আলমগীর পারভেজ : সরকারঘোষিত কঠোর লকডাউনের মধ্যে কারখানা খুলে দেয়ায় চাকরি রক্ষায় সীমাহীন ভোগান্তি সয়েই ঢাকামুখী শ্রমিকের কর্মস্থলে ফিরতে বড় বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হচ্ছে পোশাককর্মীদের। পথের দুর্ভোগ নিয়ে শনিবার ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরমুখী এসব পোশাককর্মীরা বলছেন, একে চাকরি হারানোর ভয়, অন্য দিকে পথে নেই কোন ধরনের যানবাহন। সরকার শ্রমিকদের নয় মালিকদের সুবিধাই দেখলেন।
জানা গেছে, হঠাৎ করে পোশাক কারখানা খোলার ঘোষনায় বিপাকে পড়ে শ্রমিকরা। ২০০ টাকার ভাড়া ২ হাজার টাকা দিয়ে ট্রাক কিংবা কভার্ডভ্যানে অনেকে আবার অটোতে করে ভেঙ্গে ভেঙ্গে ঢাকায় আসছেন। এর মধ্যে রয়েছে পুলিশের হয়রানি। শ্রমিকরা বলছেন, আসলে আমাদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। আমরা আসলেই অসহায়।
খুলনার বাগেরহাটে বাড়ি পারভেনি আক্তারের। তিনি ঢাকা মালিবাগে একটি গার্মেন্টেস চাকরি করেন। তার বাবা ঢাকায় একটি সিএনজির ড্রাইভার। মেয়ে ঈদে বাড়ি গেছে বলেন জানান তিনি। তিনি বলেন,বাগেরহাট থেকে ঢাকার আসতে ভাড়া লাগে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। কিন্তু লকডাউনের মধ্যে গার্মেন্টস খোলা। তাই চাকরি বাচাতে ঢাকায় আসতে হবে। ট্রাকে করেও ঢাকায় আসতে ভাড়া লাগে ২২০০ টাকা। তিনি জানান,মেয়ে এত টাকা কোথায় পাবে। কিভাবে সে ঢাকায় ফিরবে। এনি চিন্তিত বাবা। তাও আবার মেয়ে মানুষ।
তিনি জানান, একটি ট্রাকে যাত্রী উঠানো হয় ৮০/১০০ জন। সবাইকে দাড়িয়ে আসতে হয়। একজন মেয়ে মানুষ ৭/৮৭ ঘন্টা কিভাবে দাঁড়িয়ে আসবে আমার বুঝে আসে না। সরকার কার স্বার্থে লকডাউনের মধ্যে কারখানা খোললো আমার বুঝে আসে না। তারা আসবে কিভাবে। তাদের ভাড়ার টাকা কে দিবে। আসলে শ্রমিকের দুঃখ দেখার কেউ নেই।
বাংলাদেশে রপ্তানি আয়ের অধিকাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এই শিল্প মূলত ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর কেন্দ্রিক হলেও প্রায় অর্ধ কোটি শ্রমিক ছড়িয়ে আছে সারাদেশে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হওয়ায় ঈদের পর যে লকডাউন শুরু হয়েছে, তাতে সব শিল্প কারখানাও ৫ আগস্ট পর্যন্ত বন্ধ থাকবে বলে সরকারই জানিয়েছিল। ফলে যেসব শ্রমিক ঈদের ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলেন, তারা ধরেই নিয়েছিলেন লকডাউনে আর ফিরতে হচ্ছে না তাদের।
কিন্তু ব্যবসায়ীদের বারবার অনুরোধে শুক্রবার সরকার জানায়, রপ্তানিমুখী কারখানা আজ রোববার থেকে লকডাউনের আওতামুক্ত। অর্থাৎ রোববার থেকে গার্মেন্ট খোলা। এই সিদ্ধান্ত জানার পর গতকাল শনিবার সকাল থেকে বিভিন্ন জেলা থেকে পোশাককর্মীরা ঢাকায় রওনা হয়, যদিও গণপরিবহন বন্ধ থাকায় কোনো বাস নেই সড়কে। পদ্মা পারে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ফেরিঘাটে সকাল থেকেই ভিড় ছিল।
এবার কারখানা চালুর সিদ্ধান্তের পর শ্রমিকদের বিষয়ে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুখ হাসান বলেন, অধিকাংশ কারখানার শ্রমিক কারখানার আশপাশে অবস্থান করছেন। আপাতত তাদেরকে দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া হবে। এর মধ্যে যারা বাড়ি চলে গেছেন, এসব শ্রমিক যদি আসতে পারেন তাহলে চলে আসবেন।
গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তিন চাকার বিভিন্ন গাড়ি ও মোটর সাইকেলে করে অনেককে বাংলাবাজার ঘাটে আসতে দেখা যায়। সেখান থেকে ফেরিতে উঠছিলেন তারা। বিআইডব্লিউটিসির বাংলাবাজার ঘাটের ব্যবস্থাপক মো. সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রোববার থেকে গার্মেন্টস ও কলকারখানা খুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। ফলে হাজার হাজার যাত্রী। লকডাউনে লঞ্চ ও স্পিটবোট চলাচলও বন্ধ। ফলে যাত্রীরা গাদাগাদি করেই ফেরিতেই উঠছিলেন।
বরিশাল থেকে আসা আলমগীর হোসেন বলেন, রোববার গার্মেন্ট খুলবে। ফ্যাক্টরিতে যেতেই হবে। সস্তা শ্রমের বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে চাকরির নিশ্চয়তা নেই বললেই চলে।
হোসেন বলেন, অনেক কষ্ট করে এসেছি। সরকার যদি গণপরিবহন ও লঞ্চ খুলে দিত, তাহলে এত ভোগান্তি হত না। ইতি নামে এক গার্মেন্টস কর্মী বলেন, আমরা গরিব মানুষ। পেটের দায়ে যেতে হচ্ছে। একদিকে লকডাউন, আবার ফ্যাক্টরিও খোলা। আমরা কী করব? আমরা পড়েছি ভোগান্তিতে। এক টাকার ভাড়া ১০ টাকা দিতে হচ্ছে। সরকার আমাদের জন্য কিছু করছে না। কিছু না পেয়ে অনেকে কভার্ড ভ্যানেও উঠে পড়ছিলেন।কিছু না পেয়ে অনেকে কভার্ড ভ্যানেও উঠে পড়ছিলেন।
ফেরিতে পদ্মা পার হওয়ার পর আবার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ঢাকায় যেতে অনেককে কভার্ডভ্যান ও নসিমনে উঠতে দেখা যায়। ভাড়া বেশি চাইছে বলে অনেককে হেঁটেই রওনা হতে দেখা যায়।
বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানার ওসি মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, মানুষ মৃত্যুর ভয় না করে চাকরি বাচাঁতে ঢাকায় ছুটছে। গতকাল শনিবার সকাল থেকে হাটিকুমরুল, পাঁচলিয়া, কড্ডার মোড় থেকে নানা যানবাহনে গাদাগাদি করে ঢাকার দিকে ছুটতে দেখা যাচ্ছে মানুষকে।
ট্রাকে চেপে বসা পোশাককর্মী আহম্মেদ বলেন, কোরবানির ঈদ করতে বাড়ি এসেছিলাম। রোববার থেকে গার্মেন্টস খুলবে। তাই ঢাকায় যাচ্ছি। সালাহউদ্দিন নামে আরেক জন বলেন, ট্রাকে চান্দরা পর্যন্ত ভাড়া নিচ্ছে ৬০০ টাকা। সেখান থেকে প্রাইভেটকার বা মাইক্রোবাসে যেতে আরও ৪ শত টাকা ভাড়া দিতে হবে। খরচ বেশি হলেও ফিরতে তো হবে। নইলে চাকরি থাকবে না, বলেন তিনি। পোশাককর্মী জোসনা খাতুন ‘চাকরি রক্ষায়’ শিশু সন্তান নিয়ে পিকআপভ্যানে চড়েছেন। ভাড়াও বেশি, চরম ভোগান্তিও পোহাতে হচ্ছে। তবুও কী আর করা, বলেন তিনি।
বাস নেই বলে সিরাজগঞ্জ থেকে চেপেছেন পিকআপভ্যানে, যেতে হবে ঢাকা।বাস নেই বলে সিরাজগঞ্জ থেকে চেপেছেন পিকআপভ্যানে, যেতে হবে ঢাকা।
শ্রমিকদের ঢলে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কেও চাপ দেখা যায়। নগরীর বাইপাস ও পাটগুদাম ব্রিজে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ বাইপাস মোড় থেকে শম্ভুগঞ্জ মোড় পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট।
যানজটে আটকে থাকা ট্রাক-পিককাপগুলোতে গাদাগাদি করে উঠেছে মানুষ। কেউ কেউ অটোরিকশায় চড়েছেন, আবার যানবাহন না পেয়ে হেঁটেই কেউ কেউ রওনা হয়েছে ঢাকার পথে।
বেগম নামে এক নারী বলেন, ভোরে শেরপুরের নালিতাবাড়ি থেকে বের হয়ে ময়মনসিংহ আসতে দুপুর ১২টা বেজেছে। ভেঙে ভেঙে অটোরিকশায় আসতে তার ৭০০ টাকা খরচ হয়েছে।
এখন বাইপাস থেকে গাড়ি না পেয়ে অটোরিকশায় উঠছেন পারভীন। তিনি বলেন, এটায় ভালুকা যাব। ভাড়া দিতে হবে ২০০ টাকা। পরে ভালুকা থেকে অন্য কোনো উপায়ে গাজীপুর যাব।
হোসনে আরা নামে এক পোশাককর্মী পিকআপ ভ্যানে ৬০০ টাকায় ঢাকায় যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, এমন চাকরি করার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। গরিবের কোথাও শান্তি নেই। আমাদের নিয়ে সবাই রাজনীতি করে।
