্তৃক ব্যক্তি পর্যায়ে চালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ভার্চুয়াল জগতে দেশের প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের লক্ষ্য করে বর্তমানে ১১ ধাপে সাইবার অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। যার মধ্যে চারটি নতুন ধরনের অপরাধ। আশঙ্কার কথা হচ্ছে, সাইবার অপরাধের শিকার হওয়ার পরও ৮০ ভাগ ভুক্তভোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হয় না। সাইবার ক্রাইম একটা বাউন্ডারিলেস (সীমাহীন) ক্রাইম।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, দেশের ১১ কোটি মানুষ সেলফোন ব্যবহার করে। ৭ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। জাতিসংঘের একটি জরিপে দেখা যায়, বিশ্বে তিন চতুর্থাংশ নারীরাই হয়রানির শিকার হন। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা যেভাবে আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তেমনই বিভিন্ন সমস্যারও সৃষ্টি করছে। সে সব সমস্যা মোকাবিলায় পুলিশের এ সেবা। দেশে সাইবার অপরাধ দমনের জন্য অনেক আইন রয়েছে। এর মধ্যে ডিজিটাল সিকিউরিটি আ্যাক্ট, পর্নোগ্রাফি আ্যাক্ট, টেলিকমিউনিকেশন কন্ট্রোল আ্যাক্ট, আইসিটি আ্যাক্ট। সাইবার ওয়ার্ল্ডকে নিরাপদ করার জন্য বাংলাদেশ সরকার এই সমস্ত আইনগুলো প্রচলন করেছে। এই আইনগুলোতে ৬ হাজার ৯৯টি মামলা হয়েছে যার অধিকাংশ ভিকটিমই হচ্ছে নারী। সাইবার ওয়ার্ল্ডে হয়রানির শিকার নারীদের বেশিরভাগ বয়স ১৪ থেকে ২৪ বছর।
পুলিশের পরিসংখ্যানে জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার, অনলাইনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকি এবং ছবি বিকৃত করে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অপরাধের লিঙ্গভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারের শিকারের ক্ষেত্রে নারীর হার ১৬ দশমিক ৩ এবং পুরুষ ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। অনলাইনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকির শিকার হওয়ার মধ্যে ৩ দশমিক ৭২ শতাংশ পুরুষ ভুক্তভোগী হলেও নারীর হার ১৪ শতাংশ। অপরাধের ধরনে তৃতীয় অবস্থানে থাকা ছবি বিকৃতি করে অনলাইনে অপপ্রচারের শিকার হওয়া নারীর হার ১১ দশমিক ২ শতাংশ হলে পুরুষ ৪ দশমিক ১ শতাংশ। এ ছাড়া দেশে ফোনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকি দেওয়া, ই-কমার্স ও এফ-কমার্স, কপিরাইটভিত্তিক সাইবার অপরাধপ্রবণতা রয়েছে।
মোবাইল ফোনের সিমের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের পরও ফোনের মাধ্যমে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। ই-কমার্সের নামে এবং ফেসবুকে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের নামেও প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। সিসিএ ফাউন্ডেশনের গবেষণা বলছে, সাইবার অপরাধে আক্রান্তদের মধ্যে ফোনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকির শিকার হচ্ছেন ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। কপিরাইট লঙ্ঘনের মাত্রা ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ দখল করেছে। অনলাইনে কাজ করিয়ে নিয়ে প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে ১ দশমিক ৪০ শতাংশ। অনলাইনে বিক্রি করা পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে গিয়ে প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ।
