আলমগীর পারভেজ: সীমান্তবর্তী জেলাগুলো করোনার হটস্পট হওয়ায় ব্যাপক আকারে বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা। রোগী বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে শয্যা বাড়িয়েও সংকট মোকাবেলা কঠিন হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় লোকজনের অবাধে আসা-যাওয়ার কারণে বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ঢুকে পড়েছে। একই কারণে করোনা সামাজিক সংক্রমণ ঘটছে। সবখানে ছড়িয়ে পড়ায় বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে স্থলবন্দরগুলো দিয়ে অসতর্কভাবে আসা-যাওয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুতহারে বাড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
জেলা এবং বিভাগীয় হাসপাতালগুলোর সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোগীর চাপ ও আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় রাজশাহী, সাতক্ষীরা,খুলনা ও যশোরের চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে শয্যা এবং লোকবল সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে শয্যা বাড়িয়েও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না রোগী। জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগে করোনায় ২৮ জন মারা গেছেন। সর্বোচ্চ শনাক্তের হার ঠাকুরগাঁওয়ে ৫০ দশমিক পাঁচ তিন শতাংশ। অনেক এলাকায় বিশেষ লকডাউনেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না করোনা। ফলে এই পরিস্থিতি আরও ছড়িয়ে পড়ার আশংকা করছেন চিকিৎসকরা।
সব শেষ খবর অনুযায়ী, করোনা সংক্রমণ রোধে ১৩টি জেলায় এলাকাভিত্তিক লকডাউন ও বিধিনিষেধ দেয় স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু তাতে কোনও কাজ হচ্ছে না। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী, খুলনা, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা দিনাজপুর ও মেহেরপুরে করোনায় মারা গেছেন ২৮ জন। ঈদুল ফিতরের পর থেকেই সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে দ্রুত বাড়তে থাকে করোনা সংক্রমণ। এরই মধ্যে ভারতে শনাক্ত করোনার ডেল্টা ভেরিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ শুরু হওয়ায় দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ার খবর আসছে বিভিন্ন স্থান থেকে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন ১০ জন। এর মধ্যে রাজশাহীর ৭ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর ও নওগাঁয় একজন করে মারা গেছেন। ২৪ ঘণ্টায় ৪০০টি নমুনা পরীক্ষায় ১৬৬ জন শনাক্ত হয়েছেন। হার ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ। মেডিকেলে ৩০৯টি শয্যার বিপরীতে ভর্তি রয়েছেন ৩৫৮ জন রোগী। আইসিইউতে আছেন ২০ জন। এ সব তথ্য জানিয়েছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রি. জে. শামীম ইয়াজদানী।
ধারণা করা হচ্ছে, চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহীতে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। আর চাঁপাই নবাবগঞ্জে করোনা এসেছে সোনা মসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে অবাধে ভারত থেকে আসা যাওয়ার কারণে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় নাটোর ও সিংড়া পৌরসভায় দ্বিতীয় দফা লকডাউন ৭ দিন বাড়ানো হয়েছে। জেলায় শনাক্তের হার ১২.৫ শতাংশ।
খুলনা করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে ৫ জন করোনায় ও ২ জন উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। তাদের মধ্যে খুলনার ৪ জন, বাগেরহাটের দুজন ও যশোরের একজন। ২৪ ঘণ্টায় ৬৫৬টি নমুনা পরীক্ষায় ১৮১ জন শনাক্ত। হার ২৭ শতাংশ। ১৩০ শয্যার বিপরীতে ভর্তি আছেন ১৫৯ জন। আইসিইউতে ১৯ জন। চাপ সামলাতে সদর হাসপাতালে ৭০টি শয্যার করোনা রোগী ইউনিট সোমবার থেকে চালু আছে বলে জানান খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আরএমও ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার।
রোগীর পরিমাণ বাড়তে থাকায় আড়াইশ’ শয্যার সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে পূর্ণ করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘোষণা করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় ১৮৬টি নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত ৮৮ জন। হার ৪৭ শতাংশ। মারা গেছেন ৩ জন। লকডাউনের মধ্যেও এই হারে রোগী বাড়তে থাকলে চাপ সামলানো কঠিন হবে বলে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. কুদরত ই খুদা।
যশোরে মারা গেছেন চারজন। ২৪ ঘণ্টায় ৪৮৮টি নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত ২০৩ জন। হার ৪২ শতাংশ। ৮০ শয্যার করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল ভর্তি ৯১ জন জানান যশোর সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন।
