সময় সংবাদ লাইভ রিপোর্টঃ রাজনৈতিক বাদানুবাদ, দুর্নীতিচেষ্টার অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংকের মুখ ফিরিয়ে নেয়া গুজবকে ছাপিয়ে স্বপ্ন হলো সত্যি। প্রমত্তা পদ্মার বুকে দৃশ্যমান হলো ৬.১৫ কিলোমিটারের পূর্ণাঙ্গ সেতু। বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে গৌরবের অংশ হলো বাংলাদেশ।
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৮ মিনিটে শেষ স্প্যানটি বসে। এরপর চলে দীর্ঘকায় ক্রেন থেকে সেটিকে বিচ্ছিন্ন করার কাজ। পরে শুরু হয় ওয়েল্ডিংয়ের কাজ, যার মধ্য দিয়ে নিখুঁতভাবে যুক্ত হবে ৪০ ও ৪১ নম্বর প্রান্ত। সেটি শেষ হতে অন্তত সাত দিন সময় লাগে বলে জানিয়েছেন নির্মাণশ্রমিকরা। এর আগে সকাল থেকে তীব্র কুয়াশায় আচ্ছন্ন ছিল চারপাশ। মাঝনদীতে কুয়াশা ছিল বেশি ঘন। কারিগরি দিক থেকে সেতু কর্তৃপক্ষ প্রস্তুত থাকলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দেয়।
তবে দমবার পাত্র ছিলেন না প্রকৌশলী আর নির্মাণশ্রমিকরা। সময় তখন সকাল ১০টা। বিকট শব্দের সাইরেন বাজিয়ে ক্রেনটি জানান দেয়, শুরু হলো স্প্যান বসানোর কাজ।
কুয়াশার চাদর ভেদ করে স্প্যান নিয়ে ধীর লয়ে এগোতে থাকে ক্রেন। ক্রমশ দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু। প্রায় ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় ১৫০ মিটার দীর্ঘ ৪১ নম্বর স্প্যান যুক্ত করল পদ্মা সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারকে। রচিত হলো বাংলাদেশের আরেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।
সেতু নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিজয়ের মাসে বাংলাদেশ তার সক্ষমতা তুলে ধরল বিশ্ববাসীর কাছে। বুধবারই স্প্যান নিয়ে আসা হয় পদ্মা সেতুর নির্ধারিত পিলারের কাছে। আনার আগে স্প্যানটি সাজানো হয় বাংলাদেশ ও চীনের পতাকা দিয়ে।
স্প্যানের গায়ে চীনা ও বাংলা হরফে লেখা ছিল, ‘কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় দেশী ও বিদেশী শ্রমশক্তির মাধ্যমে স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ বাস্তবায়নের পথে। সেতুর ৪১টি ইস্পাতের তৈরি স্প্যান সোনার বাংলার উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলকে সংযুক্তির মাধ্যমে চীন ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বের বন্ধনকে অটুট রাখবে।’
তবে শেষ স্প্যান বসানো উপলক্ষে সেতু কর্তৃপক্ষের বাড়তি কোনো আয়োজন ছিল না। উল্টো জমায়েত এড়াতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে প্রশাসন। তিন হাজার ২০০ টন ওজনের একেকটি স্প্যান কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে সেতু পর্যন্ত টেনে নিতে কাজে লাগানো হয় তিন হাজার ৭০০ টনের বিশাল একটি ক্রেন।
এত শক্তিশালী ক্রেন দুনিয়াতে আছে অল্প দুই একটিই। পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, ‘বিজয়ের মাসে স্বাধীনতার পর এটি আমাদের আর একটি উজ্জ্বল ঐতিহাসিক বিজয়। এ বিজয় হলো আমাদের অনমনীয়তার। এ বিজয় হলো, আমরা যে করতে পারি, সে সক্ষমতা প্রমাণের বিজয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বড় রকমের নাড়া দেবে। ইতিবাচক পথে নিয়ে যাবে দেশের অর্থনীতিকে। দেশজ সম্পদে যে করতে পারলাম, এটা আমাদের সক্ষমতা প্রমাণ করল।’
ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতুর কাঠামো। সেতুর উপরের অংশে যানবাহন ও নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন।
সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সেতুকে যানবাহন চলাচলের উপযোগী করতে সময় লাগবে আরও ১০ থেকে ১২ মাস।
পদ্মা বহুমুখী সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলামও বললেন একই কথা। তিনি বলেন, ‘আমাদের সেতুর মূল কাঠামো হয়ে গেল। সুসম্পন্ন করতে আমাদের সময় লাগবে।’
দ্বিতল এই সেতুতে বেশ জোরেশোরে চলছে সড়ক ও রেলপথে তৈরির কাজ। প্রথম তলায় চলছে রেলপথ নির্মাণের কাজ আর উপর তলায় চলছে সড়ক নির্মাণের কাজ। বিরামহীন খেটে যাচ্ছেন দেশী-বিদেশী নির্মাণ শ্রমিকরা।
সড়কপথ ও রেলপথ নির্মাণের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘মূল কাজ হলো রোডওয়ে স্ল্যাব বসানো। আমরা ৪০ শতাংশের বেশি কাজ করেছি। ৬০ শতাংশের কাছাকাছি বাকি আছে।
‘রেলওয়ে স্ল্যাব ৬০ শতাংশ করেছি, ৪০ শতাংশ বাকি আছে। আমাদের গ্যাস সংযোগের পাইপলাইন এখনও বসানো হয়নি।’ তবে যত দ্রুত সম্ভব এই সেতুর কাজ সম্পন্ন করার বিষয়ে চেষ্টার ত্রুটি নেই বলেও জানান প্রকল্প পরিচালক।
পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর। আর ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর ভিত্তি স্থাপন করেন। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু।
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তের ৩৫ ও ৩৬ নম্বর পিলারের ওপর ধূসর রঙের সপ্তম স্প্যান বসানোর পর সেতুর এক কিলোমিটার দৃশ্যমান হয়।
শুরুতে তিন চার মাস পরপর স্প্যান বসানো হত। তবে ২০১৮ সাল থেকে বদলে যায় পরিস্থিতি। প্রতি মাসে একাধিক স্প্যান বসাতে সক্ষম হয় সেতু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। আর ৪১ নম্বর স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে শেষ হলো পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামোর নির্মাণ কাজ।
মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদীশাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন।
