Header Border

ঢাকা, সোমবার, ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল) ৩৯.৯৬°সে

পদ্মার বুকে শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই চরের বিস্তার

সময় সংবাদ লাইভ রিপোর্টঃ  পদ্মা নদীর বুকে শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই চরের বিস্তার ঘটে চলেছে। নদীর মূল স্রোতধারাও সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে পদ্মার অন্তত ২৫টি শাখা নদীর অস্তিত্বও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। গঙ্গার উজানে ব্যাপকহারে পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের পদ্মা নদীতে এই পরিস্থিতি হচ্ছে বলে জানা গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সূত্রমতে, ফারাক্কার পর থেকে দৌলতদিয়া পর্যন্ত পদ্মার দৈর্ঘ্য ১৮৫ কিলোমিটার। দৌলতদিয়া থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত পদ্মার দৈর্ঘ্য ৯৫ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে ২৮০ কিলোমিটার। পাউবো’র হিসেবে চার দশক আগেও আরিচার কাছে পদ্মা নদীর প্রশস্ততা ছিল ১৫ কিলোমিটার। তা সংকীর্ণ হয়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৫ কিলোমিটারেরও কমে। অন্যদিকে স্রোত না থাকায় লাখ লাখ টন বালি পড়ছে নদীর বুকে। সেগুলো পলি পড়ে জমিতে পরিণত হচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর থেকে গঙ্গা-পদ্মায় এযাবৎ পানির উচ্চতা কমেছে ১৮ মিটার পর্যন্ত। এদিকে পদ্মায় পানি না থাকায় পাগলা, বড়াল, গড়াই, মাথাভাঙ্গা প্রভৃতি নদ-নদী মৃত্যুর প্রহর গুনছে। এসঙ্গে বিলুপ্তির জন্য অপেক্ষা করছে পদ্মার স্রোতনির্ভর আরো অন্তত ২৫টি শাখা নদী ও খাল-বিল। এসব জলাধারের পাশে বাস করা মানুষেরও কষ্ট বেড়েছে। এদিকে জেগে উঠা চরগুলো দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার ফলে এসব চরে পলি পড়ে ফল-ফসল উৎপাদনের উপযোগী হয়ে উঠছে। এখন নদীতে মাছ চাষের বদলে ফসল উৎপাদন আর বাগান সৃজনের আয়োজন চলছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্মা মরে যাওয়ার জন্য কেবলই ফারাক্কা বাঁধের কথা বলা হয় এবং ফারাক্কা দিয়ে বাংলাদেশের তথাকথিত ‘ন্যায্য হিস্যা’ না পাওয়ার কথা বলা হয়। আর প্রতিপক্ষ কেবলই বলে ফারাক্কা পয়েন্টে পর্যাপ্ত পানি না আসায় বাংলাদেশকে পানি দেওয়া সম্ভব হয় না। দৃশ্যত বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী পানির একটি ভাগ পায় বাংলাদেশ। ফারাক্কায় পানি কম থাকলে বাংলাদেশও কম পায়। বর্ষায় পানির কোনো অভাব নেই, ভারতও তখন ফারাক্কা ব্যারাজের সব দরজা খুলে দেয়। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, শুধু ফারাক্কা বাঁধই নয়- উজানে গঙ্গার পানি বহুবিধ উপায়ে প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ভারত ফারাক্কা বাঁধ ছাড়াও ফারাক্কার কাছাকাছি যে প্রকল্পগুলো নির্মাণ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ভাগীরথী নদীর উপর জঙ্গিপুরের কাছে ৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ফিডার ক্যানেল। জঙ্গিপুর ব্যারাজ নামের এই প্রকল্পের লক্ষ্যই হলো ফারাক্কা পয়েন্টের ৪০ হাজার কিউসেক পানি হুগলী ও ভাগীরথী নদীতে সরিয়ে নেয়া। ভারত তার বহু সংখ্যক সেচ ও পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মূল গঙ্গা এবং এর উপনদীগুলোর ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে নদীতে পানি প্রবাহিত হতে পারছে মাত্র ১০ ভাগ। এছাড়াও নদীসদৃশ বেশ কয়েকটি ক্যানেল প্রকল্প দিয়েও সারা বছর পানি প্রত্যাহার করা হয়ে থাকে। ভারত নদীসদৃশ ৭টি ক্যানেল বা কৃত্রিম খাল প্রকল্পের মাধ্যমে হাজার হাজার কিউসেক পানি গঙ্গা থেকে সরিয়ে নিয়ে কয়েক লাখ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করছে। তারা অনেক আগে থেকেই গঙ্গায় বৃহদাকার তিনটি খাল (ক্যানেল) প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, ‘আপারগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘নিম্নগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘পূর্ব গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল ২য় পর্যায়’ এবং ‘সমান্তরাল নিম্ন গঙ্গা ক্যানেল’। এ ধরনের প্রকল্পের হাজার হাজার কিলোমিটার খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি সরিয়ে নিয়ে সেচ দেবার ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ‘আপার গঙ্গা ক্যানেল প্রকল্পের’ মাধ্যমে উত্তর প্রদেশের ২৫ লাখ একর জমিতে সেচ দেয়ার লক্ষ্যে ৬ হাজার কিলোমিটারের বেশী খাল কেটে পদ্মার পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’ নামের প্রকল্পে মূল ও শাখাসহ খননকৃত খালের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১,৬০০ কিলোমিটার। ‘নিম্নগঙ্গা সেচ প্রকল্পের’ জন্য ৬ হাজার কিলোমিটার খালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এভাবে এসব উৎসের শতকরা ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ফলে নদীতে মাত্র ১০ ভাগ পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারছে।

পদ্মায় যেখানে চাষ হওয়ার কথা ইলিশের, নানা সুস্বাদু মাছের। তার উল্টো পরিস্থিতি পদ্মার বাসিন্দাদের। সরেজমিনে দেখা যায়, রাজশাহীর বাঘায় মূল পদ্মা নদীতে এখন আর পর্যাপ্ত পানি জমে থাকে না। মাইলের পর মাইলজুড়ে ধূ ধূ চর আর বালি। এই এলাকার মানুষ ভুলে গেছে সুস্বাদু ইলিশ আর মিঠা পানির মাছের কথা। বাঁচার তাগিদে মানুষ নদীর চরে নানা ফসল আবাদের পাশাপাশি তৈরি করতে শুরু করেছে কুল ও আমবাগান। চরবাসীরা জানান, বন্যা অথবা পানির অভাবে কোনো কোনো বছর তারা ভালো ফসল ঘরে তুলতে পারেন না। ফলে নদী ও চর এলাকার কৃষকরা এখন প্রলুব্ধ হচ্ছেন আম এবং কুলচাষের দিকে। অনেকেই মাটির ঢিপি বানিয়ে সেখানে রোপণ করেন আমের চারা। এভাবেই তৈরি হতে থাকে আমের বাগান। অনুরূপভাবে তৈরি হয় কুল বাগান। গোদাগাড়ী উপজেলার ৩০ কিলোমিটারজুড়ে রয়েছে পদ্মা নদী। নাব্যতা কমে যাওয়ায় নদীর বুকে অসংখ্য চর জেগে উঠায় পদ্মা বিভক্ত হয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন জানান, বর্ষা মওসুমে পানি ভরে থাকলেও নদীর তীরে ভাঙন ও বন্যা দেখা দেয়। আর শুষ্ক মওসুমে নদীর বুকে ছোট-বড় মিলে অসংখ্য চর জেগে উঠে। নদীর নাব্যতা মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় নৌ চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। মানুষ হাঁটু পানির মধ্যে নদী পার হয়। চর জেগে উঠায় তিন ভাগে বিভক্ত নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মার এমন অবস্থার কারণে চর ও বরেন্দ্র এলাকায় বৈরি আবহাওয়া সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে শুষ্ক মওসুমে এ অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনিভাবে এর বিরূপ প্রভাব কৃষিতে পড়ায় মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাছের উৎপাদনও কমে গেছে ব্যাপকভাবে।
 
নদী দূষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এই নদীতে এখন পানিপ্রবাহ অত্যন্ত ক্ষীণ। পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের মতে, গঙ্গা কানপুরে পৌঁছার আগেই ৯০ শতাংশেরও বেশি পানি কৃষি জমিতে সেচের জন্য অপসারণ করে নেয়া হয়। ফলে যে সমস্যাটি হয় তা হচ্ছে আরো নিম্নাঞ্চলে দূষণ বা অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ অপসারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া নদীর উজানে পানিবিদ্যুত প্রকল্পের জন্য বাঁধ নির্মাণ করে এই স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করা হচ্ছে। বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগের প্রাণদায়িনী এই নদীর দু’পাড়ে ২৩টি বৃহদাকার শহর গড়ে উঠেছে। ৪৮টি মাঝারি শহরও রয়েছে। রয়েছে অসংখ্য গ্রাম-জনপদ। আড়াই হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ করে এবং পিলার দিয়ে সেতু নির্মাণের ফলে স্বাভাবিক প্রবাহও দিন দিন অবরূদ্ধ হয়ে পড়ছে। গঙ্গার নিম্নধারা কানপুর, বিজনৌর, নারোরা, রুকনপুর, কানজাউলি, হাকানিপুর, ভোসাওয়ালি, শেখপুর, কোচকপুর, লামুই, চাওকা প্রভৃতি স্থানে ছোট-বড় তিনশ’ বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে সেচকাজের জন্য। এর ফলে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে বদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এমতাবস্থায় পরিবেশকর্মীরা অনেকেই মনে করেন, পরিস্থিতির পরিবর্তনে গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার কোন বিকল্প নেই।

পদ্মার এই পরিস্থিতির নেপথ্যে ভারতের নির্বিচার পানি আগ্রাসন দায়ী বলে মনে করেন নদী বিশেষজ্ঞ হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি  তাঁর মতে, উৎস ও উজান থেকে ফারাক্কা পয়েন্টে যথেষ্ট পরিমাণ পানি এসে পৌঁছাতে না পারার কারণে স্বাভাবিক প্রবাহ যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ চুক্তি মোতাবেক পানি থেকে বঞ্চিত থাকছে। তিনি বলেন, বর্তমানকালের বয়ে যাওয়া বাংলাদেশ অংশের গঙ্গার এখন আর সে ক্ষমতা নেই যে পূর্বের মতো বিশাল পরিমাণ পানি ধারণ করবে। বিগত চল্লিশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের গঙ্গার তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে প্রায় ১৮ মিটার। উজানে ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে বাংলাদেশ অংশের গঙ্গার তলদেশে পলি ও বালি জমে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
উজানের দেশের এই দ্বিমুখি আচরণের ফলে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ প্রকৃতি সর্বোপরি অর্থনীতি আজ চরম হুমকির মুখে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, মানিকগঞ্জ এবং মুন্সীগঞ্জের অসংখ্য গ্রাম ও জনপদ হচ্ছে ক্ষতির শিকার।

আপনার মতামত লিখুন :

আরও পড়ুন

ঢাকায় আজ তাপমাত্রার সব রেকর্ড ভাঙার শঙ্কা
খুলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মানতে হবে নির্দেশনা
আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি
নতুন শিক্ষাক্রমে এসএসসি পরীক্ষা হবে ৫ ঘণ্টার
থাইল্যান্ড গেলেন প্রধানমন্ত্রী
তাপদাহে হিট অ্যালার্টের মেয়াদ আরও বাড়াল আবহাওয়া অফিস

আরও খবর