Header Border

ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল) ৩২.৯৬°সে

ঈশান কোণে মেঘ

সময় সংবাদ রিপোর্টঃ   সরকারের বার্ষিক জাতীয় বাজেটকে উপলক্ষ করে আমরা সর্বদাই দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির একটা সালতামামি করে থাকি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে অন্যান্য সাম্প্রতিক বছরের তুলনায় নানাবিধ কারণে এ আলোচনায় বেশ কিছু ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে।

আয়-ব্যয়
এরই মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির সর্বশেষ মূল্যায়ন তথা বিভিন্ন প্রাক্‌-বাজেট বিশ্লেষণ চলমান অর্থবছরের সংকটজনক পরিস্থিতি তুলে ধরেছে। প্রথমত, রাজস্ব আয়, ব্যয় ও ঘাটতি। ২০২২-২৩ সালে সরকারি আয়-ব্যয় কাঠামো ছিল দুর্বল। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বড় পরিমাণে অসাধিত থেকে যাবে। দ্বিতীয়ত, যে কর আদায় হবে, তার ব্যাপক অংশ আসবে পরোক্ষ কর; যেমন ভ্যাট থেকে। অর্থাৎ ধনী-গরিব নির্বিশেষে এই কর দিয়েছে। অন্যদিকে, প্রত্যক্ষ কর বিশেষ করে আয়কর আদায়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল পরোক্ষ করের চেয়ে কম। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশে আয়ের ওপর যেভাবে কর আদায় করা হয়, সেভাবে সম্পদের ওপর কর নেওয়া হয় না।

সমাপ্য অর্থবছরে সরকারি ব্যয় প্রবাহও ছিল বেশ সীমিত। প্রথম ৯ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হার ছিল বিগত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অন্যদিকে, রাজস্ব ব্যয়ের মাঝে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ এবং ভর্তুকিই তো রাজস্ব ব্যয়ের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ নিয়ে নেয়। তবে বিগত সময়ে প্রাক্কলনের চেয়ে কম আয় ও কম ব্যয় হওয়ায় বাজেট ঘাটতি বেশি বাড়বে না। যেটুকু বাজেট ঘাটতি হচ্ছে, তার বেশিটাই সরকারের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে মেটাতে হবে। বৈদেশিক ঋণ বেশি নেওয়ার কথা থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেও আয় বেশি হচ্ছে না।

বৈদেশিক খাত
অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের বাজেটের পরিপ্রেক্ষিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে। আগে রাজস্ব খাত দুর্বল থাকলেও বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি খুব বেশি ছিল না। তবে এ বছর তা বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে সীমিত নিট রপ্তানি আয়, আমদানি পণ্যের ব্যয় বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স আয়ের খাপছাড়া প্রবাহ, অতি সামান্য নিট বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ এবং ক্রমবর্ধমানভাবে বৈদেশিক দায়-দেনা পরিশোধ ব্যয় বেড়ে যাওয়া। এর প্রত্যক্ষ ফল হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় হারের পতন এবং বৈদেশিক মুদ্রার মজুত দ্রুত হ্রাস পাওয়া।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের হ্রাস আটকানো, একই সঙ্গে রাজস্ব ঘাটতিকে সীমিত রাখতে সরকারি ব্যয় এবং আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। কিন্তু এর ফলে আবার রাজস্ব আয় আশানুরূপ হয়নি। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ থমকে গেছে। যুবসমাজের জন্য বাড়তি কর্মসংস্থান হয়নি। মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব আয়-ব্যয় এবং বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতির অবনতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসে প্রতিফলিত হচ্ছে।

সরকারি নীতিনির্ধারকরা মূল্যস্ফীতিকে ইউক্রেনের যুদ্ধ তথা আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সময়মতো অর্থনৈতিক সংস্কার না করা, নীতি সমন্বয়ের অভাব এবং ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থাপনা এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য মূলত দায়ী। তাই নিম্ন আয় এবং সীমিত আয়ের মানুষের জীবনমান রক্ষার জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন একটি মৌল চাহিদায় পরিণত হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বলা যায়, অর্থনীতির ঈশান কোণে মেঘ জমেছে। কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এই মেঘ ঝড়ে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

উন্নয়ন কৌশলের বিপর্যয়
বিগত দেড় দশকে উন্নয়নকে দৃশ্যমান করার জন্য সরকার ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে প্রভূত ব্যয় করেছে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক ভিত কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে, এটি সত্য। কিন্তু একই সময়ে আমরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষায় প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ দিতে পারিনি। এর ফলে একটা আন্তঃখাত ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। মনে হচ্ছে, ২০২৩-২৪ সালের বাজেটের অর্থ বরাদ্দে এই মেগা প্রকল্পের আধিপত্য থেকেই যাবে।

