সময় সংবাদ রিপোর্ট:নির্বাচনের আগে ঋণখেলাপি ও কিস্তিখেলাপিদের ছাড়ের হিড়িক পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগ পর্যন্ত মাত্র ২০ দিনে ১৭০টি আবেদন গ্রহণ করে তা অনুমোদন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণখেলাপি, কিস্তিখেলাপিরা যেন নির্বাচনে আটকে না যান এ জন্য আবেদন করা হয়। তাদের মধ্যে কোনো কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে অতি সামান্য ডাউনপেমেন্ট নিয়ে পুনঃতফসিল সুবিধা অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার অনেকের কাছ থেকে বকেয়া কিস্তির মধ্যে কয়েকটি কিস্তি নিয়ে নিয়মিত গ্রাহক হিসেবে সিআইবি সার্টিফিকেট দেওয়া হয়।
এদিকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঋণখেলাপি প্রার্থীদের চিহ্নিত করতে বিশেষ সিআইবি সেল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সেল আজ থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রার্থীদের ঋণ সংক্রান্ত তথ্য যাচাই করবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঋণখেলাপিদের ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্যোগ নিলেও আগেই ঋণখেলাপিদের ছাড় দিয়ে নিয়মিত করে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। বিশেষ করে সরকারদলীয় এমপি প্রার্থীরা প্রভাব খাটিয়ে খেলাপি ঋণ নবায়ন করে নিয়েছেন। এখন যতই শক্তিশালী সেল গঠন করা হোক না কেন তারা ধরা পড়বে না। প্রভাব খাটিয়ে আবদুর রাজ্জাকের ছেলে নাহিম রাজ্জাক, প্রয়াত আবদুল জলিলের ছেলে নিজাম উদ্দিন জলিল জন নিজেদের খেলাপি ঋণ কয়েক দিন আগে নবায়ন করে নিয়েছেন। এর বাইরে পটুয়াখালী-২ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আসম ফিরোজ আবার নির্বাচনে দাঁড়াতে আদালতের আদেশে নবমবারের মতো পুনঃতফসিল সুবিধা গ্রহণ করেছেন। এ তালিকায় রয়েছেন কমার্স ব্যাংকের ঋণখেলাপি জাতীয় পার্টির শওকত চৌধুরীও।
উল্লেখ্য, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে সর্বোচ্চ ৩ বার যে কোনো গ্রাহক পুনঃতফসিল সুবিধা নিতে পারেন। এজন্য নীতিমালা রয়েছে। ন্যূনতম পরিমাণ অর্থ নগদ (ডাউনপেমেন্ট) পরিশোধ করতে হয়। ওই নীতিমালা অনুসারে প্রথমবার পুনঃতফসিলের জন্য বকেয়া কিস্তির ১৫ শতাংশ বা মোট পাওনা ১০ শতাংশের মধ্যে যেটি কম সেই পরিমাণ নগদ অর্থ জমা দিতে হয়। দ্বিতীয়বার করতে হলে বকেয়া কিস্তির ৩০ শতাংশ বা মোট পাওনার ২০ শতাংশের মধ্যে যেটি কম, তৃতীয়বার পুনঃতফসিলের জন্য বকেয়া কিস্তির ৫০ শতাংশ বা মোট পাওনার ৩০ শতাংশের মধ্যে যেটি কম সেই পরিমাণ নগদ অর্থ জমা দিতে হয়।
কিন্তু ডাউনপেমেন্টের অর্থ পরিশোধ না করেই নির্বাচনের প্রার্থীরা পুনঃতফসিলের আবেদন করেন। তাদের আবেদন বিবেচনা করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠিয়ে দেয়। নীতিমালার বাইরে গিয়ে দেদার ওই সব আবেদন অনুমোদন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই সুবিধা গ্রহণ করতে অনেক প্রভাবশালী গ্রাহক গত কয়েক দিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে দেখা করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছুরা বছরখানেক আগে থেকেই ঋণখেলাপির তকমা কাটাতে বিশেষ সুবিধা নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ধরনা দেন। সরকারদলীয় অনেক প্রভাবশালী নেতা, সাবেক মন্ত্রী, বর্তমান সংসদ সদস্য আগেভাগেই সুবিধা গ্রহণ করে নিজেদের অবস্থান নিরাপদ করেছেন। নির্বাচনী ছাড় গ্রহণের হিড়িক পড়ে মূলত চলতি মাসে। ৮ নভেম্বর থেকে গত ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত সর্বমোট ১৭০টি আবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আসে। প্রায় সব আবেদনই গ্রহণ করে তা অনুমোদন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ঋণ পুনঃতফসিল একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। সম্প্রতি যেসব আবেদন এসেছে নিয়মানুযায়ী তা বিবেচনা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পুনঃতফসিল, বকেয়া কিস্তি পরিশোধ, সুদ মওকুফসহ নানা ধরনের আবেদন গ্রাহকের পক্ষে ব্যাংকগুলো প্রেরণ করে।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সব ঋণগ্রহীতার তথ্য সংরক্ষিত থাকে। নির্বাচনে ঋণখেলাপিরা অংশ নিতে পারেন না। তাই প্রার্থীরা ঋণখেলাপি নন এমন সনদপত্র সিআইবি থেকে নিয়ে নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দাখিল করতে হয়। নির্বাচনে কমিশনের নির্দেশনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রার্থীদের তথ্য যাচাই করে থাকে। গতকাল বুধবার প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া শেষ হয়েছে। আজ থেকে যাচাই-বাছাই শুরু হবে। সব প্রার্থীর ঋণ সংক্রান্ত তথ্য যাচাই করার জন্য সিআইবি বিশেষ সেল গঠন করেছে। দুদিন সাপ্তাহিক ছুটির দিনসহ টানা ৩ দিন সকাল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ওই সেল কাজ করবে। নিখুঁতভাবে কাজ করার জন্য অন্য বিভাগ থেকে জনবল বরাদ্দ করা হয়েছে সিআইবি সেলের জন্য। পরিসংখ্যান বিভাগের ২৫ কর্মকর্তাকে ওই বিভাগে কাজ করার জন্য অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে। ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা সিআইবি সেলে কাজ করবেন। ওই সেল শুক্র ও শনিবারও টানা কাজ করবে।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সহায়তা করতে মনোনয়ন বাছাইয়ের দিনগুলোয় রাত ১১টা পর্যন্ত সিআইবি খোলা থাকবে। কমিশনের চাহিদা মোতাবেক তথ্য সরবরাহ করা হবে।