সময় সংবাদ লাইভ রিপোর্ট:দিন যত গড়াচ্ছে দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের তত বিস্তৃতি ঘটছে। সংক্রমণ ঠেকাতে পাড়া মহল্লা থেকে শুরু করে জেলার পর জেলা লকডাউন করা হয়েছে গত এক মাসে। সন্দেহভাজন ও সংক্রমিত ব্যক্তিদের প্রাতিষ্ঠানিক এবং হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হচ্ছে। আইসোলেশনও করা হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে ছুটির মেয়াদ বারবার বাড়ছে। এত কিছু করেও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না করোনার দাপট। স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার অভাব, অব্যবস্থাপনা, অবহেলা ও প্রশাসনের কর্মযজ্ঞে সমন্বয়হীনতা করোনার জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে দিচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে করোনার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধ ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য এবং আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, করোনা আক্রান্তদের ধারাবাহিক ঊর্ধ্বগামী রেখা ভয়াবহ বিপদের বার্তা দিচ্ছে। গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম ৩ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হন। ঠিক এর ৪৮তম দিনে গিয়ে পাওয়া গেল ৫০৩ জন আক্রান্ত। গত কিছুদিন ধরে নতুন শনাক্তের সংখ্যা ৩০০ থেকে ৫০০ এর মধ্যে ওঠানামা করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা আক্রান্তের প্রকৃত চিত্র এর চেয়েও ভয়াবহ। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল এপ্রিলে চূড়ান্ত আঘাত হানতে পারে এই অদৃশ্য শত্রু। সে ধারণা পাল্টে দিয়েছে গত কিছু দিনের চিত্র। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আগামী মে মাস দেশের জন্য খুবই ‘ক্রিটিক্যাল ও ক্রুশিয়াল’। এখনই বাস্তবতার নিরিখে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারলে আগামী মাসে শুরু থেকেই সংক্রমণ আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এ প্রেক্ষাপটে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে এখনই কঠোর অবস্থানে যেতে হবে প্রশাসনকে। শতভাগ লকডাউন নিশ্চিত করতে হবে। আর মহামারী ঠেকাতে ঘরে ঘরে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তারা বলছেন, আগামী দুই সপ্তাহ স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রশাসন গণসংক্রমণ ঠেকাতে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে এর ওপর নির্ভর করছে করোনা যুদ্ধের ভবিষ্যৎ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে নাকি নাগালের বাইরে চলে যাবে তার সমীকরণটা তখনই স্পষ্ট হবে।
করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত একাধিক চিকিৎসক আমাদের সময়কে বলেছেন, তাদের একার পক্ষে এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সাফল্য পাওয়া অসম্ভব। এ লড়াইয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। তারা বলছেন, গত বছর চীনের উহানে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর ধারণা করা হয়েছিল, পুরো চীনেই এটি ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু তা হয়নি। তারা কঠোর প্রচেষ্টায় উহানের মধ্যেই করোনা সীমাবদ্ধ রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু বাংলাদেশে করোনা ধীরে ধীরে সারাদেশে ছড়িয়েছে। ৯৯ ভাগ সংক্রমণই ঘটেছে করোনা রোধে সরকার ঘোষিত ছুটির মধ্যে। মানুষ সামাজিক দূরত্ব মানছে না। ফলে একজন থেকে রোগটি আরেকজনে ছড়িয়ে পড়ছে। রোগটি এখন লক্ষণ ছাড়াও মিলছে। লক্ষণহীন করোনা আক্রান্ত কতজন মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছেন তার কোনো হিসাব নেই স্বাস্থ্য বিভাগসহ প্রশাসনের কাছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী, করোনায় আক্রান্তের বেশিরভাগই ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী জেলায়। কিন্তু এই ৫ জেলায়ই সামাজিক দূরত্ব মানার চিত্র খুবই নাজুক। এ অবস্থার মধ্যেই জেলাগুলোয় খুলে দেওয়া হয়েছে গার্মেন্টস।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, লকডাউনের মূল উদ্দেশ্য হলো সংক্রমণ প্রতিরোধ। আমরা দেখেছি, লকডাউন থাকা সত্ত্বেও রোগী বাড়ছে। লকডাউন দিয়ে আমরা যে সংক্রমণ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছি, সোজাসুজি বলতে গেলে সেখানে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
