আলমগীর পারভেজ : রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে কলেজ ছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তে প্রাপ্ত বিভিন্ন আলামত বিশ্লেষণ করছে পুলিশ। উদ্ধার করা ছয়টি ডায়েরির তথ্য ও হাতের লেখা যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। মুনিয়ার লাশ উদ্ধারের ঘটনায় বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে মামলা করেন তার বড় বোন। এরপর থেকেই চলছে আলোচিত এ ঘটনার নিবিড় তদন্ত।
এদিকে,মুনিয়াকে ‘আত্মহত্যায় প্ররোচনার’ আসামী বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের আগাম জামিন আবেদনের শুনানি হয়নি। হাই কোর্টের যে বেঞ্চের কার্যতালিকায় তার আগাম জামিনের আবেদনটি গতকাল বৃহস্পতিবার শুনানির জন্য ছিল, সেই বেঞ্চ ‘লকডাউন’ ও মহামারির এই পরিস্থিতিতে আগাম জামিনের শুনানি করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। আনভীরের দেশ ছাড়ার ওপর বিচারিক আদালত নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরদিন বুধবার হাই কোর্টে তার জামিন আবেদনের খবর পাওয়া যায়।
জানা গেছে, মুনিয়ার ব্যবহৃত দুটি স্মার্টফোন, ছয়টি ডায়েরি, ওই বাসার সিসিটিভি ফুটেজসহ বেশ কিছু আলামত সংগ্রহ করেছে পুলিশ। তারা বলছেন, প্রাথমিক আলামতে ঘটনাটি আত্মহত্যা মনে হলেও ময়না তদন্ত প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।
তদন্তকারীরা জানান, প্রাথমিক অনুসন্ধানে ওই তরুণীর সঙ্গে আনভীরের সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া গেছে। একইসঙ্গে আনভীরের সঙ্গে ওই তরুণীর বিভিন্ন কথোপথন ও পারিপার্শিকতা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তরুণীর মৃত্যুর আগে আনভীরের পক্ষ থেকে তাকে কোনো ধরনের চাপ দেয়া হয়েছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুলিশ বলছে, তরুণীকে চাপ প্রয়োগের যথাযথ প্রমাণ পেলেই আনভীরকে গ্রেপ্তার করা হবে।
গত সোমবার সন্ধ্যায় গুলশান-২ এর ১২০ নম্বর রোডের একটি ফ্ল্যাট থেকে কলেজছাত্রী মুনিয়ার ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে রাতে গুলশান থানায় মামলা করেন ওই তরুণীর বোন নুসরাত জাহান। তিনি অভিযোগ করেন, ‘বিয়ের প্রলোভন’ দেখিয়ে সায়েম সোবহান আনভীর মুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু বিয়ে না করে তিনি উল্টো ‘হুমকি’ দিয়েছিলেন মুনিয়াকে। বোনের ফোন পেয়ে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসে ওই বাসার দরজার তালা ভেঙে ঢুকে মুনিয়ার ঝুলন্ত লাশ পাওয়ার কথা এজাহারে লিখেছেন নুসরাত জাহান। মামলা হওয়ার পর মঙ্গলবার পুলিশ আনভীরের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করে। তাতে ঢাকার আদালত সাড়াও দেয়।
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মুনিয়ার ফ্ল্যাটে আনভীরের যাতায়াতের প্রমাণ তারা পেয়েছেন। এ ঘটনায় আনভীরের কোনো বক্তব্য কোনো গণমাধ্যমই পায়নি।
মুনিয়া ঢাকার একটি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি কুমিল্লায়; পরিবার সেখানেই থাকে। মাস দুয়েক আগে এক লাখ টাকায় ভাড়া নেওয়া ওই ফ্ল্যাটে ওঠেন তিনি। ময়নাতদন্তের পর মুনিয়াকে মঙ্গলবার কুমিল্লায় দাফন করা হয়েছে।
তবে কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ওই নিষেধাজ্ঞার আগেই দেশ ছেড়েছেন আনভীর। পুলিশ ও ইমিগ্রেশনের দায়িত্বশীলরা অবশ্য বলছেন, আকাশপথে আনভীরের দেশ ছেড়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তিনি যাতে স্থলসীমান্ত পার হয়ে দেশ ছাড়তে না পারেন সেজন্যও সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের কয়েকটি সূত্র বলছে, কার্গো বিমানে যাত্রী যাওয়ার রেকর্ড নেই। কেবল উড়োজাহাজের ক্রুরা এতে যেতে পারেন। ক্রুর বাইরে অন্য কোনো যাত্রী ইমিগ্রেশনকে ম্যানেজ করে কার্গো বিমানে যদি গিয়ে থাকেনও, তাহলেও তিনি অবতরণ করা দেশের ভেতরে ঢুকতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে ওই দেশের সরকারের বিশেষ অনুমতি লাগবে।
ইমিগ্রেশনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খুরশিদ জাহান বলেন, ‘কার্গো বিমানে শুধু বিমানের ক্রুরা যেতে পারেন, আর কেউ নন। আমরা তার (আনভীর) পাসপোর্ট নম্বর মিলিয়ে দেখেছি, তিনি যান নাই।’
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, ওই তরুণীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোন, ডায়েরি, তার বাসার সিসিটিভি ফুটেজ মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত। এর প্রতিটিতেই আনভীরের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া বেশ কিছু কথোপকথনের ফোন রেকর্ড পেয়েছে পুলিশ।
ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে ময়না তদন্তের রিপোর্ট পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এছাড়া মামলার অভিযোগের বিষয়ে আমাদের তদন্ত চলছে। এতে আনভীরের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ওই তরুণীর ছয়টি ডায়েরি গত বছর ও এ বছরে লেখা। সবশেষ তিনি ডায়েরি লিখেছেন ২৪ এপ্রিল। এরপর বিশেষভাবে চিহ্নিত করা আরও কিছু লেখা রয়েছে। সেগুলো গত ২৬ এপ্রিলের বলে ধারণা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।বিশেষভাবে চিহ্নিত ওই লেখাগুলো সরাসরি সুইসাইডাল নোটের মতো না হলেও সেখানে ‘চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের’ কথা রয়েছে।
উপকমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘আমরা হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্ট দিয়ে এসব লেখা যাচাই করব। এই ডায়েরিগুলো গুরুত্বপূর্ণ আলামত। এতে তার (ওই তরুণী) সামাজিক স্বীকৃতিসহ নানা টানাপড়েনের কথা রয়েছে।’
ঝুলন্ত অবস্থায় মৃতদেহ উদ্ধার হওয়ার পর প্রাথমিকভাবে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা ধরে তদন্ত এগিয়ে নেয়া হচ্ছে বলে জানান সুদীপ কুমার। তবে তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর পেছনে অন্যকিছু আছে কিনা তাও তদন্তের বাইরে নয়। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ আমরা বলতে পারব না। এটা বলবেন ফরেনসিক এক্সপার্টরা, যারা ময়নাতদন্ত করেছেন। তাদের রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যু কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে না।’
আনভীরের অবস্থান জানাতে ডিএমপির কাছে আবেদন
মুনিয়ার লাশ উদ্ধারের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার পর বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীর কোথায় অবস্থান করছেন তা মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসিকে জানাতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার বরাবর একটি আবেদন করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার (২৯ এপ্রিল) সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এস এম জুলফিকার আলী জুনু এ আবেদন করেন।
আবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি দেশের আলোচিত বিষয় হচ্ছে, গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে মুনিয়া নামের একটি মেয়ের আত্মহত্যার মামলা। যেই মামলায় আত্মহত্যার প্ররোচনাকারী হিসেবে দেশের স্বনামধন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে আসামী করা হয়েছে। কিন্তু জনমনে প্রশ্ন মামলা দায়েরের ৩ দিন অতিবাহিত হলেও কেন এই মামলার অন্যতম আসামী সায়েম সোবাহান আনভীরকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না? নাকি সায়েম সোবহান আনভীর দেশত্যাগ করেছে? দেশের অভ্যন্তরে থাকলে কেন পুলিশ কর্তৃক উন্নত তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসামী গ্রেফতার করা হচ্ছে না?’
‘জনমনে এও প্রশ্ন রয়েছে- দেশের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী বলে পুলিশ গ্রেফতারে অনিহা প্রকাশ করছে। যা দেশের সাধারণ মানুষের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অশনী সংকেত।’
আবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ পুলিশ একটি পেশাদার সুশৃঙ্খল বাহিনী। এই বাহিনীর প্রতি দেশের সাধারণ মানুষ ও আমাদের আস্থা রয়েছে। পুলিশ কমিশনার আপনার কাছে আকুল আবেদন, আত্মহত্যার প্ররোচনার আসামী বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীর দেশে আছে নাকি বিদেশে পালিয়ে গেছে এর একটি সুস্পষ্ট বক্তব্য দেশ ও জাতির কাছে জানান। দেশে থাকলে তাকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না এবং উন্নত তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসামী গ্রেফতার না করা কেন পুলিশের দায়িত্ব পালনে নিষ্ক্রিয়তা হিসেবে গন্য হবে না?- তা আপনাদের অবস্থান ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে জাতিকে মিডিয়ার মাধ্যমে জানানোর অনুরোধ জানাচ্ছি।
বসুন্ধরা সিটির সামনে মানববন্ধন
আত্মহত্যায় প্ররোচনা মামলার আসামী বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের গ্রেপ্তার ও বিচার চেয়ে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। বুধবার বিকেল ৪টায় রাজধানীর পান্থপথে বসুন্ধরা সিটির সামনে এই কর্মসূচি পালিত হয়।
‘এই হত্যাকা-’ বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয় উল্লেখ করে সমাবেশে ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক মিখা পিরেগু বলেন, ‘এটি এই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ভোগবাদী মনোভাবের ফলাফল।
দেশে ‘এক দেশ দুই নীতি’ ক্রমেই প্রতীয়মান হচ্ছে বলে মনে করেন মিখা পিরেগু। তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধারের পর আত্মহত্যায় প্ররোচনা মামলার আসামি আনভীরকে ‘গ্রেপ্তার করে বিচার না’ করলে ছাত্র ইউনিয়নে রাজপথে নামবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতারা ছাড়াও এই কর্মসূচিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মহানগর ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।