সময় সংবাদ লাইভ রিপোর্ট: একদিন পরই শুরু হচ্ছে মুসলমানদের বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান রমজান। অন্যান্য বছরের ন্যায় এ বছরও আগে থেকেই বেড়ে গেছে নিত্যপণ্যের দাম। চলমান লকডাউনের প্রভাবে ভোক্তার পকেট এখন ফাঁকা, অথচ বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। করোনা ভাইরাসের প্রভাব বাজারে এতটা বিস্তার লাভ করেছে যে, সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার পরও বেড়ে চলছে ভোগ্যপণ্যের দাম।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, কারসাজি করে মুনাফা ঘরে তোলা যাবে না। এ জন্য কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। বিশেষ করে মহাদুর্যোগের সময় কারসাজির কারণে ভোক্তাদের পণ্য কিনতে যাতে কষ্ট না হয়, সে জন্য নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। খোদ বাণিজ্য সচিবও মাঠে নেমেছেন অভিযানে। কারসাজিকারকদের বড় অঙ্কের জরিমানাও করা হচ্ছে। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা শুধু মুনাফার জন্যই বাড়িয়ে দিচ্ছে পণ্যদ্রব্যের মূল্য।
জানা গেছে, রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে ভর্তুকি মূল্যে টিসিবি প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী বিক্রি করছে। বাড়ানো হয়েছে বিক্রির আওতা। পাশাপাশি রমজান মাস সামনে রেখে ছয় পণ্যের আমদানি বাড়ানো হয়েছে। এত কিছুর পরও রোজার আগেই বেড়ে গেছে প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই চাল, ডাল, চিনি ও তেলসহ বেশ কয়েকটি প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের
দাম বেড়ে যায়। এর ওপর রমজান মাস উপলক্ষে নতুন করে মটর ডাল, মসুর ডাল, ছোলাসহ পেঁয়াজ, রসুন ও আদার দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, নিত্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল করতে আজ ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক করবেন বাণিজ্য সচিব। সেখানে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সমস্যা জানা হবে। এ ছাড়া মজুদ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে। তবে পণ্যমূল্য যাতে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়, সে জন্য যা যা করণীয় তা করবে সরকার।
সূত্র জানিয়েছে, গত ১৬ মার্চ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি রোধে একটি টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করেছে। কমিটি গত মঙ্গলবার বৈঠক করেছে। বৈঠকে টিসিবিকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কার্যক্রম পরিচালনা, ট্রাকসেলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আনসার বাহিনী নিয়োগ এবং পণ্যের মজুদ ও চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে আমদানির ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে টাস্কফোর্স কমিটি।
অন্যদিকে বৈঠকে সাপ্লাই চেন অব্যাহত রাখতে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভা, বাজার মনিটরিংয়ের সময় আদার খুচরা ও পাইকারি মূল্য যাচাই এবং পরিবহন সচল রাখতে সড়ক মন্ত্রণালয় ও আইজিপিকে চিঠি পাঠানোর জন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ইফতারের অন্যতম উপকরণ ছোলার দাম এক সপ্তাহে ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজি দরে। রোজা উপলক্ষে অন্যান্য ডালের দামও বেড়েছে। মোটা মসুর ডালের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে আরেক দফা বেড়ে ৮৫ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে যা ছিল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। অন্যদিকে ছোট দানার মসুর ডাল ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। খেসারি ও বুটের ডালের দামও চড়া। বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে।
বেড়েছে আদা, রসুন ও পেঁয়াজের দামও। মাঝে পেঁয়াজের দাম কমে গিয়ে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় নামলেও দেড় সপ্তাহ ধরে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে প্রয়োজনীয় মসলাজাতীয় এ পণ্যটি। কোথাও কোথাও এর থেকেও বেশি দামে বিক্রির খবর পাওয়া গেছে। রসুন কেজিতে ৪০ থেকে ৬০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৭০ টাকা। বাছাই করা ভালো মানের রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা কেজি। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আদার দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে চায়না আদা বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ দামে। বাজারে এখন চায়না আদা ২৯০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর অনেক এলাকায় এর বেশি দামেও আদা বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। অথচ দুই সপ্তাহে আগেও আদা বিক্রি হয়েছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি। এ ছাড়া দেশি আদা প্রতিকেজি ২৫০ থেকে ২৯০ টাকা। দুই সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি। অন্যদিকে প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা কেজি। ভোজ্যতেলের মধ্যে খোলা সয়াবিন ৯৫ টাকা ও পামতেল ৭৫ টাকা লিটার।
