আলমগীর পারভেজ: সরকারের মজুত কমে যাওয়ার তথ্য ব্যবসায়ীরা জানতে পেরে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছে। এখনও সে প্রবণতা অব্যাহত আছে খাদ্য মজুত সংক্রান্ত বিধিবিধানের কঠোর বাস্তবায়ন, অভিযান পরিচালনা ও বাজার তদারকি কার্যক্রম জোরদারের জন্য খাদ্য অধিদফতর ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এবং সব বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের কাছে চিঠি দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। শুল্ক কমিয়ে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়। সরকারিভাবেও চাল আনার পদক্ষেপ নেয়া হয়। খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বোরো ধান উঠলেই কমবে চালের দাম। কিন্তু বোরো ঘরে উঠলেও দামে মেলেনি সুফল। শুরুতে কিছুটা কমলেও চালের দাম আবার বেড়ে সেই আগের জায়গায়ই ঠেকেছে। গত বছর থেকেই চালের বাড়তি দাম অব্যাহত রয়েছে। ১১ মাসে চাল আমদানির এলসি খোলার হার বেড়েছে ২১০ গুণ। কিন্তু আমদানির কোনো প্রভাব নেই দামে। সরকারি গুদামগুলোতে চালের মজুত বেড়েছে। এরপরও চালের দাম কমছে না বরং বেড়েই চলেছে। চালের দাম কমাতে সরকারের কোনো কৌশলই কাজে আসছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বাজারে চালের দাম না কমার পেছনে বেশকিছু কারণ কাজ করছে। এজন্য তারা সরকারের অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করছেন। তারা বলছেন, বাজারে চালের সরবরাহ কমে যাওয়া, সরকারের নীতিগত ভুল, মজুদ কমে যাওয়া, নিম্নমানের চাল আমদানিসহ বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। তাদের মতে, চাহিদা ও যোগানের সঠিক হিসাব করা দরকার। এজন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও তথ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষণ বাড়াতে হবে। সরকার কৃষকদের লাভবানের কথা বললেও চালের দাম না কমায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন চাল ব্যবসায়ী এবং চালকল মালিকেরা। আবার তাদের ওপরই চাল আমদানি করার দায়িত্ব দেয়ায় চালের বাড়তি দাম ঠিক রাখতে তারা চাল আমদানি করতে গড়িমশি করেছে। প্রত্যাশা ছিল বোরো ধান উঠলে চালের দাম কমবে। সাধারণ মানুষের অস্বস্তিও দূর হবে। বাস্তবে তেমনটি হয়নি।
চালের দাম কমাতে সরকার বছরজুড়ে বিভিন্ন সময়ে নানা পদক্ষেপ নিয়ছে। কিন্তু চালের দাম কমেনি। বাজারে অভিযান পরিচালনা করা দফতরগুলোকে খাদ্যশস্যের বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখতে করণীয় বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে আসছে মন্ত্রণালয়। মজুত সংক্রান্ত বিধিবিধানের কঠোর বাস্তবায়ন, অভিযান পরিচালনা ও বাজার তদারকি কার্যক্রম জোরদারের জন্য খাদ্য অধিদফতর ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এবং সব বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের কাছে চিঠি দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। চিঠির অনুলিপি দেয়া হয় মন্ত্রিপরিষদ সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবকে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, ঢাকা মহানগরে খাদ্যশস্যের বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের আওতায় গঠিত মনিটরিং টিমের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের দেশের সব জেলায় নিয়মিত অভিযান ও সংশ্লিষ্ট আইনের আওতায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা অব্যাহত রাখতে হবে। গত বছরের শেষ দিকে চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। গরিবের মোটা চাল গিয়ে ঠেকে ৫০ টাকা কেজিতে। পরে শুল্ক কমিয়ে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়। সরকারিভাবেও চাল আনার পদক্ষেপ নেয়া হয়। এলসি করা চালও দেশে এসেছে। তবে কিছুতেই দাম কমছে না। খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বোরো ধান উঠলেই কমবে চালের দাম। কিন্তু বোরো ঘরে উঠলেও দামে মেলেনি সুফল। শুরুতে কিছুটা কমলেও চালের দাম আবার বেড়ে সেই আগের জায়গায়ই ঠেকেছে।