তবে সরকারের উন্নয়ন চিত্রের সর্বাপেক্ষা বড় বিপর্যয় দেখা যাচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে। আগের এক সরকার খাম্বা লাগিয়ে তাতে বিদ্যুৎ দিতে পারেনি। বর্তমান সরকার ২৪ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা স্থাপন করেও জ্বালানি আমদানি করার জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে তার অর্ধেকও ব্যবহার করতে পারে না। লোডশেডিং চলছে ব্যাপকভাবে।
চলমান অর্থবছরে আরেক উন্নয়ন বিপর্যয় প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। তা হলো ব্যাংক খাতের দুর্দশা। বর্তমান সরকারের প্রায় ১৫ বছর সময়ে খেলাপি ঋণ ছয় গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম শক্তিশালী ব্যাংককে ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতির উন্নতির জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব সর্বজনসম্মত।

অন্যদিকে সাম্প্রতিককালে অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়ে চলেছে বিদেশে টাকা পাচারের হার। প্রতি বছর বাংলাদেশ যে পরিমাণ বৈদেশিক অনুদান ও ঋণ পেয়ে থাকে, তার চেয়ে বেশি অর্থ প্রতি বছর দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। এর পরিমাণ ৮০০ কোটি ডলার। আবার এই বেআইনি কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে গত বছর বাজেটে বিশেষ কর সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। তবে এ সুবিধা কেউ নেয়নি।

এমন কেন হলো
শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে যে উন্নয়ন আলেখ্য প্রচার করা হয়, তাতে কিছু সত্যতা আছে, এটি ঠিক। কিন্তু পূর্ণ সত্য নেই। বিগত সময়ে অর্জিত উন্নয়নের চিত্র বিভাজিতভাবে দেখলে আমরা বুঝব, দেশে দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বেড়েছে। বর্তমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চুম্বক পর্যালোচনা এবং বিনিয়োগ বিপর্যয়ের কতিপয় চিত্র বলে যে, এই উন্নয়ন সর্বজনীন ও টেকসই করা কঠিন। আসন্ন এক বছর মেয়াদি বাজেটের কাছে অর্থনীতির এই কাঠামোগত এবং উন্নয়ন নীতিসংক্রান্ত সমস্যার সুষ্ঠু ও সম্পূর্ণ সমাধান আশা করা অন্যায়।

তবে আইএমএফের কাছে অর্থনৈতিক সংস্কারের শর্তযুক্ত ঋণ পাওয়ার জন্য কিছু পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হবে ক্রমান্বয়ে। টাকার বিনিময় হারকে একীভূত করা, ব্যাংকের সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া, ভর্তুকির সামঞ্জস্য বিধান করা, রাজস্ব আয়ের বিভিন্ন ছাড়কে যৌক্তিকীকরণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। ঘোষণা করতে হবে ব্যাংক খাত ও পুঁজিবাজার সংস্কারের অভিপ্রায়।

কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই বাজেট হবে জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে সর্বশেষ বাজেট। অভিজ্ঞতা বলে, নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকার তদারকি ছাড়া টাকা খরচ করতে চায়। এ জন্য আসছে বাজেটে বড় ব্যয় থেকে কিছু এরূপ বরাদ্দ থাকবে। তবে রাজস্বের অভাব এবং আইএমএফের নজরদারিতে এটি করা কঠিন হবে।
অন্যদিকে বিভিন্ন কারণে রাজস্ব আহরণের তাগিদ থাকবে অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি। তাই আসন্ন বাজেটে করের পরিধি বাড়ানোর জন্য যদি নির্দিষ্ট আয় না থাকলেও ন্যূনতম কর আরোপ করা হয়, তবে সামাজিক অসন্তোষ বাড়বে। সরকারি বেতন বৃদ্ধির ফলে যদি বাজারের পণ্যমূল্য আরও স্ফীত হয়, তাহলে মধ্যবিত্তরা আরও বেজার হবে।
তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে এটি শেষ বাজেট হওয়ায় সরকার চাইবে তার তিন পর্যায়ের ১৫ বছরের সাফল্যগাথা তুলে ধরতে। উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে পুনর্ব্যক্ত করতে। তার সঙ্গে সংগতি রেখে হয়তো ঘোষিত হবে বছরের দেশজ আয়ের প্রবৃদ্ধির একটি উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা। তবে মনে রাখতে হবে, সেটা হবে রাজনৈতিক অভিলাষের প্রতিফলন, যা অর্থনৈতিক বাস্তবতার পরিচায়ক নয়।

আপনার মতামত লিখুন :

আরও পড়ুন

নতুন শিক্ষাক্রমে এসএসসি পরীক্ষা হবে ৫ ঘণ্টার
থাইল্যান্ড গেলেন প্রধানমন্ত্রী
তাপদাহে হিট অ্যালার্টের মেয়াদ আরও বাড়াল আবহাওয়া অফিস
বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বাড়াল সরকার
উপজেলায় এমপি মন্ত্রীর সন্তান-স্বজনরা প্রার্থী হলে ব্যবস্থা
সব বিরোধী দলের উপজেলা নির্বাচন বর্জন

আরও খবর