সময় সংবাদ লাইভ সম্পাদকীয় রিপোর্টঃমসজিদ নির্মাণের কাজ অত্যধিক ফজিলতপূর্ণ হওয়ায় আল্লাহতায়ালা কুরআনুল কারিমে ২৮ জায়গায় এর আলোচনা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা মসজিদকে তার নিজের দিকে সম্মানমূলক সম্মন্ধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
وَأَنَّ الـْمَسَاجِدَ لله فَلا تَدْعُوا مَعَ الله أَحَدًا
‘নিশ্চয় মসজিদসমূহ আল্লাহরই জন্য। অতএব, তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে ডেকো না।’ [সুরা জিন, ৭২ : ১৮]
আল্লাহ তায়ালা মসজিদ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের বহু ফজিলতের ঘোষণা দিয়েছেন। এমনকি এটাকে ইমানদারদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللَّهِ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللَّهَ ۖ فَعَسَىٰ أُولَٰئِكَ أَن يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِينَ
‘নিঃসন্দেহে তারাই আল্লাহর মসজিদ আবাদ করবে যারা ইমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও আখিরাতের প্রতি এবং যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে ও জাকাত আদায় করে; আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে ভয় করে না। অতএব, আশা করা যায়, তারা সুপথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ [সুরা তাওবা, ৯ : ১৮]
বরং মসজিদে যেতে অভ্যস্ত ব্যক্তিকে ইমানদার হিসেবে সাক্ষ্য দিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে :
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الخدري رضي الله عنه قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِذَا رَأَيْتُمُ الرَّجُلَ يَتَعَاهَدُ الْمَسْجِدَ فَاشْهَدُوا لَهُ بِالإِيمَانِ ، فَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَقُولُ : إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللهِ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَاليَوْمِ الآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلاَةَ وَآتَى الزَّكَاةَ…
আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমরা কোনো মানুষকে দেখবে সে মসজিদের সাথে সম্পর্ক গড়ছে, তখন তোমরা তার ইমানের স্বীকৃতি দাও।’ এরপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করেন : ‘নিঃসন্দেহে তারাই আল্লাহর মসজিদ আবাদ করবে যারা ইমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও আখিরাতের প্রতি এবং যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত আদায় করে…।’ [সুরা তাওবা, ৯ : ১৮]
ইমাম কুরতুবি (রহ.) উপরোক্ত আয়াতের তাফসিরে বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে তাদেরকে মুমিন হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন, যারা সালাত আদায়ের মাধ্যমে মসজিদকে প্রাণবন্ত রাখবে, মসজিদকে পরিচ্ছন্ন রাখবে, মসজিদের সংস্কার কাজ করবে এবং সর্বোপরি আল্লাহর প্রতি ইমান আনবে।’
মসজিদের সুরক্ষার জন্য আল্লাহ তায়ালা জিহাদকে বিধিবদ্ধ করেছেন। জিহাদ না থাকলে ইবাদাত ও মুয়ালাতের এ কেন্দ্রগুলোও টিকে থাকবে না। এটাও মসজিদের ফজিলতের প্রমাণ বহন করছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لَّهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا ۗ وَلَيَنصُرَنَّ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ
‘আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তবে উপাসনালয়, গির্জা, প্যাগোডা ও মসজিদসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে যেত, যেগুলাতে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদের সাহায্য করবেন, যারা আল্লাহর সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী।’ [সুরা হজ, ২২ : ৪০]
ইমাম কুরতুবি (রহ.) এ আয়াতের তাফসিরে বলেন, ‘আল্লাহ যদি নবিদের ওপর এবং মুমিনদের ওপর শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে ফরজ না করতেন তাহলে মুশরিকদের স্পর্ধা বেড়ে যেত এবং ইবাদাতের জন্য নির্দিষ্ট স্থানগুলোতে তারা বিঘ্নতা সৃষ্টি করতো। আর এ জন্যই আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতিহত করা আবশ্যক করেছেন, যেন নিরবচ্ছিন্নভাবে মানুষ আল্লাহর ইবাদাত করতে পারে।’