বাণিজ্য সচিব মো. জাফর উদ্দীন গতকাল সময় সংবাদ লাইভকে বলেন, রোজায় ব্যবহার হয় এমন সব পণ্যের কোনো সংকট দেশে নেই। এ ছাড়া ওই সময়ের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে আমদানি বাড়ানোসহ যা করণীয়, সরকারের পক্ষ থেকে তার সবই করা হচ্ছে। এ ছাড়া এবার সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা টিসিবির কার্যক্রম আরও বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যে কোনো প্রকারে পণ্যমূল্যের কারসাজি অথবা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। আমি নিজেও মাঠে আছি। সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখা হচ্ছে। ভোক্তা অধিকার কঠোর ভূমিকা নিয়েছে। কারসাজি করে টাকা ঘরে নিতে পারবে না। যেখানে কারসাজি, সেখানেই অভিযান ও জরিমানা করা হবে। করোনার কারণে সব সময় টেলিফোনে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। তবে আদার দামটা একটু বেশি বেড়েছে। বন্দরে কিছুটা সংকট আছে। তা নিরসনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ সুপারদের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে পণ্যের সরবরাহ চেন স্বাভাবিক রাখতে।
ব্যবসায়ীরা জানান, রোজা উপলক্ষে এসব পণ্যের চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট লকডাউন পরিস্থিতিতে বিদেশ থেকে অনেক পণ্যেরই আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে বন্দরে আটকে গেছে অনেক পণ্যের চালান। এ ছাড়া পণ্য পরিবহনেও যোগ হয়েছে নানা ভোগান্তি ও বাড়তি খরচ। সব মিলিয়ে দাম বেড়েছে নিত্যপণ্যের।
এদিকে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৮ টাকা। আর মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১২ থেকে ২০ টাকা। বাজার ঘুরে দেখা যায়, পাইজাম ও লতা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৮ টাকা কেজি। গত সপ্তাহে যা ছিল ৪২ থেকে ৫০ টাকা। আর করোনার আগে ছিল ৩২ থেকে ৩৫ টাকা। নাজির ও মিনিকেট চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৮ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা।
বাবুবাজারের পাইকারি বিক্রেতা জামান উল্লাহ বলেন, কুষ্টিয়ার বিভিন্ন মোকামে এখন চাল স্থানীয়রা ত্রাণ ও খাদ্য বিতরণ কর্মসূচির জন্য কিনে নিচ্ছে। ফলে মোকাম ব্যবসায়ীরা বেশি দামে তাদেরকেই চাল দিচ্ছে। আর দাম বেশি রাখায় আমরাও মোটা চাল আনছি না।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদর অনুযায়ী রোজায় বেচাকেনা হয়-এমন পণ্যের প্রায় সব কটির দাম বেড়েছে। মটর ডাল, মসুর ডাল ও ছোলা- এ তিন ধরনের ডালের দাম এক মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১৯ শতাংশ। খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। চিনির দাম প্রায় ৪ শতাংশ।
টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির জনান, বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতিবছরের মতো এবারও ট্রাকে করে স্বল্পমূল্যে পেঁয়াজ, ছোলা, চিনি, ভোজ্যতেলসহ বেশ কয়েকটি নিত্যপণ্য বিক্রি করছে টিসিবি। ক্রেতাদের চাহিদা বিবেচনা করে ডিলার ট্রাকের সংখ্যা বাড়িয়ে ১০০টি করা হয়েছে। পাশাপাশি আগামী শনিবার থেকে ভোজ্যতেল ও পেঁয়াজের পরিমাণ বাড়ানো হবে। এতে বেশিসংখ্যক মানুষ উপকৃত হবেন।
অন্যদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত বাজার তদারকি অভিযান পরিচালনা করছে। তার পরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না দাম। বাজারসংশ্লিষ্টদের দাবি, শুধু অভিযানেই দাম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। পণ্যদ্রব্যের সাপ্লাই চেন ঠিক রাখতে হবে। পণ্যের সরবরাহ নির্বিঘœ করতে হবে। একই সঙ্গে পণ্যদ্রব্য আমদানির পাশাপাশি বন্দরে আমদানিকৃত পণ্যের খালাসও দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিংবা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একার পক্ষে পণ্যদ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে কাজ করতে হবে। বাজার তদারকির পাশাপাশি কৃষকের ক্ষেত থেকে বাজার পর্যন্ত পণ্য সরবরাহ ও পরিবহন নির্বিঘœ করতে হবে। অন্যদিকে আমদানিকৃত পণ্যদ্রব্য যেন বন্দরে আটকে না থাকে, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। এসব বিষয় মনিটরিংয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও প্রশাসনের সমন্বয়ে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স তৈরি করা যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে খাদ্যপণ্য পরিবহন ও সরবরাহকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিতে হবে। বন্দরে, ফেরিতে, সড়কে খাদ্যপণ্য পরিবহনের কার্যক্রম যাতে সচল থাকে, তা মাঠপর্যায়ের প্রশাসনের তদারকি করতে হবে।
কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী সম্পাদক মো. পলাশ মাহমুদ বলেন, বর্তমান বাজার তদারকি অভিযান শুধু সচেতনতামূলক হয়ে গেছে। বর্তমান অভিযানগুলোয় ব্যবসায়ীদের কেবল সচেতন ও সতর্ক করা হচ্ছে, শাস্তি কিংবা জরিমানা করা হচ্ছে না। বাজারে পণ্যের ঘাটতি নেই। মাঠভর্তি ফসল পড়ে আছে বিভিন্ন অঞ্চলে। এর পরও যারা পণ্যের সংকট দেখিয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছেন, তাদের অবশ্যই কঠিন শাস্তির আয়ওতায় আনতে হবে। না হলে এসব সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী আরও সাহসী হয়ে উঠবেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র আরও জানিয়েছে, সারা বছর ১ লাখ টন ছোলার চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু রমজান মাসেই চাহিদা রয়েছে ৮০ হাজার টন ছোলার। সারা বছর ২৪ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। আর রমজান মাসে পেঁয়াজের চাহিদা ৫ লাখ টন। রমজানে ভোজ্যতেলের চাহিদা বেশি থাকে। সারাবছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা ১৮ লাখ ৬২ হাজার টন। আর রমজানেই চাহিদা ৩ লাখ টন। এ ছাড়া সারাবছর ১৮ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে দেশে। এর মধ্যে শুধু রমজানেই চাহিদা ৩ লাখ টন। সারাবছর মসুর ডালের চাহিদা ৫ লাখ টন। রমজানে ৮০ হাজার টন মসুর ডালের চাহিদা রয়েছে। সারাবছর ৬ লাখ ৪ হাজার টন রসুনের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রমজানে ৮০ হাজার টন।