ঢাকায় ফেরা মানুষরা জানিয়েছেন, তাদের ফোন করে জানানো হয়েছে, ১ আগস্ট থেকে গার্মেন্টস খুলছে। তাই চাকরি বাঁচাতে পথে সীমাহীন ভোগান্তি পাড়ি দিয়ে চলে এসেছেন তারা। ভাড়াও গুনতে হয়েছে কয়েকগুণ বেশি। বাস চালু না করে হঠাৎ করেই শিল্প-কারখানা খুলে দেয়ার এ সিদ্ধান্তে তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
শনিবার সকাল থেকে সাইনবোর্ড এলাকায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় ফেরা মানুষের ভিড় লেগেই আছে। হাতে-মাথায়-কাঁধে ব্যাগ। তাদের মধ্যে অসংখ্য নারী ও শিশু।
সাইনবোর্ডে এসেও তারা পড়েছেন বিপদে। ভ্যানগাড়ি ছাড়া নেই কোনো গাড়ি। পুলিশের ভয়ে দূরে দূরে থেকে এলাকার মধ্য দিয়ে চলছে অটোরিকশা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে সাইনবোর্ড থেকে যাত্রাবাড়ীর দিকের সড়কে মানুষের সারি দেখা গেছে। তারা যানবাহনের অভাবে হেঁটেই যাচ্ছেন গন্তব্যে। বেশিরভাগই ভ্যানগাড়িতে গাদাগাদি করে যাচ্ছেন।
রাকিব ও সামসুন্নাহার এসেছেন চাঁদপুর থেকে। রাকিব বলেন, আমরা থাকি নারায়ণগঞ্জে। সেখানে গার্মেন্টসে কাজ করি। ভাইঙা ভাইঙা অনেক কষ্ট করে আসছি। তিনি বলেন, অফিস থেকে ফোন করছে, কাইল থেকে খোলা। তাই না আইসা উপায় নাই। এখন এহানতে (সাইনবোর্ড) ক্যামনে নারায়ণগঞ্জ যামু, হেই চিন্তা করতাছি ভাই।
গৌরীপুর থেকে এসেছেন সজীব হোসেন। তিনি টঙ্গীর একটি গার্মেন্টসে কাজ করেন। কোথা থেকে এসেছেন, কোথায় যাবেন জানতে চাইলেই সজিবের কণ্ঠে ক্ষোভ। তিনি বলেন, গাড়ি চলে না, হঠাৎ গার্মেন্টস খুলে দিল। এটা কেমন সিদ্ধান্ত। মানুষ ক্যামনে আসবে। কী কষ্ট করে আসছি, তা বুঝাইতে পারমু না।
মহাখালীতে ব্যবসা করেন শরিফুল। নোয়াখালী থেকে বউ-বাচ্চা নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘অটোরিকশা ও মাইক্রোবাস দিয়ে এ পর্যন্ত এসেছি, এই জনপ্রতি ভাড়া দিয়েছি এক হাজার ১০০ টাকা করে। অনেক কষ্ট হয়েছে।
সাভারের একটি গার্মেন্টসে কাজ করেন আরিফুল রহমান সোহেল। তিনি স্ত্রী ও ছোট বাচ্চা নিয়ে এসেছেন কুমিল্লা থেকে। সোহেল বলেন, পিকআপে ঝুঁকি নিয়ে আসছি। উপায় তো নেই। হঠাৎ করে গার্মেন্টস খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তটা একেবারেই ঠিক হয়নি। ফ্যাক্টরিতে আসতে শ্রমিকদের ভোগান্তির শেষ নেই।
সাইনবোর্ড চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করা যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) আয়ান মাহমুদ দীপ বলেন, আমি বিধিনিষেধের প্রথম দিন থেকেই এখানে ডিউটি করছি। এত মানুষের ভিড় আর দেখিনি। ঢাকাগামী মানুষের ঢল নেমেছে। এখানে কোনো গাড়ি নেই। এত মানুষ কীভাবে আটকাবো! এরা সবাই প্রায় খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষ। গার্মেন্টস খুলে দেয়া হয়েছে, এজন্যই এ ভিড় বলে মনে হচ্ছে।
পোশাক কারখানাসহ সব ধরনের শিল্পকারখানা খুলে দিতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানান মালিকরা। গত ২৯ জুলাই সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠক করে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা এ দাবি জানান।
এর পরই শুক্রবার (৩০ আগস্ট) রফতানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী ১ আগস্ট সকাল ৬টা থেকে রফতানিমুখী সব শিল্প ও কলকারখানা আরোপিত বিধিনিষেধের আওতাবহির্ভূত রাখা হলো।