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّهُ أَن تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ يُسَبِّحُ لَهُ فِيهَا بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ رِجَالٌ لَّا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ ۙ يَخَافُونَ يَوْمًا تَتَقَلَّبُ فِيهِ الْقُلُوبُ وَالْأَبْصَارُ
‘আল্লাহ যেসব ঘরকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন, সেখানে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে; এমন লোকেরা, যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, নামাজ কায়েম করা থেকে এবং জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে।’ [সুরা নুর, ২৪ : ৩৭]
উসমান ইবনু আফফান (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন,
مَنْ بَنَى مَسْجِدًا لِلَّهِ بَنَى اللَّهُ لَهُ فِي الْجَنَّةِ مِثْلَهُ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মসজিদ নির্মাণ করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ ঘর নির্মাণ করবেন।’
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
إِنَّ مِمَّا يَلْحَقُ الْمُؤْمِنَ مِنْ عَمَلِهِ وَحَسَنَاتِهِ بَعْدَ مَوْتِهِ عِلْمًا عَلَّمَهُ وَنَشَرَهُ، وَوَلَدًا صَالِحًا تَرَكَهُ، وَمُصْحَفًا وَرَّثَهُ، أَوْ مَسْجِدًا بَنَاهُ، أَوْ بَيْتًا لِابْنِ السَّبِيلِ بَنَاهُ، أَوْ نَهْرًا أَجْرَاهُ، أَوْ صَدَقَةً أَخْرَجَهَا مِنْ مَالِهِ فِي صِحَّتِهِ وَحَيَاتِهِ يَلْحَقُهُ مِنْ بَعْدِ مَوْتِهِ
‘মুমিনদের যেসমস্ত আমলের ধারা মৃত্যুর পরও চলমান থাকে তার মধ্যে অন্যতম হলো, ১. সেই ইলম (জ্ঞান) যা সে প্রসার করে গেছে। ২. রেখে যাওয়া নেক সন্তান। ৩. রেখে যাওয়া কুরআনের কপি। ৪. তার নির্মাণকৃত মসজিদ। ৫. তার নির্মাণ করে যাওয়া মুসাফিরখানা। ৬. তার স্থাপন করে যাওয়া নলকূপ। এবং ৭. ওই সাদাকা, যা বেঁচে থাকতে সে দান করে গেছে।’
যদি কেউ একা একটি মসজিদ নির্মাণ করে, তার জন্য এই প্রতিদান। কিন্তু এটা তো সবার পক্ষে সম্ভব নয়, যদি মসজিদ নির্মাণকার্যে অংশগ্রহণ করে, তাহলে কেমন প্রতিদান রয়েছে আসুন এবার তা-ই দেখি—আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
مَنْ بَنَى مَسْجِدًا لِلَّهِ كَمَفْحَصِ قَطَاةٍ أَوْ أَصْغَرَ بَنَى اللَّهُ لَهُ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে পাখির বাসা পরিমাণ কিংবা তারচেয়েও ছোট মসজিদ নির্মাণ করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করবেন।’
আলিমগণ বলেছেন, ‘যারাই মসজিদ নির্মাণে অংশগ্রহণ করবে, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের অংশগ্রহণের পরিমাণ অনুযায়ী প্রতিদান পাবে।’
মসজিদ নির্মাণের অত্যধিক ফজিলতের কারণ ফুটে ওঠেছে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহ.)’র এই কথা থেকে। তিনি বলেন, ‘মসজিদ হলো উম্মাহর ইবাদাতগাহ ও মিলনকেন্দ্র। নবি (সা.) প্রতিষ্ঠিত মসজিদের কর্মসূচি ছিল সালাত, কিরায়াত, জিকির, নেতৃত্ব ও সামাজিক রীতিনীতি শিক্ষা। মুসলিমরা তাতে একত্রিত হতো তাদের ধর্মীয় ও বৈষয়িক যেকোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে।’
মসজিদ হলো ইমানের ইস্পাতকঠিন দূর্গ। তাওহিদের বাণী প্রচারের কেন্দ্র। মসজিদ হলো সেই বিদ্যালয়, যেখান থেকে গড়ে উঠেছিলেন এই উম্মাহর প্রথম প্রজন্ম। মসজিদই ছিল সেকালে জ্ঞানচর্চার সর্বোচ্চ কেন্দ্র। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) হিজরতের পর মদিনায় এসে সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণের কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। পথিমধ্যে কুবায় অবস্থানকালে সেখানেও মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। এমনিভাবে মুসলিমরা পরবর্তীতে যে অঞ্চলই বিজয় করেছে, সেখানেই তারা মসজিদ নির্মাণ করেছে। পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে মুসলিম-ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে আজও জ্বলজ্বল করছে সেসসব মসজিদ।
তাই আসুন আমরা আখেরাতের কল্যাণ লাভের আশায় অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ কাজ মসজিদ নির্মাণের সাথে সম্পৃক্ত হই এবং একে অপরকে উদ্বুদ্ধ করি.