সময় সংবাদ রিপোর্ট:বেতার, টেলিভিশন ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোকে ‘নিয়মের মধ্যে’ রাখতে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনায় সম্প্রচার কমিশন গঠনের বিধান রেখে ‘সম্প্রচার আইন-২০১৮’-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
এ আইনে টকশোতে বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য উপস্থাপন ও প্রচার এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও রাষ্ট্রীয় আদর্শ-নীতিমালা পরিপন্থী কিছু প্রচার করলে সম্প্রচার কর্তৃপকে সর্বোচ্চ তিন বছরের জেল বা সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেয়ার সুযোগ রাখা হচ্ছে।
আর সম্প্রচার লাইসেন্স পাওয়ার অযোগ্য ঘোষিত কেউ সম্প্রচার কার্যক্রম চালালে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেয়া যাবে। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়।
বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম এক ব্রিফিংয়ে বলেন, প্রস্তাবিত আইনে সাত সদস্যের একটি সম্প্রচার কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে, যার সদস্যদের নিয়োগ দেয়া হবে সার্চ কমিটির মাধ্যমে। ওই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি কমিশনের সদস্যদের নিয়োগ দেবেন। গণমাধ্যম পরিচালনার জন্য গঠিত সম্প্রচার কমিশন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাইসেন্স প্রদান করবে।
এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে কেউ তিগ্রস্ত হলেও কমিশনে অভিযোগ করে ফল পাওয়া যাবে। টেলিভিশন, বেতার, ইন্টারনেটভিত্তিক সম্প্রচার মাধ্যম ও সম্প্রচার যন্ত্রপাতির জন্য লাইসেন্স বরাদ্দেরও সুপারিশ করবে এই কমিশন। অনলাইন গণমাধ্যমের নিবন্ধন দেয়ার ক্ষেত্রে এই কমিশনের একক কর্তৃত্ব থাকবে।
খসড়া আইনে সম্প্রচার কমিশন গঠনের পাশাপাশি কমিশনারদের নিয়োগ, যোগ্যতা-অযোগ্যতা, মেয়াদ, পদত্যাগ, অপসারণ, পদপর্যাদা, পারিশ্রমিক ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া আছে। এই কমিশন গণমাধ্যমকর্মীদের দতা বৃদ্ধি, সম্প্রচার কাজকে শক্তিশালী এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে করতে কাজ করবে। সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করেই নতুন আইনটি করা হচ্ছে।
অনলাইন গণমাধ্যমের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে হোস্টিং করা বাংলা, ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষায় প্রত্য বা পরোভাবে ইন্টারনেটভিত্তিক রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে সম্প্রচারের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত স্থির ও চলমান চিত্র, ধ্বনি ও লেখা বা মাল্টিমিডিয়ার অন্য কোনো রূপে উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ বা সম্প্রচারকারী বাংলাদেশী নাগরিক বা বাংলাদেশে নিবন্ধিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান। আর ‘কন্টেন্ট’ বলতে সম্প্রচারের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত যেকোনো অডিও, টেক্সট, উপাত্ত, চিত্রণ বা নকশা (স্থির বা চলমান), ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনা, সঙ্কেত বা যেকোনো ধরনের বার্তা বা এরূপ যেকোনো সংমিশ্রণ যা ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে সৃষ্ট প্রক্রিয়াজাত সংরতি, উদ্ধারকৃত বা কমিউনিকেটেড হতে সম যেকোনো কিছুকে বোঝানো হবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো সম্প্রচারকারী বা অনলাইন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান আলোচনা অনুষ্ঠানে বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য উপস্থাপন ও প্রচার, বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে যেমন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের ভাষণ, জরুরি আবহাওয়াবার্তা নির্দেশ অমান্য করা, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও রাষ্ট্রীয় আদর্শ-নীতিমালা পরিপন্থী অনুষ্ঠান ও বিজ্ঞাপন প্রচার করলে এ আইনের আওতায় তা অপরাধ বলে গণ্য হবে। এ রকম ২৪টি কাজকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে এ আইনে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। অপরাধ সংঘটন চলমান রাখলে প্রতিদিনের জন্য সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা হবে। এই শাস্তি সম্প্রচারকারীর জন্য প্রযোজ্য হবে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, এই আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে- গণমাধ্যমগুলো পরিচালনার জন্য সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিশন গঠন করা হবে। এই কমিশন গঠনে পাঁচ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ দেবেন। কমিশনে একজন নারী কমিশনার রাখার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, কমিশনারদের যোগ্যতা কী হবে খসড়া আইনে তা উল্লেখ করা হয়েছে জানিয়ে শফিউল বলেন, কমিশনার হতে হলে সম্প্রচার, গণমাধ্যম শিল্প, গণমাধ্যম শিক্ষা, আইন, জনপ্রশাসন ব্যবস্থাপনা, ভোক্তা বিষয়াদি বা ডিজিটাল প্রযুক্তির ওপর বিশেষ জ্ঞান ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের যোগ্যতা একই হবে। চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের মেয়াদ হবে নিয়োগের তারিখ থেকে পাঁচ বছর বা ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত। শারীরিক বা মানসিকভাবে দায়িত্ব পালনে কেউ অসমর্থ হলে বা কমিশন ও রাষ্ট্রের জন্য তিকর এমন কোনো কাজে লিপ্ত থাকলে তাদের কমিশন থেকে অপসারণ করা যাবে। তবে কমিশনের বৈঠক কত দিনে, কতবার করতে হবে সে বিষয়ে আইনে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো নির্দেশনা নেই।
শফিউল আলম বলেন, সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে সম্প্রচার যন্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হবে এই কমিশনের প্রধান কাজ। লাইসেন্স প্রদানে কমিশনের একক কর্তত্ব থকবে। সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান বা গণমাধ্যমগুলোর লাইসেন্স করতে নির্দিষ্ট ফি লাগবে। একটি নির্দিষ্ট সময় পর এই লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে। লাইসেন্স ফি ও এর মেয়াদ বিধি দ্বারা নির্ধারণ করা হবে। সম্প্রচারের কারণে কারো কোনো তি হলে এই কমিশনে নালিশ জানানো যাবে। কমিশন ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগের সুরাহা করবে।
তিনি আরো বলেন, কোনো বিকৃত মস্তিষ্কের অধিকারী ব্যক্তি, ঋণখেলাপি, ফৌজদারি মামলায় দুই বছরের বেশি সাজাপ্রাপ্ত আসামি কমিশনের সদস্য হতে পারবেন না। আইনের ২৮ ধারায় ২৪টি অপরাধের বিবরণ দেয়া আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- অসত্য তথ্য উপস্থাপন করলে ও সরকারের প্রজ্ঞাপন দ্বারা জারি হওয়া কোনো আদেশ অমান্য করলে, স্বাধীনতার চেতনাপরিপন্থী কোনো সংবাদ পরিবেশন করলে দণ্ড প্রদান করা হবে। এ ক্ষেত্রে তিন বছরের জেল, পাঁচ কোটি টাকার জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
অপরাধ চলমান থাকলে দিনে এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। লাইসেন্স প্রাপ্তির শর্তের ব্যত্যয় ঘটলে সাত বছরের জেল ও পাঁচ কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এই অপরাধগুলো জামিনযোগ্য এবং বিনা ওয়ারেন্টে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। সচিব বলেন, চলমান গণমাধ্যম বা সম্প্রচার যন্ত্রের লাইসেন্স গ্রহণের বিষয়ে এই আইনে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। তবে নতুন প্রতিষ্ঠান খোলা হলে অবশ্যই লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে।