সময় সংবাদ রিপোর্ট: কোভিড ১৯-এর কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের কন্যাশিশুদের স্বাভাবিক জীবনযাপন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, অর্থনৈতিক চাপ এবং পরিসেবার স্বল্পতায় সবচেয়ে অরক্ষিত হয়েছে মেয়েদের স্বাস্থ্যসেবা। এতে সামগ্রিক কল্যাণ ও তাদের ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী ১ কোটি ১০ লাখের বেশি নারী শিক্ষার্থী মহামারীর পরে স্কুলে ফেরার সুযোগ হারিয়েছে। আগামী এক দশকে আরও এক কোটি নারীশিশু বাল্যবিয়ের ঝুঁঁকিতে রয়েছে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতিতে দেশে ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে ‘সাধারণ ছুটির’ আদলে লকডাউন শুরু হয়। এটি দফায় দফায় বাড়িয়ে শেষ হয় ওই বছরের ৩০ মে। এরপরএ ধরনের সাধারণ ছুটি বা লকডাউন দেওয়া না হলেও বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে ছিল গোটা দেশ। এতে দেশের নারীস্বাস্থ্য, নারীশিক্ষা এবং নারীর সামগ্রিক পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। পরিস্থিতির উত্তরণে এই খাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল- ইউনিসেফ গত ৬ মে এক প্রতিবেদনে বলেছে, এপ্রিল মাসে দেশে নতুন করে গর্ভধারণ করেছেন ২৪ লাখ নারী। সংস্থাটির আশঙ্কা, করোনাকালে জন্মকালীন পরিচর্যা এবং অন্তঃসত্ত্বা মা ও শিশুর জীবন রক্ষার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পরে। সংস্থাটি জানায়, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহের হারের তালিকায় বাংলাদেশে অন্যতম। করোনা ভাইরাস দরিদ্র মানুষদের সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে, যার ফলে আরও ১ কোটি কন্যাশিশু এখন বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে।শিশুদের সুরক্ষা এবং অল্পবয়সী মেয়েদের ক্ষমতায়নে সরকারের একটি বড় বাজেট বরাদ্দ দরকার এবং একটি দীর্ঘস্থায়ী শিশু অধিকার সংকট থেকে মুক্তি পেতে এখনই কাজ শুরু করতে হবে।গত ৮ মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদেনে ইউনিসেফ বলছে, কোভিড মহামারীর সময়ে দেশে থেকে থেকে লকডাউন দিতে হয়েছে। এতে কন্যাশিশুদের আরও বেশি সময় তাদের বাড়িতে কাটাতে বাধ্য হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গৃহস্থালি কাজের বেশিরভাগই তাদের কাঁধে নিতে হয়েছে। অনেকে তাদের নির্যাতনকারীর সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে বাধ্য হচ্ছে এবং তাদের সুরক্ষার জন্য সহায়ক এমন সেবা ও কমিউনিটি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকছে। যৌন সহিংসতাসহ লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বাড়ছে।এ বিষয়ে ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল বলেন, প্রকৃতপক্ষে কোভিড ১৯-এর আগেও আমাদের সময়ের সবচেয়ে ব্যাপক ও উল্লেখযোগ্য অবিচার হিসেবে লিঙ্গবৈষম্য টিকে ছিল। মহামারীর প্রভাবে এই অবিচার কয়েকগুণ বেড়েছে। আমরা যখন কোভিড ১৯-এর প্রাদুর্ভাবের তৃতীয় বছরে প্রবেশ করছি। সে ক্ষেত্রে সত্যিকারের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় অবশ্যই লৈঙ্গিক সমতা থাকতে হবে। তিনি বলেন, আমরা মেয়েদের একটি প্রজন্মকে তাদের বাকি জীবনের জন্য এই মহামারীর পরিণাম ভোগ করতে দিতে পারি না। আমরা যখন মহামারীপরবর্তী সময়ের জন্য কাজ করছি, তখন মেয়েদের অবশ্যই বৈশ্বিক, জাতীয় এবং স্থানীয় মহামারী মোকাবিলা ও পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার কেন্দ্রে রাখতে হবে।ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেয়েদের তাদের শিক্ষা পুনরায় শুরুর সুযোগ দিতে স্কুলগুলো খোলা রাখা এবং যারা পিছিয়ে পড়েছে তাদের ঘাটতি পূরণে সহায়তা দিতে প্রয়োজনীয় সম্পদের পেছনে বিনিয়োগ করা। এর অর্থ হলো মেয়েদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকারসহ তাদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় পুনরায় বিনিয়োগ এবং মানসম্মত ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা সেবাগুলো প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মেয়েদের জন্য সুযোগ বাড়ানো। শিশুবিয়ে এবং নারীর যৌনাঙ্গ বিকৃতির মতো ক্ষতিকর চর্চাসহ সব ধরনের সহিংসতা থেকে মেয়েদের রক্ষা করা। কারণ মেয়েদের ক্ষমতায়ন অগ্রশক্তির চালিকাশক্তি। এর ওপর বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা, শান্তি ও সমৃদ্ধি নির্ভর করে।ম্যারি স্টোপসের লিড অ্যাডভোকেসি মঞ্জুন নাহার বলেন, বাল্যবিবাহে বাংলাদেশ যতটা এগিয়েছিল করোনার কারণে ততটাই পিছিয়েছে। এ সময়ে সাতক্ষীরার একটি স্কুলের ৫০ জন শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। সারাদেশের পরিস্থিতি অনেকটাই এ রকম। এতে অনিরাপদ গর্ভধারণ বেড়েছে, পাশাপাশি বেড়েছে অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ। এ সময়ে গর্ভবতী মায়েরা পর্যাপ্ত সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বিশেষ করে গ্রামীণ পর্যায়ে সেবার মান ছিল খুবই অপ্রতুল। তিনি বলেন, দেশে করোনার প্রথম ঢেউয়ের শেষদিকে পারিবারিক সহিংসতা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। এমনকি এই সময়ে বিবাহবিচ্ছেদের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, করোনাকালীন সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কোভিডকেন্দ্রিক হওয়ায় অন্যান্য সেবা বিশেষ করে নারী স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুল হয়ে পড়ে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারীর মানসিক স্বাস্থ্য।