সময় সংবাদ লাইভ রিপোর্টঃ শীর্ষ ১০ গ্রাহক খেলাপিতে পরিণত হলে পর্যাপ্ত মূলধন রাখতে ব্যর্থ হবে দেশের ৩৮টি ব্যাংক। দেশের শীর্ষ ১০ গ্রাহক ঋণ খেলাপি হলে অচল হয়ে পড়বে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর।শীর্ষ গ্রাহকদের নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে দেশের অধিকাংশ ব্যাংক। দেশের ৭ জন শীর্ষ গ্রাহক ঋণ খেলাপি হলে মূলধন ঘাটতিতে পড়বে ৩৫টি ব্যাংক। এ তথ্য খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের। একই তথ্য দিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কাজে অনিয়ম দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ব্যবসায়িক প্রভাবের কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রকাশিত ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশের ৭ জন শীর্ষ গ্রাহক ঋণ খেলাপি হলে মূলধন ঘাটতিতে পড়বে ৩৫টি ব্যাংক। আর শীর্ষ ১০ গ্রাহক খেলাপিতে পরিণত হলে পর্যাপ্ত মূলধন রাখতে ব্যর্থ হবে দেশের ৩৮টি ব্যাংক। কারণ শীর্ষ গ্রাহকরা খেলাপিতে পরিণত হলে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। এর ফলে যে পরিমাণ ক্ষতি হবে তার মাধ্যমে অচল হয়ে পড়বে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর।
দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআইবির গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে এক দশকের প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৯৫০০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, দেশের এখন সাতজন শীর্ষ গ্রহীতা ঋণ খেলাপি হলে ৩৫টি ব্যাংক এবং ১০ জন খেলাপি হলে ৩৭টি ব্যাংক মূলধন সংকটে পড়বে।
টিআইবি’র গবেষণা অনুযায়ী, হাতেগোনা কয়েকজনের কাছেই রয়েছে বড় অংকের ঋণের টাকা। একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন নামে কৌশলে বা যোগসাজশে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে। সংস্থাটির গবেষণায় পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক হিসাবে বর্ননা করে এজন্য সিণ্ডিকেট, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ব্যবসায়িক প্রভাব এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি কাজে অনিয়ম-দুর্নীতিকে অন্যতম কারণ হিসাবে তুলে ধরেছে। ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা, নৈরাজ্য, ঋণ জালিয়াতি এবং খেলাপি ঋণের উচ্চহার চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি গত ১০ বছরে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যাংকিং খাতের তদারকি নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। গবেষণায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণের উপায় নিয়েও ১০দফা সুপারিশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে দশমিক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ প্রভিশন, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ মানের ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। দেশের শীর্ষ ১০ গ্রাহক মন্দ মানের খেলাপিতে পরিণত হলে তাদের প্রভিশন বাবদ যে টাকা সংরক্ষণ করতে হবে তার মাধ্যমে বিশাল ক্ষতির মুখে পড়বে ব্যাংকিং খাত। মূলধন ঘাটতিতে পড়বে প্রায় ৩৮টি ব্যাংক।
ব্যাংকিংয়ের ভাষায় সামগ্রিক মূলধন পর্যাপ্ততার হারকে ক্যাপিটাল টু রিক্স ওয়েটেড অ্যাসেটস রেশিও (সিআরএআর) বলা হয়। আন্তর্জাতিক নীতিমালার আলোকে ব্যাংকগুলোকে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আলোকে ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ অথবা ৪০০ কোটি টাকার বেশি পরিমাণ মূলধন রাখতে হয়।
কোনো ব্যাংক এই পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে মূলধন ঘাটতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের জোগান দেয়া অর্থ ও মুনাফার একটি অংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। কোনো ব্যাংক মূলধন ঘাটতি রেখে তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের কাছে মোট খেলাপি ঋণের ৪৩ শতাংশ সীমাবদ্ধ। শীর্ষ ১০ ব্যাংকের হিসাবে এই সীমাবদ্ধতার পরিমাণ আরও বেশি, শতকরা হিসাবে যার পরিমাণ ৬৩ ভাগ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৪৯ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। হিসাব অনুযায়ী তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিন হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ছিল ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ।
সংস্থাটি বলেছে, যারা রাজনৈতিক বিবেচনায় একটা টোকেন অর্থ ফেরত দিয়ে ঋণ পুন:তফসিলীকরণ করার পর পুনরায় ঋণ খেলাপি হয়েছে তাদের নামও প্রকাশ করা হয়নি। সর্বশেষ গত বছরের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে খেলাপি ঋণের মাত্র দুই শতাংশ ফেরত দিয়ে ঋণ পুন:তফসিলীকরণের সুযোগ দেয়া হয়েছিল ১০ বছরের জন্য। এরপর খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানো হয়েছিল। এ ধরণের পদক্ষেপ ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম একটি কারণ বলে গবেষণায় বলা হয়েছে। নির্বাচনের সময় টোকেন অর্থ ফেরত দিয়ে প্রার্থী হিসাবে বৈধ হওয়ারও সুযোগ দেয়া হয়। সংস্থাটি বলেছে, একটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠী রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ব্যাংকিং খাতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এরপর এই শক্তি তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী নিয়মনীতি উপেক্ষা করে সিণ্ডিকেট তৈরি করে এবং মোটা অংকের ঋণ নিয়ে থাকে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সমর্থক ব্যবসায়ী অংশ প্রভাব খাটিয়ে আইন পরিবর্তন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে।
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড: ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, ব্যাংকিং খাত খাদের কিনারে চলে এসেছে। সরকারি হিসাব এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে হিসাবে দেখা যাচ্ছে তিন লক্ষ কোটি টাকার মতো ঋণ খেলাপি হয়েছে। এটি বিশাল অংক। ব্যাংকিং খাতে এখনই যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া না হলে এই বোঝা জনগণের ওপরই পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো: সিরাজুল ইসলাম বলেন, টিআইবির তথ্য পুরোপুরি ঠিক নয়। আমার কাছে পরিসংখ্যান যা বলছে, তাতে ঋণের ক্ল্যাসিফিকেশন কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক আইনের কাঠামোর মধ্যে থেকে এবং যে জনবল আছে, তা দিয়ে যে দায়িত্ব পালন করার কথা, সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথভাবে করছে।