শুরুতে এই মহাপ্রকল্পের নির্মাণের ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তবে তিন ধাপে বাড়ানো হয়েছে প্রকল্প ব্যয়। শেষ পর্যন্ত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বৃহস্পতিবার সকালে পদ্মাসেতুতে বসানো হয় ৪১তম তথা সবশেষ স্প্যান। এতে সেতুর মুল কাঠামো ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পুরোটাই দৃশ্যমান হয়।
এই সেতু নির্মাণের পথে কত বাধাই না মোকাবিলা করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। সবকিছুই মিছে প্রমাণ করল সরকার। ২০০৯ সালের শুরুতে সরকার গঠনের পর শুরু হয় সেতু তৈরির প্রাথমিক পরিকল্পনা। কিন্তু হঠাৎ পিছু হটতে থাকে দাতা সংস্থাগুলো।
২০১০ সালে প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহ্বান করা হয়। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে আগ্রহ দেখায় বিশ্বব্যাংক। সেই সঙ্গে সহযোগী হতে চায় এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিপি), ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ও জাইকা।
২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়। পদ্মা নদীতে ‘ভাষা শহীদ বরকত’ নামের ফেরিতে এই চুক্তিতে বাংলাদেশের পক্ষে সই করেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া আর বিশ্বব্যাংকের পক্ষে বাংলাদেশে সংস্থাটির আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টাইন।
একই প্রকল্পে ২০১১ সালের ১৮ মে জাইকার সঙ্গে, ২৪ মে আইডিবির সঙ্গে এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়। এডিবি ৬১ কোটি, জাইকা ৪০ কোটি ও আইডিবি ১৪ কোটি ডলার দেবে বলে ঠিক হয়।
কিন্তু বিশ্বব্যাংক উড়ো কথার ভিত্তিতে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ তোলার পর শুরু হয় টানাপোড়েন। সংস্থাটির অভিযোগ ছিল, কানাডার প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিন কাজ পেতে বাংলাদেশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে।
সরকার শুরু থেকেই এই অভিযোগ নাকচ করলেও চাপ অব্যাহত থাকে বিশ্বব্যাংকের। এক পর্যায়ে ২০১১ সালে ঋণচুক্তি স্থগিত করে।
পরে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়াকে প্রধান আসামী করে সাত জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। কিন্তু বিশ্বব্যাংক চাপ দিতে থাক সে সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে আসামী করতে।
সরকার রাজি না হওয়ার পর ২০১২ সালের ৩০ জুলাই ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। এই নিয়ে টানা পোড়েনে বিশ্বব্যাংক প্রকল্পটি থেকে সরে যাওয়ার পর সরে যায় এডিবি, জাইকা ও আইডিবিও।
কিন্তু হাল ছাড়েনি সরকার। ২০১২ সালের ১০ জুলাই নিজ অর্থে সেতু নির্মাণের বিষয়ে প্রথম কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন তিনি বলেন, নিজ অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে।
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সংসদে সরকারপ্রধানের ঘোষণার পর নিশ্চিত হয়ে যায়, দাতাদের চ্যালেঞ্জ করেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা সেতুর মূল পাইলিং কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল কাজ উদ্বোধন করেন তিনি।
সেদিন জনসভায় বিশ্বব্যাংকের টালবাহানা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ আনে। আমি বলি, দুর্নীতির প্রমাণ দিতে হবে। কারণ তখনও টাকা ছাড় হয়নি। আজ পর্যন্ত তারা প্রমাণ করতে পারে নাই যে এখানে দুর্নীতি হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম, আমরা পারি, আমরা তা দেখাব।…আজ আমরা সেই দিনটিতে এসে পৌঁছেছি।’ নানা নাটকীয়তা শেষে নিজ অর্থে সেতুর কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে।
সেতু তৈরির কাজ পায় চায়না মেজর ব্রিজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি সিনো হাইড্রো করপোরেশনকে দেয়া হয় নদী শাসনের কাজ। দেশীয় প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম দুই প্রান্তে ১৪ কিলোমিটার সংযোগ সড়কসহ সার্ভিস এরিয়া নির্মাণের কাজ করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বুয়েট নির্মাণ কাজ তদারক করছে।
২০১৪ সালের জুলাইয়ের মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যন্ত্রপাতি আনা শুরু করে। ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বরে সেতু প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। যদিও মূল সেতুর নির্মাণ কাজ উদ্বোধন হয় ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
সেতুর পূর্ণাঙ্গ রূপ পাওয়ার দিন মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতু প্রকল্পের অগ্রগতি দেখতি গিয়ে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকল ষড়যন্ত্রের জবাব দিয়েছেন।
‘সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিশ্বে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। সমগ্র বিশ্বর কাছে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ টি জেলাকে সরাসরি সড়ক নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী।আকাশ থেকে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ দেখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দেশের দীর্ঘতম এ বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত পদ্মা সেতুর নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন; উপর দিয়ে চলবে অন্যান্য যানবাহন। শুরুতে এই মহাপ্রকল্পের নির্মাণের ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তবে তিন ধাপে বাড়ানো হয় প্রকল্প ব্যয়। শেষ পর্যন্ত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।