মনে করা হচ্ছে খুলনা বিভাগের জেলাগুলোতে রয়েছে একাধিক স্থল বন্দর। এসব বন্দর এবং স্থলবন্দরের বাইরের অরক্ষিত স্থান দিয়ে ভারতে আসা-যাওয়া বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতের ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত ছড়িযে পড়েছে। সেই ভ্যারিয়েন্ট সীমান্ত জেলা ছাড়িয়ে অন্যান্য জেলাতেও চলে গেছে।
বাগেরহাটের মোংলায় করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি করোনা পজিটিভ নিয়ে গত মঙ্গলবার হাসপাতালে ভর্তি হন। মৃত নারীর নাম মঞ্জুয়ারা বেগম (৫৫)। তিনি বন্দর এলাকার দিগরাজের আবুল শেখের স্ত্রী।
এদিকে, বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০ জন করোনা পরীক্ষা করিয়েছেন। তাদের মধ্যে র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টে ১০ জনের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবারের শনাক্তের হার ৫০ ভাগ। এর আগে বুধবারে ছিল ৪৭ ভাগ।
অপরদিকে, মোংলায় চতুর্থ দফায় ঘোষিত আরও এক সপ্তাহের কঠোর বিধিনিষেধের গতকাল ছিল প্রথম দিন। এদিন সকাল থেকে টানা বৃষ্টিপাতের কারণে অন্য দিনের তুলনায় পৌর শহরের রাস্তাঘাট, দোকানপাট খালি রয়েছে। লোকসমাগম না থাকায় দেখা যায়নি তেমন কোনো যানবাহনও।
ঠাকুরগাঁওয়ে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত বিকেল ৫টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত জরুরি সেবা ছাড়া বন্ধ থাকে সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। এই জেলার শনাক্তের হার ৫০ দশমিক পাঁচ তিন শতাংশ বলে জানান সিভিল সার্জন ডা. মাহফুজার রহমান সরকার।
গতকাল দিনাজপুরে মেডিকেলে মারা গেছেন তিনজন। সংক্রমণের হার ৩৬ দশমিক পাঁচ চার শতাংশ। করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৮১ জন। আইসিইউতে ১৪ জন। শহরের মোড়ে মোড়ে তল্লাশি চৌকি বসানো হলেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে ব্যাপক অনীহা স্থানীয়দের। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর থেকেই সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁয় সংক্রমণ, রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু বাড়ছে। এজন্য গত ৩০ এপ্রিল নওগাঁ সদর জেনারেল হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) জন্য দুটি শয্যার সরঞ্জাম পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু দেড় মাসেও সেগুলো চালু হয়নি, বাক্সবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে। জেলার কোনও হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা না থাকায় তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসা মুমূর্ষু রোগীদের পাঠাতে হয় রাজশাহী কিংবা বগুড়ায়। জানা গেছে সদর ও নিয়ামতপুর ছাড়াও পোরশা,সাপাহার, মহাদেবপুর ও পত্মীতলা উপজেলায় করোনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
মেহেরপুরে করোনা আক্রান্ত ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া লালমনিরহাটে করোনা আক্রান্তের হার ৫০ শতাংশ ও কুড়িগ্রামে ৩৯ দশমিক তিন নয় শতাংশ।
এদিকে কিছুদিন আগেও গ্রামের মানুষের মুখে মুখে একটাই কথা ছিল যে, আমাদের গ্রামে করোনা নেই; আমাদের করোনা ভাইরাস হবে না’। এজন্য তারা মুখে মাস্ক পরা বা অন্য কোনো স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কাই করতেন না। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে পরিস্থিতি ততই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে করোনার প্রকোপ এখন শহর মারিয়ে গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে।
জেলা শহরগুলোতে প্রতিদিনই গ্রাম থেকে আসা করোনা রোগীর চাপ বাড়ছে। সম্প্রতি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (রামেক) ভর্তি করোনায় আক্রান্ত রোগীর ৪০ শতাংশই গ্রামাঞ্চলের। আর করোনায় মৃতদের মধ্যে অধিকাংশাই ভারতের ডেল্টা ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত ছিলেন, বলছেন চিকিৎসকরা।
হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা এখন শুধু শহরেই নয়, বিস্তার ঘটিয়েছে গ্রামাঞ্চলেও। বর্তমানে বয়স্ক মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তরুণদের মৃত্যুর হারও।
চিকিৎসকরা বলছেন, হঠাৎ করেই করোনা আক্রান্ত রোগীর অবস্থা বেশিমাত্রায় খারাপ হয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে আসা রোগীদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন কম থাকছে। শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা হঠাৎ করে বাড়ছে। শারীরিক অবস্থার নানান ধরনগুলো দ্রুতই পরিবর্তন হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা করার সময়ও দিচ্ছে না এই ধরনগুলো। শহরে যেমনভাবে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানা হচ্ছে গ্রামে তা হচ্ছে না। ফলে গ্রামাঞ্চল থেকে এখন বেশি রোগী আসছে। একজন করোনা রোগী সারা গ্রাম মাস্ক ছাড়াই ঘুরছেন। এভাবে অনেক মানুষ আক্রন্ত হচ্ছেন।
এই পরিস্থিতিতে করোনার ঢেউ ঠেকাতে শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও বিধিনিষেধ আরোপের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।