সময় সংবাদ লাইভ রির্পোটঃ রাজধানীতে ব্যাপক অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে ‘ভুয়া বাদী’ সাজিয়ে মামলা দায়েরের শক্ত সিন্ডিকেট। এসব চক্র সবসময়ই কমবেশি সক্রিয় ছিল। কিন্তু হালে তা যারপরনাই বেড়েছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অনেকে এ পথ বেছে নেন। সিন্ডিকেট সদস্যরা ধুরন্ধর কূটবুদ্ধি ও লাইনঘাটে পয়সা ঢেলে তা কার্যকর করেন এবং বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেন মামলার নেপথ্যে থাকে ব্যক্তির কাছ থেকে।
প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সিন্ডিকেটের সদস্যরা ২৪৯ কিলোমিটার দূরের কারাবন্দি মাদক মামলার আসামিকেও বানিয়ে দিচ্ছেন বাদী। চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সাজানো মামলায় ভুয়া বাদী করা হচ্ছে বেকার যুবকদের। চক্রের সদস্যরা এতটাই বেপরোয়া যে, হয়রানির উদ্দেশ্যে সাজানো মামলায় না জানিয়েই নিরীহ মানুষকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করছেন। চক্রের সঙ্গে অসাধু কিছু পুলিশ সদস্যের যোগসাজশ থাকায় ঠায়-ঠিকানাসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের গড়মিল থাকলেও কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই দেদার হয়ে যাচ্ছে মামলা।
এতে একদিকে টার্গেট ভিকটিম যেমন গুরুতর মামলায় আসামি হয়ে জেল খাটাসহ নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন, অন্যদিকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়া ছাড়াও বিপুল পরিমাণে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীনও হতে হচ্ছে তাদের। আবার সাজানো মামলায় সাক্ষী বা বাদী হয়ে আইনের মারপ্যাঁচে জড়িয়ে পড়ছেন নিরীহ অনেকেই।
ভুয়া বাদী সাজিয়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করে হয়রানি এবং পুলিশের অসহযোগিতার অভিযোগ এনে গত ২০ এপ্রিল পুলিশ সদর দপ্তরের ‘আইজিপি’স কমপ্লেইন মনিটরিং সেল’-এ লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন জেড এম রানা নামে এক ভুক্তভোগী। তার অভিযোগসহ রাজধানীর কয়েকটি থানায় দায়ের করা একাধিক মামলার নথিপত্র ঘেঁটে ভুয়া বাদী সাজিয়ে মামলা দায়ের সিন্ডিকেটের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলছে সময় সংবাদ লাইভ এর অনুসন্ধানেও।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, হাতিরঝিল থানায় দায়ের করা এক মামলায় বাদী করা হয়েছে ২৪৯ কিলোমিটার দূরের বরিশাল কারাগারে বন্দি থাকা মাদক মামলার এক আসামিকে। মামলায় যে ঘটনাস্থল উল্লেখ করা হয়েছে নেই তার কোনো অস্তিত্ব। শেরেবাংলা নগর থানায় দায়ের করা একটি মামলায় বাদী যে ঘটনাস্থল দেখিয়েছেন, তাও ভুয়া। এমনকি পরবর্তীতে বাদী নিজেই মিথ্যা মামলার বিষয়টি স্বীকার করে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে হলফনামায় উল্লেখ করেন যে, তাকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সাজানো মামলাটির বাদী হতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মোহম্মদপুর থানায় দায়ের করা একটি মামলার (নম্বর-২০) এজাহারে বাদী যে তথ্য উপস্থাপন করেছেন তার বেশ কিছু ব্যত্যয়ও ধরা পড়েছে অনুসন্ধানে।
২০২০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর একটি মানবপাচার সংক্রান্ত মামলা হয় রাজধানীর হাতিরঝিল থানায়। মামলা নম্বর ২৭। মামলার বাদী হলেন মো. সাইফুল ইসলাম। বাবার নাম হাবিবুর রহমান। বর্তমান ঠিকানার স্থলে উল্লেখ করা হয়Ñ হাতিরঝিল থানাধীন মধুবাগ এলাকার ৩৫৭ নম্বর ভবন। তার স্থায়ী ঠিকানা বলা হয়েছে- বরিশাল সদরের কর্ণকাঠী গ্রাম। এজাহারে উল্লেখ করা হয়- আসামি জেড এম রানা (রাজধানীর রূপনগর আবাসিক এলাকায় অবস্থিত এভারোশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের মিরপুর শাখার পরিচালক) পর্তুগাল পাঠানোর নামে সাইফুল ইসলামের হাতিরঝিলের বাসায় বসে তার কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা নিয়েছেন। কিন্তু সাইফুলকে তিনি পর্তুগাল পাঠাতে পারেননি; উপরন্তু গত বছরের ৩০ জুন ওই টাকা ফেরত চাইলে প্রাণনাশের হুমকি দেন আসামি রানা।