জানা গেছে, সদ্য শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) চাল আমদানির জন্য ৮৫ কোটি ৩৫ লাখ ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে। আগের ১১ মাসের চেয়ে এই ১১ মাসে এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ২১০ গুণ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে মাত্র ৪০ লাখ ৭০ হাজার ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। এই ১১ মাসে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ২৮ কোটি ৮০ লাখ ডলারের; বেড়েছে ৫ হাজার ৬৯১ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে নিষ্পত্তির পরিমাণ ছিল ৪৯ লাখ ৭০ হাজার ডলারের। এছাড়া এই ১১ মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য সবমিলিয়ে ৫ হাজার ৯৩৪ কোটি ৫৫ লাখ (৫৯.৩৪ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২১ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি। অর্থবছরের শেষ দিকে এসে প্রায় সব ধরনের পণ্য আমদানি বেড়েছে। কিন্তু আমদানির কোনো প্রভাব নেই দামে। এতো আমদানি সত্ত্বেও চালের দাম কমছে না, উল্টো বেড়েই চলেছে। দেশে মোটা চালের কেজিই এখন ৫০ টাকা। আর সরু চাল কিনতে গুনতে হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকার মতো। সর্বশেষ গতকাল বুধবার ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যে দেখা যায়, রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি সরু চাল বিক্রি হয়েছে ৫৮ থেকে ৬৫ টাকা। মাঝারি মানের চাল বিক্রি হয়েছে ৫০-৫৬ টাকায় এবং মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৪৬-৫০ টাকা কেজি দরে। কিন্তু রাজধানীর খুচরা বাজারে সব প্রকার চাল টিসিবির দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়েছে।
ঢাকা রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মো. সায়েম জানান, চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। চালের ব্যবসা চলে গেছে পুরোটাই মিলারদের হাতে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। তারা যে রেট ধরে দেয় আড়তদাররা সেই দরেই বিক্রি করে। তাদের সিন্ডিকেটের কাছে আমরা সাধারণ ব্যবসায়ীরা অসহায়। সরকারও তাদের সিন্ডিকেট ভাঙতে পারে না। তারা সরকারের চেয়েও শক্তিশালী। তা না হলে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না কেন। তিনি জানান, সরকার শুধু খুচরা বাজারে তদাকরি না করে যদি মিলারদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনতো, তাহলে অনেক উপকার হতো। সরকার তাদেরকে জিজ্ঞেস করবে যে তোমাদের হাতে কি পরিমান ধান-চাল আছে। এখন সরকারতো সেটা করে না। তারা কোটি কোটি টাকা ইনভেস্ট করে বাজারের সব ধান কিনে গুদামজাত করে এরপর বলে চালের দাম বেড়ে গেছে। সরকারকে দেখতে হবে মিলাররা ব্যাংক থেকে কত কোটি টাকা লোন নিয়ে কত টন ধান কিনেছে এবং সেই ধানগুলো এখন কোথায়। কিন্ত সেই হিসেব সরকারের কাছে নেই। আর বাজারে তো এখন মোটা চাল পাওয়াই যাচ্ছে না। উধাও হয়ে গেছে।
২০২১ সালের শুরু থেকেই চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারি গুদামে মজুত এবং বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারি গুদামে চালের মজুত ছিল মাত্র ৫ লাখ ২৫ হাজার টন। দেশের সরকারি চালের গুদামের মজুতক্ষমতা প্রায় ২৫ লাখ টন। সরকারি গুদামে ন্যূনতম ১২ থেকে ১৫ লাখ টনের মজুত থাকার নিয়ম রয়েছে। গত বছরও একই সময়ে ১৩ লাখ টনের বেশি চাল মজুত ছিল। সরকারি গুদামে চালের মজুত বাড়াতেই বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। একইসঙ্গে সরকার নিজেও সরাসরি আমদানি করতে থাকে। চাল আমদানি শুরু হলেও বাজারে দামের কোনো প্রভাব পড়েনি। সরকারি হিসাবেই বাজারে মোটা চালের কেজি এখন ৪৬ থেকে ৫০ টাকা। অথচ গত বছরের এই সময়ে মোটা চাল প্রতি কেজি ৩২ থেকে ৩৬ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রায় ১০ লাখ টন চাল আমদানির জন্য ৩০০ জন ব্যবসায়ীকে অনুমতি দিয়েছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ৬৪ হাজার টন চাল দেশে এসে পৌঁছে। আর সরকারিভাবে ৬ লাখ টন আমদানির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হলেও এসেছিল ৪৬ হাজার টন চাল। খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ১১ জুলাই সরকারি গুদামগুলোতে মোট ১৫ লাখ ৫০ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুত ছিল। এর মধ্যে চাল ১২ লাখ ৬৬ হাজার টন; আর গম হচ্ছে ১ লাখ ৮৪ হাজার টন।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মুনসুর জানান, বাজারে চালের সরবরাহ কমে গেছে তাই দাম বেড়েছে। সরকারের মজুদ কমে যাওয়াটাই এখন আমাদের ভোগাচ্ছে। আর চাল আমদানির সিদ্ধান্ত আরো আগেই নেয়া উচিত ছিলো। সরকার গড়িমশি করতে করতে চালের দাম বেড়ে গেছে।
এজন্য সরকারের অব্যবস্থাপনাই দায়ী। চালের বাজারে সিন্ডকেট কাজ করে। ইচ্ছা করে তারা সময় মতো চাল আমদানি করেনি। এরপর আমরা নভেম্বর মাসেও বলেছি, দ্রুত চাল আমদানি করা উচিত। কিন্তু সরকার সে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেছে। সরকার জানুয়ারি মাসে এসে চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। এতো দেরিতো করার কোনো দরকার ছিলো না। আমি বলবো, সরকারের পলিসিগত ভুলের কারণেই চালের দামের এই উচ্চ অবস্থা।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক কৃষি অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামান জানান, চালের দাম না কমায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন চাল ব্যবসায়ী এবং চালকল মালিকেরা। আবার তাদেরই চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছিল। তারা দ্রুত চাল আমদানি করলে দাম কমে যেতে পারে, সে কারণেই তারা আমদানিতে গড়িমসি করছিলেন। এখন আমদানি বাড়িয়ে দিয়েছে; তাই বাড়ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারপরও কি দাম কমবে? এই যে গড়িমসি করে কৌশলে বেশি দামে বিক্রি করল, তারই বা কী হবে? মহামারির এই সংকটকালে মানুষকে আর কতো দুর্ভোগ পোহাতে হবে?
বেনাপোল আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মহসিন মিলন সরকার আমাদের চাল আমদানির যে কোটা দিয়েছিল, সে কোটা পূরণ করতেই ব্যবসায়ীরা প্রচুর এলসি খুলেছিলেন। এরপরও দাম কমছে না কেন, জানতে চাইলে তিনি জানান, সরকারের মজুত কমে যাওয়ার তথ্য ব্যবসায়ীরা জানতে পেরে তারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছে। এখনও সে প্রবণতা অব্যাহত আছে।
খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলছেন, চাল আমদানির পরও দেশের বাজারে চালের দাম না কমার প্রথম কারণ হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে চালের উচ্চমূল্য। দ্বিতীয় কারণ হলো, চাহিদার তুলনায় যোগানের পার্থক্য রয়েছে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই গ্যাপের কারণে হয়তো হতে পারে। এছাড়া করোনার সময় অনেক প্রবাসী বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন। আপনারা জানেন, রোহিঙ্গাদের জন্যও খাবারের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। ফলে আমাদের চাহিদা বেড়ে গেছে। এছাড়া মৎস্য, ডেইরি ও পোল্ট্রি ফিডে চালের অংশ ব্যবহার বেড়েছে। আমি মনে করি চাহিদা ও যোগান এই দুইটাকে সঠিক হিসাব করা দরকার। তাহলে আমরা বুঝতে পারতাম কেন দাম কমছে না।