সময় সংবাদ রিপোর্টঃ ই-কমার্সের আড়ালে গ্রাহককে নিঃস্ব করে প্রতারণার মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে সেই তথ্য ধীরে-ধীরে বেরিয়ে আসছে। রাষ্ট্রের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে জালিয়াতিতে মাঠে নামে। তাদের মধ্যে অনেকেই ইতোমধ্যে আইনের জালে ধরা পড়েছে। কিন্তু অনেকেই এখনো রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। রিং আইডি নামের একটি প্রতিষ্ঠান জালিয়াতিতে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। কানাডায় বসে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শরীফুল ইসলাম, তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আইরিন ইসলাম প্রতারণার মাধ্যমে প্রায় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক শরীফুল-আইরিন দম্পতি প্রথমে সামাজিক নেটওয়ার্ক হিসেবে রিং আইডি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে কমিউনিটি জবসসহ বিভিন্ন খাতে কথিত বিনিয়োগের মাধ্যমে মুনাফার প্রচার চালান। এভাবেই তারা হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার কোটি টাকা। এই অর্থের বড় অংশ প্রবাসী বাংলাদেশিদের। সিআইডির কর্মকর্তারা মনে করছেন, চেয়ারম্যান ও এমডি কানাডায় বসে ব্যবসা পরিচালনা করতেন। এ কারণে হাতিয়ে নেওয়া টাকার বড় অংশ কানাডায় পাচার হতে পারে। এদিকে, অর্থ আত্মসাতসহ বিভিন্ন অভিযোগে আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আজ সোমবার থেকে অভিযান শুরু করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ইতোমধ্যে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ ও রিং আইডির মতো প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষের বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-পুলিশ। তবে এসব প্রতিষ্ঠানেরও শীর্ষস্থানীয় সবাইকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। এই তিন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় অপর কর্মকর্তাসহ অন্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযানে নামছে সিআইডি।
সূত্র জানায়, কানাডার মন্ট্রিয়েল সিটিতে ২০১৫ সালে ‘রিং ইনকর্পোরেশন’ নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে যাত্রা শুরু হয় রিং আইডির। কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শরীফুল ইসলাম ও আইরিন ইসলামের যৌথ উদ্যোগে এর যাত্রা শুরু হয়। শরীফুল ইসলামের ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম পরিচালক হিসেবে ছিলেন। পরে এর ব্যবসা কার্যক্রম নিয়ে আসা হয় বাংলাদেশে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রিং আইডির নামে তিনটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলতি বছরের তিন মাসে প্রায় ২১৩ কোটি টাকা তুলে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মে মাসে ২৩.৯৪ কোটি, জুন মাসে ১০৯.৩৩ কোটি ও জুলাই মাসে ৭৯.৩৮ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর বাইরে পেমেন্ট গেটওয়ে সিস্টেমেও প্রায় ৩০২ কোটি টাকার মতো লেনদেন হয়েছে বলেও প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে। সূত্র জানায়, রিং আইডি প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে যাত্রা শুরু করে। একপর্যায়ে এই মাধ্যমে বিভিন্ন সার্ভিস যুক্ত করে গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া শুরু করে। এর মধ্যে একটি প্রক্রিয়া ছিল, ১২ হাজার ৫০০ বা ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে রিং আইডি কিনতে হতো। আইডি ব্যবহার করে শুধু বিজ্ঞাপন দেখেই মাসে সাড়ে ১২ হাজার বা ১৫ হাজার টাকা উপার্জনের প্রলোভন দেখানো হতো। বিজ্ঞাপন দেখে আয়ের বিষয়টি কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে মনে করেন এই খাতের বিশেষজ্ঞরা। এ ধরনের এমএলএম এর মতো গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কৌশল এটি।
সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চটকদার বিজ্ঞাপনের ফাঁদে ফেলে গ্রাহকের বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। এরই মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত সম্পন্ন করেছে সিআইডি। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে ভুক্তভোগী গ্রাহকরাও মামলা করছেন। এমন প্রেক্ষাপটে প্রতারক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে টানা অভিযানের একটি রূপরেখা তৈরি করেছে সিআইডি।অপরদিকে, সামাজিক নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে যাত্রা শুরু করা রিং আইডি ‘কমিউনিটি জবস’ খাতের বিনিয়োগ থেকেই মাত্র তিন মাসে ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। রিং আইডির তিনটি অফিসিয়াল অ্যাকাউন্টে ২১৩ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও টাকা লেনদেনের গেটওয়ে পেমেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত তিন মাসে ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন করেছে কমিউনিটি জবস খাতে। কমিউনিটি জবস খাতে গত এক বছর ধরে ব্যবসা করছিল রিং আইডি। সিআইডি জানায়, রিং আইডির পরিচালক সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তারের পর রিং আইডির ভুক্তভোগী গ্রাহকরা সিআইডি কার্যালয়ে ফোন করেছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষার্থী এবং প্রবাসী বাংলাদেশি। প্রবাসীরা ফোন করে জানিয়েছেন, তাদের কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন রিং আইডির কমিউনিটি জবস খাতে। অনেকে সিআইডি প্রধান ব্যারিস্টার মো. মাহবুবুর রহমানের ফোনেও বিনিয়োগ করা টাকা ফেরতের উপায় জানতে চেয়েছেন। রিং আইডির মামলার বাদী আঁখি আক্তারও জানিয়েছেন, তার ভাই সৌদি প্রবাসী এসআই টুটুল নিজেই ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। তবে, ঘণ্টায় ৫টি বিজ্ঞাপনসহ, ২৪ ঘণ্টায় ১০০টি বিজ্ঞাপন দেখে মাসে ২৪,০০০ টাকা আয় করার কথা থাকলেও তারা ঠিকঠাকভাবে টাকা পাচ্ছিলেন না।
সিআইডি কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, শরীফুল ইসলাম ও আইরিন ইসলাম যেহেতু দীর্ঘদিন কানাডায় আছেন কাজেই প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া টাকার একটি বড় অংশ কানাডায় পাচার করা হয়ে থাকতে পারে। তারপরও পুরো বিষয়টি নিশ্চিত হতে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শুধু তিন মাসেই যখন এত বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে, তাতে করেই বোঝা যায় আত্মসাতের পরিমাণটা এক বছরে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে, আমরা যে হিসাব পেয়েছি তা শুধু রিং আইডির নামে থাকা ব্যাংক হিসাবের তথ্য। এর বাইরে, প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শরীফুল ইসলাম, তার স্ত্রী ব্যবস্থাপনা পরিচালক আইরিন ইসলাম ও পরিচালক সাইফুল ইসলামসহ আরও বেশ কয়েকজনের ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকউন্টের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)-কে চিঠি দিয়েছি। সব ব্যাংক তথ্য পাওয়া গেলে পুরো লোপাটের পরিমাণ জানা যাবে। তবে এরই মধ্যে কোম্পানির নামে থাকা তিনটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে, যেখানে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা রয়ে গেছে।জানা যায়, প্রথম দিকে কিছু গ্রাহককে লাভের টাকা দিয়ে অন্যদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করেছে রিং আইডি। এছাড়া সম্প্রতি ই-কমার্স সাইটের মতো তারাও অস্বাভাবিক ডিসকাউন্টে বিভিন্ন পণ্য বিক্রির নামে ই-ওয়ালেটের মাধ্যমে লেনদেন পরিচালনা করছিল।
সূত্র জানায়, রিং আইডির একটি শাখা হিসেবে রিং পে-লিমিটেড নামে ই-ওয়ালেট পরীক্ষামূলকভাবে চালু করেছিল। চলতি বছরের মার্চ মাসে পরীক্ষামূলক চালু করার জন্য রিং পের অনুমোদনও দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের জালিয়াতির বিষয়টি সামনে এলে গত ২৬ সেপ্টেম্বর তাদের পরীক্ষামূলক অনুমোদন বাতিল করা হয়।সিআইডির সাইবার ইনভেস্টিগেশন বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসপি) আশরাফুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, রিং আইডির সাইফুল ইসলামকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের পুরো প্রতারণার বিষয়টি উঠে আসবে। রিং আইডির দুই মালিকের মাধ্যমে কানাডায় টাকা পাচার করার আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। প্রায় ১ হাজারের বেশি ব্র্যান্ড প্রোমোটার, ৬০০-৭০০ এজেন্ট ও ১.৫ লাখ আইডি, প্রায় দুই কোটি সদস্য থাকায় বিদেশি বিনিয়োগও আনতে চেষ্টা করেছিল শরীফুল-আইরিন দম্পতি। উল্লেখ্য, সাইফুল ইসলামের নামে ভাটারা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও মাল্টিলেভেল মার্কেটিং নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা হয়। এরমধ্যে রিং আইডিতে বিনিয়োগ করে প্রতারিত একজন ভুক্তভোগী গত ৩০ সেপ্টেম্বর পরিচালক সাইফুলসহ রিং আইডির ১০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১০-১৫ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাটি দায়ের করেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইক্যাব, পেমেন্ট গেটওয়ে, মার্চেন্ট এবং ভোক্তা প্রতিনিধিদের সমন্বয় কমিটি গঠন করতে হবে। করোনাকালে বিভিন্ন খাতের মতো ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোকে প্রণোদনা দিতে হবে। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ব্যাংক গ্যারান্টিসহ বাধ্যাতামূলক লাইসেন্স নিতে হবে। ই-কমার্স বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত, যেখানে হাজার হাজার উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছে এবং লাখ লাখ কর্মসংস্থান হচ্ছে। এই সেক্টরকে সরকারিভাবে সুরক্ষা দিতে হবে।
এম/পি..