কিন্তু সময় সংবাদ লাইভ এর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভিন্ন তথ্য। সাইফুল ইসলাম এজাহারে যে তারিখে (গত বছরের ৩০ জুন) হুমকির ঘটনার কথা উল্লেখ করেন সেদিন তো বটেই তারও আগে এবং পরেও (বরিশালের কোতোয়ালি মডেল থানাধীন ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের ধান গবেষণা রোডের জিয়ানগর এলাকার একটি ভবন থেকে ৩০৫ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট ও গাঁজাসহ গ্রেপ্তার হয়ে (মামলা নম্বর-৯৫) ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত) বরিশাল কারাগারে বন্দি ছিলেন সাইফুল ইসলাম। আর এজাহারে যে ঘটনাস্থল (হাতিরঝিল থানাধীন মধুবাগ এলাকার ৩৫৭ নম্বর ভবন) তিনি দেখিয়েছেন- অনেক খুঁজেও ওই বাড়ির সন্ধান মেলেনি। ফলে প্রশ্ন উঠেছে- একজন কারাবন্দি মাদক মামলার আসামি কীভাবে বরিশালে থেকেও ২৪৯ কিলোমিটার ব্যবধানের হাতিরঝিল থানায় দায়ের করা মামলাটির বাদী হলেন? আর কোন স্বার্থে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই হাতিরঝিল থানা পুলিশ কী করে মামলাটি গ্রহণ করল?
এই বিষয়ে জানতে গতকাল শনিবার হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও পরিদর্শক তদন্তের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ওপাশ থেকে সাড়া দেননি তারা। কয়েকদিন আগেও একই বিষয়ে জানতে চাইলে হাতিরঝিল থানার ওসি আবদুর রশীদ ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে ফোনের লাইনটি কেটে দেন। একই বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় বর্তমানে জামিনে কারাগারের বাইরে থাকা মামলার বাদী সাইফুল ইসলামের সঙ্গেও। তিনি মামলার বাদী বলে স্বীকার করলেও অভিযোগ শুনতেই সেল ফোনের লাইনটি কেটে দেন।
গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি অদ্ভুত মামলা (নম্বর-১৬) হয়। এই মামলার বাদী হলেন পেশায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি সোহেল আকন। মামলাটির পরতে পরতে রহস্যের ছাপ মিলেছে আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে। বাদী মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন- আসামি রানা ইতালি পাঠানোর কথা বলে তার কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা নিলেও তাকে বিদেশে পাঠাতে পারেননি। বাদীর বর্তমান ঠিকানায় (পশ্চিম আগারগাঁও এলাকার ২৭২/বি নম্বর ভবন) বসে এই টাকা লেনদেন হয়। আবার টাকা চাইলেও এখন হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন আসামি।
অথচ মামলার এজাহারে বাদী যে ঘটনাস্থল (শেরেবাংলা নগর থানাধীন পশ্চিম আগারগাঁও এলাকার ২৭২/বি নম্বর ভবন) উল্লেখ করেন, সেই ভবন মালিক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব) ডা. এ এইচ আবেদুর রেজা। ভবনটিতে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োজিত আছেন মো. আফছার মিয়া। গতকাল শনিবার তার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।
আফছার বলেন, ‘সোহেল আকন নামে কখনোই কোনো ভাড়াটিয়া এই ভবনে ছিল না। ওই মামলার বিষয়ে থানা পুলিশ অনুসন্ধানে এসেছিল। বিষয়টি তাদেরও জানিয়ে দিয়েছি। ভুল ঠিকানা ব্যবহার করে মামলা করায় বিষয়টি নিয়ে আমরাও বিব্রত। শুধু তাই নয়, রহস্যজনক এই মামলার বাদীর স্থলে সোহেল আকনের নামের পাশে উল্লেখিত যে এয়ারটেল মোবাইল নম্বরটি ব্যবহৃত হয়েছে সেটিও বাদীর নয়। নম্বরটি নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা জনৈক আবির শিকদারের। গতকাল ওই নম্বরে একাধিকবার কল করে বন্ধ পাওয়া যায়।
এদিকে প্রাপ্ত নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, বাদী সোহেল আকন নিজেই সাজানো মামলার বিষয়টি স্বীকার করে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি নোটারি পাবলিকের (নম্বর-৮) মাধ্যমে এক হলফনামায় উল্লেখ করেন যেÑ তাকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সাজানো মামলাটির বাদী হতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এই বিষয়ে কথা হয় বাদী সোহেল আকনের সঙ্গে। তিনি নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে হলফনামা দিলেও এই প্রতিবেদকের কাছে বেমালুম তা অস্বীকার করে বলেন, রানা বিদেশে পাঠানোর কথা বলে তার কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। হলফনামার তথ্য ভুয়া ও সাজানো!