এদিকে গার্মেন্ট শ্রমিকদের কাজে যোগদানের অনুমতি দেওয়া হলেও সেই পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে উন্নীত হলে কারখানা খোলার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে এ বিষয়ে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার একটি গাউডলাইন আছে। সে রকম পরিবেশ আমাদের এখনো হয়নি। উল্টো সংক্রমণের মাত্রা বাড়ছে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যের কিছু নির্দেশনা মেনে কারখানা খোলার পারমিশন দিয়েছি, সেই নির্দেশনা মানার ব্যাপারেও আমার সন্দেহ আছে। কারণ আমরা তো লকডাউনের নির্দেশনাই মানিনি এবং সরকারও সেটা নিশ্চিত করতে পারেনি। আর এখন মালিকপক্ষ কতটা নিশ্চিত করবে সেটাও দেখতে হবে। সেটা যদি করা না হয় এবং যথাযথ নজরদারি করা না হয় তবে শ্রমিকদের আমরা সংক্রমণ ঝুঁকিতে ফেলেছি। গার্মেন্টস যদি খুলতেই হয়, প্রতিটি কারখানায় জীবাণুনাশক ট্যানেল স্থাপন করতে হবে। যাতে করে এ ট্যানেলের মধ্য দিয়ে গেলে জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মোশতাক হোসেন বলেন, করোনায় আক্রান্তের তালিকার শীর্ষ ১০টি দেশের প্রেক্ষাপটে বোঝা মুশকিল বাংলাদেশে ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা কতখানি জনস্বাস্থ্যমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছি, বিধিনিষেধ কতটা মেনে চলছি, এর ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশ করোনা পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সর্বোচ্চ আক্রান্তের সময় পেরিয়েছে কিনা তা এখনই বলা যাবে না।
জনস্বাস্থ্যমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, মহামারী নিয়ন্ত্রণের জন্য এখন আমাদের ঘরে ঘরে গিয়ে টেস্ট করা দরকার। ঘরে ঘরে জ্বর দেখলে স্যাম্পল নিয়ে টেস্ট করে চিকিৎসা দেওয়া দরকার। ঘরে ঘরে টেস্ট আইইডিসিআরের নয়, এটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার কাজ। তবে এখন সবাই মিলে কাজ করতে হবে।
স্বাস্থ্য বিভাগের ঘাটতি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বিদ্যমান ল্যাবগুলোর ক্যাপাসিটি দ্বিগুণ করলে প্রতিদিন হয়তো সর্বোচ্চ ১০ হাজার টেস্ট করা যাবে। এরও দ্বিগুণ ক্যাপাসিটি বাড়ানো দরকার। এখন সন্দেহভাজন আক্রান্তের নমুনা সংগ্রহ ধীরগতিতে হচ্ছে। আমাদের জনবল, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট ও লজিস্টিকেরও অভাব আছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, খুলনা বিভাগে নতুন করে ঝিনাইদহ জেলায় রোগী পাওয়া গেছে। এ বিভাগে শুধু সাতক্ষীরা এখনো করোনামুক্ত। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগের খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি এবং রাজশাহী বিভাগের নাটোর জেলায় কারও মধ্যে এখনো করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েনি।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের ৭০তম দিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক আক্রান্ত হয় ৩৮ হাজার ৯৫৮ জন। ৬৮তম দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় দুই হাজার ৬৮৩ জন। স্পেনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয় ৪১তম দিনে ৮ হাজার ২৭১ জন। মৃত্যুও সংখ্যা সর্বোচ্চ হয় ৪৮তম দিনে ৯৬১ জন। ইতালিতে মাত্র ৩৬ দিনেই সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয় ৬ হাজার ৫৫৭ জন। ৪২তম দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় ৯১৯ জন। ফ্রান্সে সর্বোচ্চ আক্রান্ত পাওয়া যায় ৪৯তম দিনে। ৬১তম দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় এক হাজার ৪৩৮ জনের। জার্মানিতে ৪২তম দিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয় ৬ হাজার ৯৩৩ জন। ৫৪তম দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় ৩৩৩ জনের। যুক্তরাজ্যে ৫৬তম দিনে ছিল সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যু। এদিন আক্রান্ত ছিল ৮ হাজার ৬৮১ জন এবং মৃত্যু ছিল ৯৮০ জন। তুরস্কে ৫৭তম দিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ৫ হাজার ১৩৮ জন। সর্বোচ্চ মৃত্যু ছিল ৬৪তম দিনে ১২৭ জন। ইরানে ৪৫তম দিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ৩ হাজার ১৮৬ জন। সর্বোচ্চ মৃত্যু ছিল ৫০তম দিনে ১৫৮ জন। চীনে মাত্র ৩০তম দিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ১৪ হাজার ১০৮ জন। সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড হয় ৮৭তম দিনে এক হাজার ২৯০ জন।
আইইডিসিআরের তথ্য, দেশে করোনা প্রথম শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ ছাড়ায় ৩০তম দিনে। একদিন পরই তা দ্বিগুণ হয় ১১২ জন। ৩৫তম দিনে হয় ২০৯ জন। এর পর ১০০ যোগ হতে সময় লাগে মাত্র ৪ দিন। অর্থাৎ ৩৯তম দিনে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০৬ জনে। ৪১তম দিনে ৪৯২ জন।