*সময় সংবাদ লাইভ রির্পোটঃ যানবাহনে অক্সিজেন সেবার অভাবসহ নানা জটিলতার কারণে অ্যাম্বুলেন্সই একমাত্র ভরসা। কিন্তু রোগীদের জরুরি এ সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে বেশী ভাড়া আদায়ের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। হাসপাতালের কর্মচারী ও প্রভাবশালীরা ‘সিন্ডিকেট’ করে বেশি ভাড়া আদায় করছে বলে জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই করোনাকালেও হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাম্বুলেন্স না নিয়ে অন্য কোথাও থেকে কম টাকায় ভাড়া করবেন, সে সুযোগও নেই। হাসপাতালকেন্দ্রিক ‘অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট’ রোগীকে বাইরের অ্যাম্বুলেন্সে তুলতেই দেবে না। তাদের এক কথা, অন্য অ্যাম্বুলেন্স নিতে হলে তাদের টাকা দিতে হবে।
সূত্র মতে, হাসপাতালকে কেন্দ্র করে অ্যাম্বুলেন্সের মতো একটি জরুরি পরিবহন সেবাকে ঘিরে এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলছে বছরের পর বছর ধরে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার ২০ শতাংশ কমিশন দিতে হয় হাসপাতালের কর্মচারী অথবা ওয়ার্ডবয়দের। এ ছাড়া অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা বেশি হয়ে যাওয়ায় ট্রিপ কমে গেছে। এ কারণে খরচ পোষাতে মালিকেরা রোগীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করেন। এ ক্ষেত্রে অ্যাম্বুলেন্সমালিক ও চালকদের ঐক্য রয়েছে। অথচ মানুষের জন্য অ্যাম্বুলেন্সসেবা সহজ করতে সরকার কর ছাড় দিয়ে রেখেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবি আর) শুল্ক তালিকা অনুযায়ী, দেড় হাজার সিসি (ইঞ্জিন ক্ষমতা) পর্যন্ত একটি পুরোনো বা রিকন্ডিশন্ড অ্যাম্বুলেন্স আমদানিতে মোট করভার ৩১ শতাংশ। একই ক্ষমতার একটি মাইক্রোবাস আমদানিতে কর দিতে হয় ১২৮ শতাংশের মতো। সরকার অবশ্য কর ছাড় দেওয়ার বাইরে আর কিছুই করেনি। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই।
ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি বলেন, অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়ার কোনো তালিকা নেই। নেই সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালাও। যে যেভাবে পারছে, রাস্তায় সমানে অ্যাম্বুলেন্স নামাচ্ছে। তিনি বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগী পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে হাসপাতালগুলোর কর্মচারীদের (ওয়ার্ডবয় ও আয়া) ওপর। এ জন্য তাদের ভাড়ার অন্তত ২০ শতাংশ কমিশন দিতে হয়। এই কমিশনবাণিজ্য না থাকলে ভাড়া অনেকটাই কমে যেত।
রাজধানীকেন্দ্রিক অ্যাম্বুলেন্সচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেসরকারি একেকটি অ্যাম্বুলেন্স ঢাকার ভেতর রোগী বহন করতে দেড় থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করে। ঢাকার হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে আশপাশের জেলায় যেতে হলে একজন রোগীকে চার হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা গুনতে হয়। একটু দূরের জেলার ক্ষেত্রে ভাড়া দিতে হয় দূরত্ব ভেদে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা।
সম্প্রতি ফেনী থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা এক করোনা রোগীকে আড়াই ঘণ্টার রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া গুনতে হয় সাড়ে সাত হাজার টাকা। রোগীর স্বজনরা বলেন, রোগী অসুস্থ। ঢাকায় আনতেই হবে। তাই ভাড়া নিয়ে দর-কষাকষি করার সুযোগ ছিল না। তিনি বলেন, অ্যাম্বুলেন্সচালকেরা সংঘবদ্ধ। রোগীদের জিম্মি করে তারা সব সময় বেশি ভাড়া আদায় করে থাকে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কিছু করার নেই।
ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোরও অ্যাম্বুলেন্স সেবা রয়েছে। তবে তা সংখ্যায় সীমিত। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৫টি, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের ৪টি এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ৪টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। সরকারি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে একজন রোগীকে ঢাকার ভেতরে আনা-নেওয়া করতে ভাড়া মাত্র ৩২০ টাকা। এর বাইরে কম ভাড়া নেয় বেসরকারি আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ৫২০ টাকা। সমস্যা হলো, সরকারি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সের সুবিধা সাধারণ মানুষ পায় না। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের কর্মচারীদের যোগসাজশে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স বসিয়ে রাখা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা বিশেষ বিশেষ রোগী পরিবহন করে। বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সচালকেরা রোগীর জরুরি কোনো পরিস্থিতি দেখলে জিম্মি করে বাড়তি ভাড়া আদায় করেন।
অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঢাকা মহানগরে অ্যাম্বুলেন্স মালিকের সংখ্যা ৬৩৪। তাদের মালিকানায় রয়েছে দেড় হাজারের বেশি অ্যাম্বুলেন্স। সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী, ব্যক্তিমালিকানায় অ্যাম্বুলেন্সের নিবন্ধন নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। শুধু চিকিৎসা সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের নামে অ্যাম্বুলেন্সের নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বাবুল দেওয়ান বলেন, অধিকাংশ অ্যাম্বুলেন্সের মালিক বেসরকারি হাসপাতালের নামে নিবন্ধন নিয়ে ব্যবসা করেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাইক্রোবাসকে অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তর করা হয়। মাইক্রোবাসের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সের পার্থক্য শুধু এটুকুই যে অ্যাম্বুলেন্স নামের মাইক্রোবাসে শুধু অক্সিজেন রাখা হয়। অনেক ক্ষেত্রে সেটাও থাকে না। অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির নেতারাও এটি স্বীকার করেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালের সামনেই অ্যাম্বুলেন্সের স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। বেসরকারি বড় হাসপাতালের সামনে একই চিত্র। এই স্ট্যান্ডগুলো মূলত নিয়ন্ত্রণ করেন সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের কিছু প্রভাবশালী কর্মচারী, ওয়ার্ডবয় ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। কিছু কিছু সরকারি হাসপাতালের প্রভাবশালী কর্মচারীরা নিজেরাই অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। অ্যাম্বুলেন্স মালিকদের আরেক সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সভাপতি বাদল মাতবর বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বর্তমান ও সাবেক মিলিয়ে কমপক্ষে ৩০ জন কর্মচারী নামে-বেনামে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রতিটি হাসপাতালেই অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ী কর্মচারী রয়েছেন। বিধিবিধান অনুযায়ী সরকারি হাসপাতালের কর্মচারীদের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায় জড়িত থাকার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বি আরটিএ) অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া নির্ধারণের কোনো উদ্যোগ নেবে কি না জানতে চাইলে সংস্থাটির পরিচালক লোকমান হোসেন মোল্লা বলেন, খুব শিগগির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ নেবে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, ভাড়া নির্ধারণ নিয়ে অতীতেও এ ধরনের কথা বলা হয়েছে। কাজ হয়নি। এ ক্ষেত্রে তাদের একটি পরামর্শ হলো, অ্যাম্বুলেন্সে অ্যাপভিত্তিক সেবা চালু করা যেতে পারে। অ্যাপেই কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া ঠিক করা থাকবে। তবে হাসপাতাল থেকে রোগী নিতে কাউকে যাতে বাধা না দেওয়া হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের উদ্যোগ দরকার।
করোনাকালে রোগী পরিবহন বেড়েছে। এর মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়ার নৈরাজ্যও লাগামহীন। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মনে করেন, অবিলম্বে অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়ার তালিকা তৈরি করে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা উচিত। এতে সাধারণ রোগীরা উপকৃত হবেন। তিনি বলেন, রোগীদের জিম্মিদশা থেকে মুক্তি দিতে হলে সরকারি হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যাও বাড়ানো দরকার।
জানা গেছে, চিকিৎসা সেবা নিতে এসে দালালদের খপ্পরে পড়ে রোগীর পরিবার সর্বশান্ত হয় । এরপর রোগীর মৃত্যু হলে লাশ বাড়ি পর্যন্ত নিতে গিয়ে পোহাতে হয় নানা ঝক্কি-ঝামেলা। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছয় মাস ধরে দায়িত্ব পালনকারী আনসার সদস্য নিজের নাম পত্রিকায় লিখতে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, হাসপাতালে প্রতিটি ওয়ার্ডে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ীদের লোকজন দর্শনার্থী সেজে ঘোরাফেরা করে। তারা যখন বুঝতে পারে যে ওই রোগী মারা যেতে পারে, তখন ওই রোগীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খুব ভাল আচরণ শুরু করে। পরবর্তীতে রোগী মারা গেলে লাশ পরিবহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্সের সন্ধান দেন। একে তো স্বজনের মৃত্যু, তার ওপর লাশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাশ বাড়ি নেওয়া যায় ততই মঙ্গল- এ ধরনের চিন্তা থেকে চালকদের দাবিকৃত গলাকাটা ভাড়ায় লাশ নিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করে স্বজনরা। হাসপাতালের সামনে অবস্থান করা অ্যাম্বুলেন্সগুলোর সঙ্গে দরদাম করে কোনো লাভ হয় না।