তবে প্রাপ্ত নথিপত্র ও মোবাইল ফোনের কয়েকটি অডিও ক্লিপ শুনে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন মামলার বাদী সোহেল আকনই। কারণ- নোটারি পাবলিকের সংশ্লিষ্ট আইনজীবী নজরুল ইসলাম খান ও আবুল কালামের উপস্থিতিতে তার স্বাক্ষর করা ওই হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেন- ‘জনৈক মো. সোহেল হাওলাদার ওরফে সোহেল শাহরিয়ার আমার পূর্ব পরিচিত। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সোহেল হাওলাদার আমাকে বলে যে, আমার ভগ্নিপতি আনিসুর রহমান সোহাগের জন্য তোকে একটি কাজ করে দিতে হবে। যার বিনিময়ে সে (উক্ত ভগ্নিপতি) তোকে চাকরি দিয়ে দিবে। তখন আর তোর আর কোন অভাব-অনটন থাকবে না। এক পর্যায়ে আনিসুর রহমান সোহাগের সাথে সাক্ষাৎ করে আমি যখন জানতে চাই কি কাজ করে দিতে হবে? তখন সে বলে যে তোকে থানায় একটি মিথ্যা মামলা করতে হবে। যেভাবে যা লিখতে হবে তা আমরা লিখে সব কিছু স্ট্যাম্পে প্রস্তুত করে দেব। তুই সেভাবে স্বাক্ষর করে থানায় গিয়ে মামলা দায়ের করবি।’
‘সে অনুযায়ী আরিফুর রহমান সাগরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। চাকরির প্রতিশ্রুতি দেয়ায় ও অভাব-অনটন দূর হবে আশায় আমি উক্ত কাজ করতে সম্মত হই এবং সেই মোতাবেক স্ট্যাম্পে মামলার কাগজ প্রস্তুত করে আরিফুর রহমান সাগর আমাকে নিয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় যায় এবং উক্ত মিথ্যা মামলা দায়ের করি। মামলা নং-১৬, তারিখ : ১৪.৯.২০২০। অতঃপর আমি বিষয়টি মোটামুটি জানতে পারি যে, উক্ত সোহেল হাওলাদারের ভগ্নিপতি আনিসুর রহমান সোহাগ ও আমার মিথ্যা মামলার আসামি রানার মধ্যে ব্যবসায়িক শত্রুতার কারণে সোহাগ আমাকে দিয়ে উল্লেখিত মিথ্যা মামলা দায়ের করান। ওই মামলায় রানাকে পুলিশ রিমান্ড নেয় ও তিনি প্রায় এক মাস জেলহাজত বাস করেন। প্রকৃতপক্ষে আমি চাকরির লোভের বশবর্তী হয়ে মিথ্যা মামলাটি দায়ের করি। জেড এম রানার সাথে আমার কোনো পূর্ব পরিচয় ছিল না। তার সাথে উক্ত মামলা বিষয়ক কোনো ঘটনা ঘটে নাই এবং তার সাথে কখনোই আমার কোনো প্রকার আর্থিক বা অন্য কোনো ধরনের লেনদেন সম্পাদিত হয় নাই। আমি আমার বিবেকের দংশনে তাড়িত হয়ে অত্র সত্য প্রকাশ করলাম।’
অদ্ভুত এই মামলার প্রসঙ্গে শেরেবাংলা নগর থানার ওসি জানে আলম মুনশী গতকাল সময় সংবাদ লাইভকে বলেন, কোনো বাদী যদি মিথ্যা তথ্য ও ডকুমেন্ট দিয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন, তার দায়ভার বাদীকেই নিতে হবে। নিষ্পত্তিকৃত মামলাটি এখন আর আমাদের কাছে নেই। তদন্তে যা পাওয়া যাবে প্রতিবেদনে তাই উল্লেখ করবেন বলে জানা গেছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।
২০২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মোহম্মদপুর থানায় দায়ের করা মামলার (নম্বর-২০) এজাহারেও বাদী যেসব তথ্য উপস্থাপন করেছেন তার বেশ কিছু ব্যত্যয় ধরা পড়েছে। এই মামলার বাদী আরিফুল হাসান মীর সাগর। শেরেবাংলা নগর থানার বাদী সোহেল আকনের দাখিলকৃত হলফনামায় উল্লেখ করা অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে আরিফুল হাসান মীর সাগর বলেন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে সত্য ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে একটি মহল এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে।
ডিএমপি (ঢাকা মহানগর পুলিশ) কমিশনার দপ্তরের নির্দেশে রহস্যজনক ৩টি মামলা এখন তদন্ত করছেন ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তেজগাঁও জোনাল টিমের পরিদর্শক মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
সময় সংবাদ লাইভ।