*সময় সংবাদ লাইভ রির্পোটঃ আগামী ১৩ জুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ঘোষণা দেয়া থাকলেও ইতিমধ্যে কঠোর বিধিনিষেধের মেয়ার ১৬ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই বাড়ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি। এ দিকে ছুটি না বাড়িয়ে অবিলম্বে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার দেয়ার দাবি জোরদার হচ্ছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, করোনার কারণে শিক্ষার্থীরা যে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তা অপূরণীয়। ক্ষতি পোষাতে সরকারকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
গত বছর ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হলে জনসমাগম এড়াতে ১৮ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে সরকার। এরপর দফায় দফায় এ ছুটি বাড়ানো হয়েছে। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে অন্য সবকিছু প্রায় স্বাভাবিক হলেও সংক্রমণ ঝুঁকির কারণে খোলা হচ্ছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই সময়ে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে দূরে ৪ কোটি শিক্ষার্থী। বিকল্প হিসেবে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমও ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
করোনা মহামারির বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ৯৭ দশমিক ৭ শতাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চান। আর মাধ্যমিকের ৯৬ শতাংশ অভিভাবক সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানোর পক্ষে মত দিয়েছেন।
দেশে গত বছর করোনা শুরুর পর থেকে বন্ধ রয়েছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এক বছরের বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠানের বাইরে শিক্ষার্থীরা। এ অবস্থায় প্রাইমারিতে ১৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নিয়মিত পড়াশোনার বাইরে আছে।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বি আইজিডি)-এর যৌথ গবেষণা জরিপে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। অনলাইনে এই অনুষ্ঠানে গবেষণার তথ্য তুলে ধরেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান এবং বি আইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন।
জরিপে বলা হয়েছে, দেশের ৯৭ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা বলছেন, স্কুল খুললে তারা সন্তানদের স্কুলে পাঠাবেন। আর মাধ্যমিকের ৯৬ শতাংশ অভিভাবকও তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে মত দিয়েছেন।
শহর ও মফস্বলের প্রায় ৬ হাজার ৯৯ জন অভিভাবকের ওপর পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে গবেষণাটি করা হয়। গত ১১ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত এ জরিপ চালানো হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা মহামারির কারণে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ৫৯ লাখ ২২ হাজার শিক্ষার্থী ন্যূনতম শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তাই করোনাভাইরাসের গতিবিধি দেখে পুনরায় স্কুল খোলার দিনক্ষণ ঠিক করতে হবে।
জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ৫১ শতাংশ প্রাথমিক ও ৬১ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষার্থী পড়াশোনার ক্ষতি এড়াতে কোচিং ও গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। মহামারিতে শিক্ষার ব্যয় গ্রামীণ পরিবারে ১১ গুণ ও শহুরে পরিবারে ১৩ গুণ বেড়ে গেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় প্রাথমিকের ১৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিকের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী শিখতে না পারার (লার্নিং লস) ঝুঁকিতে রয়েছে। পুনরুদ্ধার কর্মসূচি হাতে নিয়ে শিক্ষার্থীদের না শেখালে তারা ঝরে পড়বে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারিতে শহরে বসবাসরত ১০ থেকে ২০ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা (১৫ দশমিক ৭ শতাংশ) গ্রামের (৮ দশমিক ৪ শতাংশ) তুলনায় দ্বিগুণ মানসিক চাপে রয়েছে। অভিভাবকদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এই মানসিক চাপের লক্ষণগুলো হচ্ছে, অধৈর্য ভাব প্রকাশ, রাগ বা উগ্রভাব এবং বাইরে যেতে ভয় পাওয়া। ঘরের বাইরে যেতে ভয় পাওয়ার বিষয়টি গ্রামের চেয়ে শহরের তরুণদের মাঝে বেশি। এই জরিপে পিতামাতার আচরণ ও সম্পৃক্ততাও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে বলে জানানো হয়।
গত ৩ মার্চ ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের মতো এত দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে মাত্র ১৩টি দেশে। এই দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া থেকে আছে শুধু বাংলাদেশ। এসব দেশে এ দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ১৬৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে বাংলাদেশেরই রয়েছে ৩৭ মিলিয়ন শিক্ষার্থী।
ক্ষতি পোষাবে কীভাবে? ঘরবন্দী শিশুরা গত বছরের পাঠ্যসূচির অনেক কিছুই রপ্ত করতে পারেনি। চলতি শিক্ষাবর্ষেও যদি একই অবস্থা হয়, তাহলে কীভাবে এই ক্ষতি পোষানো হবে? শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন তছনছ। বড় ধরনের ক্ষতির মুখে শিক্ষা। কিন্তু এই ক্ষতি পোষাতে দীর্ঘমেয়াদি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের হাতে। শিক্ষাবিদেরা বলছেন, শিক্ষার এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দু-তিন বছরের জন্য কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়ে এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। না হলে ক্ষতির প্রভাব পড়বে দীর্ঘ মেয়াদে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, ক্ষতি কতটুকু হলো, তা পর্যালোচনা করতে হবে আগে। এরপর তার ভিত্তিতে ক্ষতি পোষানোর জন্য মহাপরিকল্পনা করে এগোতে হবে। তিনি বলেন, পরীক্ষা ছাড়া বা সামান্য কিছু পড়িয়ে ওপরের শ্রেণিতে ওঠালে দীর্ঘ মেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ক্ষেত্রে হয়তো এক বছরের জায়গায় ৯ মাসে শিক্ষাবর্ষ শেষ করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে বাসায় বসে থেকে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখায় মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরো বেশি সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। শিক্ষকেরা যাতে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মোবাইল ফোন ও ভার্চুয়াল মাধ্যমে যোগাযোগ বাড়ান, সেই নির্দেশনা দেয়া হবে।
আশুলিয়া সংবাদদাতা জানান, আশুলিয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবিতে মানববন্ধন করেছে সাভার উপজেলা এবং আশুলিয়ার সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টায় আশুলিয়ার গাজিরচট এ. এম. উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে এ কর্মসূচীর আয়োজন করেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
মানববন্ধনের আহবায়ক রাশেদুল ইসলাম বলেন, অনতিবিলম্বে সব ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে একটি কার্যকরী পরিকল্পনার মাধ্যমে সকল শিক্ষার্থীদের ভ্যাক্সিনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আর্থিকভাবে সহায়তা করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানও তিনি।
এসময় উপস্থিত ছিলেন মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির জার্নালিজমের শিক্ষার্থী রহুল আমিন, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাকিল মাহমুদ, সাভার সরকারী কলেজের শিক্ষার্থী জিয়াউর রহমানসহ সাভারের বিভিন্ন কলেজ ও স্কুলের শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবিতে শাহবাগে মুহাম্মদ মনির হোসাইন বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে আগামী প্রজন্মকে ধ্বংস করা হচ্ছে। তিনি বলেন গত বছরের ১৭ই মার্চ থেকে বাংলাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আজ প্রায় দেড় বছর হয়ে গেছে কিন্তু এখনো খোলার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এদেশের সকল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টস, গণপরিবহন, নির্বাচনী প্রচারণা, অফিস-আদালত, সরকারি-আধাসরকারি-বেসরকারি সবধরনের প্রতিষ্ঠান, খেলাধুলা ইত্যাদি সব আগের মতোই চলছে কিন্তু করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির অজুহাতে শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ।