সময় সংবাদ রিপোর্ট :দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ১৩ হাজার মেগাওয়াট। এর বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে ২৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। সক্ষমতার বিপরীতে বিদ্যুতের ব্যবহার হচ্ছে অর্ধেক। চাহিদা না থাকায় বসিয়ে রাখতে হচ্ছে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এগুলোর জন্য বিপুল অংকের অর্থ গুনতে হচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি)। এমন পরিস্থিতিতেও ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বাড়ানো হচ্ছে।
চাহিদা না থাকার পরও নতুন নতুন উৎস থেকে বিদ্যুৎ আমদানি খাতটিকে ভারসাম্যহীন করে তুলবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, বিদ্যুতের উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করা না গেলে বিদ্যুৎ খাতে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হবে। ভর্তুকি বাড়িয়েও এ অবস্থা সামাল দেয়া যাবে না। এভাবে চলতে থাকলে পিডিবি আর্থিক চাপ সামাল দেয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে।
দেশে বর্তমানে ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছে। সম্প্রতি আসামে নদী সম্মেলন চলাকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, দেশটি থেকে আমদানির পাইপলাইনে রয়েছে আরো অন্তত ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। নেপাল থেকে ৫০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ আমদানি চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য সমঝোতা স্মারকের বিষয়টি নিয়েও জোর আলোচনা চলছে। আগামী নভেম্বর নাগাদ নেপালের সঙ্গে জলবিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে চূড়ান্ত চুক্তি সই হওয়ার কথা রয়েছে।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে নেপাল ও ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে সর্বশেষ অগ্রগতি জানানো হয়। অগ্রগতির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে নেপালে সানুকশি-৩, খিমতি শিবালয়া নামে দুটি স্থান প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। এ বিদ্যুৎ প্রকল্পে বাংলাদেশ ও নেপাল যৌথভাবে বিনিয়োগ করবে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াতে বাংলাদেশ-নেপাল সঞ্চালন লাইন নির্মাণের বিষয়টিও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতের দক্ষতা উন্নয়নে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়টিও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বিবেচনায় আমদানির বিষয়টি নিয়ে সচেতনভাবে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিদ্যুৎ খাতের পর্যবেক্ষকরা। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, এমনিতেই দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার তুলনায় বেশি। বসিয়ে রাখতে হচ্ছে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রই। এ অবস্থায় নতুন করে জলবিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। চাহিদা না থাকলে অযথা বিদ্যুৎ আমদানি করা হলে পরিস্থিতি জটিল হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ৬ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট অর্থাৎ ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতা চালু হওয়ার কথা। সব মিলিয়ে আগামী বছরের মধ্যেই নতুন করে ১০ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনক্ষম হবে। এ সময়ের মধ্যে অবসরে যাবে মাত্র ২ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নবায়ন হওয়ারও জোর সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে এ বিদ্যুৎ কোথায় ব্যবহার হবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো খাত তৈরি হয়নি এখনো। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন ছাড়াই বসে থাকলে বিপুল অংকের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে বিদ্যুৎ বিভাগকে।
বিদ্যুৎ খাতে চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকায় এরই মধ্যে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিক্রিতে ঘাটতি তৈরি হয়েছে আড়াই টাকার মতো। এ অর্থ সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিয়ে সংস্থাটির ব্যয় সমন্বয় করতে হয়েছে। এ অবস্থায় রাজস্ব ক্ষতি কমাতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বিপিডিবি। বিদ্যুৎ খাতে গত অর্থবছরে (২০২০-২১) সংস্থাটি সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে সংস্থাটির বিদ্যুতের উৎপাদন পর্যায়ে ভর্তুকি দরকার ২৫ হাজার কোটি টাকা। যদিও এ চাহিদার বিপরীতে সরকারের পক্ষ থেকে ঠিক কী পরিমাণ ভর্তুকি দেয়া হবে তা এখনো নির্ধারণ হয়নি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরকারের দেয়া ঋণ ফেরত দিতে না পারায় সেটিকে ভর্তুকিতে রূপান্তরের কথা জানিয়ে অর্থ বিভাগের কাছে আবেদন জানিয়েছে বিপিডিবি।
নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা সংস্থা পাওয়ার সেল। সংস্থাটি বলছে, নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি শুধু বাংলাদেশের নয়, এটি প্রতিবেশী দেশ ভারত ও রফতানিকারক দেশগুলোর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া জ্বালানির বাজার বিবেচনায় এ বিদ্যুৎ আমদানি সাশ্রয়ী হবে।