দেশে ই-কমার্সের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতারণাও। ভুক্তভোগীদের ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ এই অপরাধের শিকার। পাশাপাশি ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন পেজ থেকে বিক্রি করা পণ্য ডেলিভারি না করে অর্থ হাতিয়ে বিক্রেতার উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাও আলোচিত হচ্ছে। এ ছাড়া পর্নোগ্রাফি এবং অনলাইনে বার্তা পাঠিয়ে সাইবার অপরাধেরও সংখ্যা কম নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুক্তভোগীদের ২২ দশমিক ৩৩ শতাংশই এই ধরনের অপরাধের শিকার হচ্ছেন। ছবি বিকৃত করে অনলাইনে অপপ্রচারের ঘটনা রয়েছে আগের মতোই। এবার এই হার ১৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। জরিপে বয়সভিত্তিক সাইবার অপরাধের শিকার হওয়ার ঘটনা বিশ্নেষণে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। তবে নারীদের ক্ষেত্রে ১৪ থেকে ২৪ বছরের সংখ্যা বেশি।
সাইবার অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সাল থেকে গত ৩১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১২৪টি মামলার রায় ঘোষণা করেছে সাইবার ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ২৯টি মামলায় আসামির সাজা হয়েছে। আর অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় ৯৫টি মামলায় আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়েছেন। এর বাইরে অভিযোগ গঠনের শুনানির দিনেই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন ২০০টিরও বেশি মামলার আসামিরা। প্রতিবছরই সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৯ সালে ৭২১টি, ২০১৮ সালে ৬৭৬টি, ২০১৭ সালে ৫৬৮টি, ২০১৬ সালে ২৩৩টি, ২০১৫ সালে ১৫২টি, ২০১৪ সালে ৩৩টি এবং ২০১৩ সালে এসেছে ৩টি মামলা।
সিআইইডর একটি সূত্র জানায়, সাইবার অপরাধের ঘটনায় সরাসরি মামলা করার সুযোগ তৈরিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অধীনে একটি বিশেষ থানা চালুর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তবে এখনো এর কার্যক্রম শুরু হয়নি। ইতিমধ্যে পুলিশ সদর দফতরে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। সাইবার থানার কার্যক্রম শুরুর আগে সারাদেশে যে সব সাইবার মামলা হচ্ছে সেগুলো কাগজপত্র সংগ্রহ করা হচ্ছে। কার্যক্রম শুরু হলেই মামলাগুলোর তদন্ত করবে সাইবার থানা। ভুক্তভোগীরা দ্রুত সেবা পাবে বলে আমরা আশাবাদী। সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, প্রস্তাবিত এই সাইবার থানার প্রধান হবেন একজন পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ পুলিশ অডিটোরিয়ামে ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন’ নামে একটি ফেসবুক সাইট উদ্বোধনকালে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘সাইবার ওয়ার্ল্ডে অপরাধীরা সবচেয়ে বড় সুবিধা পায় তা হলো নিজের নাম-পরিচয় ও দেশ গোপন রেখে নারীদেরকে হয়রানি করতে পারা। এটিই নারীর প্রতি ডিজিটাল হয়রানির নতুন রূপ। এটি শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বব্যপী একই চিত্র। আইজিপি এক পরিসংখ্যান উল্লেখ করে বলেন, ৭৩ শতাংশ নারী সাইবার বুলিংয়ের শিকার হন। ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, গুগল, ফেক আইডি খুলে, অনলাইন পোর্টাল খুলে, ব্লগে মিথ্যা প্রচারণা ও মানুষের চরিত্র হননের চেষ্টা করা হয়। তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেনের সকল অফিসাররাই হবেন নারী। যারা কল রিসিভ করবেন, পরামর্শ দেবেন, সহয়তা করবেন, তদন্ত করবেন তারা সবাই নারী কর্মকর্তা।’
ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘সাইবার ওয়ার্ল্ডে আমরা দীপ্তভাবে পদচারণা করব কিন্তু সাইবার ওয়ার্ল্ডে যে ঝুঁকি আছে তা প্রত্যেককে সচেতন হওয়া উচিত। অনেক সময় নিজের অজান্তেই সাইবার ওয়ার্ল্ডে হয়রানির শিকার হন সেটাকে আমরা বলি অনিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার। আমরা চায় সবাই নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার করুক। সেফটি ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে জানতে হবে। এরপরেও যদি কোনও ধরনের ঝামেলা হয়ে যায় তাহলে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন নারীদের সহায়তা করতে করবে।