ডেইলি নিউজ রিপোর্ট, রাজশাহী॥ বাড়ির সামনে সরকারিভাবে নির্মাণ করা হয়েছে পলান সরকার পাঠাগার। তার পাশে রয়েছে স্ত্রীর কবর। সেই কবরের পাশে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন একুশে পদক প্রাপ্ত ‘আলোকিত মানুষ’ পলান সরকার।
শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়। তাকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রমুখ।
এর আগে সকাল ১০টায় রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামে তার প্রতিষ্ঠিত হারুন-অর রশিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘদিন এই স্কুলের ম্যানিজিং কমিটির সভাপতি ছিলেন পলান সরকার। জানাজার নামাজে ইমামতি করেন বাঘার বাউসা পূর্বপাড়া জামে মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মোহাম্মদ আবুল বাশার।
জানাজায় উপস্থিত হয়ে স্মৃতি চারণমূলক বক্তব্য রাখেন রাজশাহী জেলা প্রশাসক এসএম আব্দুল কাদের, রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপার মো. শহীদুল্লাহ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহিন রেজা, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বাবা মোহাম্মদ শামসুদ্দীন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদ্য নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান লায়েব উদ্দিন লাবলু , উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুল ও সাংবাদিক আবুল কালাম মুহাম্মদ আজাদ।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন সরের হাট এতিমখানার পরিচালক সাদা মনের মানুষ শামসুদ্দিন সরকার, বাঘা পৌরসভার মেয়র আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক মেয়র আক্কাছ আলী, বাউসা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলামসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
জানাযার আগে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আলোকিত এই মানুষটির স্মৃতি ধরে রাখতে তার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়কে জাতীয় করণের আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক।
পলান সরকার ১৯২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম হারেজ উদ্দিন। জন্মের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় তার বাবা মারা যান। আর্থিক অভাবে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই লেখাপড়ায় ইতি টানতে হয় তাকে। শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা ইউনিয়নের পূর্বপাড়া গ্রামের নিজ বাড়িতে মারা যান তিনি। পলান সরকার বার্ধক্যজনিত রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন। তিনি ৬ ছেলে ও তিন মেয়ে রেখে গেছেন।
স্ত্রীর পাশে চির নিদ্রায় শায়িত আলোর যাত্রী পলান সরকার
গ্রামে গ্রামে ঘুরে ছোট-বড় সবার দোরগোড়ায় বই হাতে পৌঁছে দিতেন পলান সরকার। সামাজিকভাবে অবদান রাখার জন্য ২০১১ সালে পেয়েছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘একুশে পদক’। পলান সরকার রাজশাহী জেলার ২০টি গ্রামে গড়ে তুলেছিলেন অভিনব শিক্ষা আন্দোলন। এই আগ্রহের কারণে ২০০৭ সালে সরকারিভাবে তার বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার করে দেওয়া হয়।
নিজের টাকায় বই কিনে তিনি পড়তে দিতেন পিছিয়ে পড়া গ্রামের মানুষকে। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাঁধে ঝোলাভর্তি বই নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। মাইলের পর মাইল হেঁটে একেকদিন একেক গ্রামে গিয়ে বই বিলি করতেন। বাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নেড়ে আগের সপ্তাহের বই ফেরত নিয়ে নতুন বই পড়তে দিতেন। এলাকাবাসীর কাছে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন ‘বইওয়ালা দুলাভাই’ হিসেবেও।
পলান সরকার ছিলেন বই পাগল মানুষ। ডায়াবেটিস ধরা পড়ায় হেঁটে হেঁটেই তিনি বই বিলি করতেন। একটানা ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে এই কাজ করেছেন তিনি। ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে তার ওপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর আগে তাকে নিয়ে আসা হয় জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে।