সময় সংবাদ রিপোর্টঃ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু সংক্রমণ। জ্বরের উপসর্গ থাকলে করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু টেস্টের প্রয়োজন থাকলেও অনেকেই তা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। দেরিতে পরীক্ষার কারণে বেশিরভাগ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর প্লাটিলেটের মাত্রা কমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে করোনা ও ডেঙ্গু পরীক্ষা না হলে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে বলে হুঁশিয়ার করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বরের উপসর্গ থাকলেই করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু টেস্ট করাও জরুরি। এখন অনেকেই জ্বর হলে শুধু করোনা পরীক্ষা করান। ডেঙ্গু পরীক্ষা না করে বাসায় বসে থাকেন। মহামারী যদি একত্রে চলমান থাকে, তাহলে মানুষের জীবনের জন্য একটি প্রবল হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম থেকে দেওয়া তথ্যমতে, কয়েক দিন ধরেই ডেঙ্গু সংক্রমণের সংখ্যা শতাধিক হচ্ছে। গতকাল একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ২৩৭ জন। এছাড়া শুধু জুলাই মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ২,২৮৬ জন, যা ২০২০ সালে বছরজুড়ে আক্রান্ত সংখ্যার চেয়েও বেশি।
আগের বছরগুলোতে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা গেছে জুন-জুলাই মাসে। গত বছর ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল হাজারের ওপরে। এর আগের বছরে সব বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৯ সালে সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। আর সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১৭৯। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ছিল আরও বেশি।
জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজনন মৌসুম ধরা হয়। কারণ এ সময় বৃষ্টিপাতের কারণে পানি জমে। সে পানিতেই এডিস মশার প্রজনন ডেঙ্গু উপসর্গ থাকলেও টেস্ট হচ্ছে করোনার। তবে এবার বছরের এ সময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা।
কীট বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এডিসের ঘনত্ব আগের বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এবার জুন মাসে বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় এডিস মশার ঘনত্ব ধরা পড়ে। এ সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল ঢাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডে জরিপ চালায়। জরিপে দেখা যায়, গত বছরের চেয়ে এডিস মশার ঘনত্ব প্রায় ২০ গুণ বেশি। তারা জানিয়েছিলেন, ঢাকার এমন কোনো এলাকা নেই, যেটি ডেঙ্গুর উচ্চঝুঁকিতে নেই। তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, জুন মাসে ঢাকার বিভিন্ন ওয়ার্ড ও দেশের বিভিন্ন স্থানে এডিস মশা নিয়ে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, সারা দেশ ও রাজধানীর প্রতিটি ওয়ার্ডে এডিস মশার ঘনত্ব গত বছরের তুলনায় বেশি ছিল। নিয়মিত এ গবেষণার তথ্য ও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দেখে মনে হচ্ছে, সামনে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জরুরি পদক্ষেপ না নিলে এটি বাড়তে থাকবে। এজন্য মশা নিয়ন্ত্রণে ক্রাশ প্রোগ্রাম চালানো গেলে পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাবে। এ বছর বৃষ্টিপাত বেশি হয়েছে এবং করোনাভাইরাসের কারণে ডেঙ্গুর প্রতি হয়তো সবাই একটু উদাসীন ছিল। যার ফলে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু জ্বর এবং করোনা দুটিই ভাইরাসজনিত রোগ। তবে দুটোর মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। দুটির ক্ষেত্রেই জ্বর, গলাব্যথা, সর্দি-কাশি ও স্বাদ না থাকা হতে পারে। করোনার ক্ষেত্রে এসব লক্ষণের সঙ্গে নাকে ঘ্রাণ পায় না। আর ডেঙ্গুর লক্ষণ হলো, তীব্র জ্বর হয়, প্লাটিলেট কমতে থাকে, শরীরে র্যাশও দেখা যায়। কোনো কোনো ডেঙ্গু রোগীর আক্রান্ত হওয়ার চার দিন পর প্লাটিলেট কমে গিয়ে নাক, দাঁত, পায়খানা ও বমির মাধ্যমে রক্তক্ষরণ হতে পারে। ফলে রোগীরা সাধারণ জ্বর মনে করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ করছেন এবং যথাযথ চিকিৎসা নিতে বিলম্ব করছেন। ফলে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনেক রোগীর অবস্থার হঠাৎ অবনতি হচ্ছে।
অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, এখন থেকে করোনা টেস্টের সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু টেস্টও করাতে হবে। এক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সঙ্গে রোগীদেরও সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগ। অথচ যারা মশা নিধনের সঙ্গে জড়িত, ডেঙ্গুর প্রভাব শুরু হলে তাদের তোড়জোড় দেখা যায়। কর্তৃপক্ষের উচিত মশা প্রজননের এবং বংশবৃদ্ধি রোধে সারা বছর কাজ করা। একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর হাত থেকে মুক্তি সম্ভব।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, করোনা আর ডেঙ্গুর লক্ষণ একই। সাধারণ মানুষের জন্য বুঝা সম্ভব না। এখন যেহেতু করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী, চারপাশে অনেক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, তাই কারও জ্বর এলেই ধরে নেওয়া হয় যে তার কভিড হয়েছে। এতে করে আক্রান্ত রোগী ক্রমেই জটিলতায় চলে যায়।
তিনি বলেন, এমনও দেখা যায় একই ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হয়েছেন আবার ডেঙ্গু আক্রান্তও হয়েছেন। দেখা যায় করোনার চিকিৎসা হলেও ডেঙ্গুর চিকিৎসা হয় না। তাছাড়া ডেঙ্গু রোগের পরীক্ষার ফল আসতেও কিছুটা সময় লেগে যায়। যার কারণে ডেঙ্গু রোগীদের জটিলতা বেশি হচ্ছে এবং তাদের তখন হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। তাই এখন থেকে ডেঙ্গু ও করোনার টেস্ট এক সঙ্গে করতে হবে। কভিড আর ডেঙ্গু দুই ক্ষেত্রেই জ্বরের উপসর্গটি সাধারণ হওয়ার কারণে এই সমস্যাটি হচ্ছে।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, কভিডের কারণে হাসপাতালে শয্যা পাওয়া যাচ্ছে না, কারণ কোনো শয্যা খালি থাকছে না। ফলে কী দাঁড়াচ্ছে, আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসা থেকে অনেকটাই অবহেলিত ও বঞ্চিত। তাই আমাদের করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু মোকাবিলায় ক্রাশ প্রোগ্রাম নিতে হবে। তাহলে দুটো বিষয়কে একইভাবে মোকাবিলা করতে পারব।