Header Border

ঢাকা, সোমবার, ৭ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৩শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ (বর্ষাকাল) ২৫.৩৭°সে

করোনা ভাইরাসের প্রভাবে দেশের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তিই ক্ষতিগ্রস্ত

আলমগীর পারভেজ: করোনায় বাংলাদেশের জিডিপিতে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও পোশাক রপ্তানি খাতের অবদান সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত এ দু’টি বড় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বিকশিত হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে অর্থনীতির এ দু’টি ভিত্তি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করেন বিশষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ দু’টি খাতের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে।
জানা গেছে, গত অর্থবছরে যে হারে রেমিট্যান্স বাড়তে থাকে, চলতি অর্থবছরের শুরুতেই তা হোচট খায়। চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের শুরুর মাস জুলাইতে রেমিট্যান্স আসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ কম। গত জুলাইয়ে রেমিট্যান্স আসে ১৮৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার। গত জুলাইয়ের ধারাবাহিকতায় গত মাসে অর্থাৎ আগস্টে রেমিট্যান্স কম এসেছে প্রায় ৮ শতাংশ। গত মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৮১ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৯৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুলাই ও আগস্ট এই দুই মাসে প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন ৩৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার। অথচ আগের বছরের একই সময়ে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ৪৫৬ কোটি ২০ লাখ ডলার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী করোনায় মধ্যপ্রাচ্যসহ সবদেশেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে গেছে। এ সময়ে যে হারে বিদেশ থেকে শ্রমিক ফিরে এসেছে ওই হারে যায়নি। আবার যারা বিদেশে আছেন তাদের অনেকেরই কাজ নেই। কোনো মতে, দিন পার করছেন তারা। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহে। বাংলাদেশে রেমিটেন্স এর সিংহভাগই আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে করোনার কারণে এখন বড় ধরনের মন্দা চলছে। শ্রমিক ছাঁটাই ও উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয়া এখন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকাররা জানান, বিদায়ী অর্থবছরে পর্যাপ্ত রেমিট্যান্স আসে। প্রতি বছরই রেমিট্যান্স প্রবাহে নতুন রেকর্ড হয়। এরই সুবাদে গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয় আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ শতাংশ। এক বছরে দেশে রেমিট্যান্স আসে প্রায় দুই হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার। কিন্তু আমদানি চাহিদা কমে যাওয়ায় বাজারে উদ্বৃত্ত ডলার ছিল। বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে গত অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ৭৯২ কোটি ২০ লাখ ডলার কিনে নেয়। স্থানীয় মুদ্রায় যার মূল্য প্রায় সাড়ে ৬৭ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৪.৮০ টাকা হিসাবে)।
করোনাকালে বিশ্বের সার্বিক অর্থনীতি পরিস্থিতি নিয়ে ২০২০ সালের ১৫ই মে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল- করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স খাতেই সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশের অর্থনীতির এ দু’টি বড় ভিত্তিই এখন দেশটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতেও মন্দার কারণে শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতির পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা রয়েছে। এসব কারণে রেমিটেন্সে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তা নিয়ে সতর্ক করছিলেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা পড়েছে। আগের সেই জোয়ার আর নেই। আর এটাই স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে, অনন্তকাল ধরে প্রবাসীরা বেশি অর্থ দেশে পাঠাবেন, এটার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, কোভিডের কারণে সব কিছু বন্ধ থাকায় এতোদিন হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসেনি। সেটাই ব্যাংকিং চ্যানেলে এসেছে। সে কারণে প্রবাহ বেড়েছিল। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় প্রবাসীদের খরচ বেড়েছে। তিনি জানান, প্রবাসী আয় বৃদ্ধির বৈশ্বিক কোনো কারণ নেই। বেড়েছে দেশীয় কারণে। সেটা হলো অবৈধ চ্যানেল (হুন্ডি) বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে সরকার ২ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। এ কারণে যারা আয় পাঠাচ্ছেন, সবই বৈধ পথে আসছে। প্রকৃতপক্ষে করোনায় আয় আসা কিন্তু কমেছে। কারণ, প্রবাসীদের আয় কমে গেছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুইমাস রেমিট্যান্স কম আসায় তাদের অনুমানই যেন ঠিক হতে চলেছে। এ বিষয়ে গত আগস্টে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেছিলেন, এতদিন রেমিট্যান্সের যে জাদু ছিল সেটা সম্ভবত শেষ হতে চলেছে। দেবপ্রিয় বলেন, বাংলাদেশে শুধু আয়, কর্মসংস্থান ও মজুরি কমছে না, খাদ্যপণ্যের দামও বাড়ছে। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় বিশেষ করে মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুন মাসের প্রভাব নিয়ে ২০২১-২০২২ অর্থবছর শুরু করেছি। অনেকটা দুর্বল অর্থনীতির মধ্যে চলতি বছর শুরু করেছি। আর এর সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে পিছিয়ে পড়া মানুষের ওপর। নতুন খবর হচ্ছে জুলাই মাসের হিসাবে রফতানি কমেছে ১১ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গা ছিল বৈদেশিক খাত। জুলাই মাসের তথ্য বলছে বৈদেশিক খাতেও এক ধরনের ভাঙন দেখা দিয়েছে। জুলাই মাসে ২৮ শতাংশ রেমিট্যান্স কমেছে বা পতন ঘটেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞরা সবাই একমত হবে রেমিট্যান্সের যে জাদু সেটা সম্ভবত শেষ হতে চলেছে। কারণ, মানুষ বিদেশে গিয়েছে কম, এসেছে বেশি। সরকারি প্রণোদনার কারণে হুন্ডি থেকে মানুষ ব্যাংকিং খাতে টাকা পাঠিয়েছে। এ অবস্থায় জাদু শেষ হয়ে যাচ্ছে কিনা সেটাই বোঝার বিষয় রয়ে গেছে। রফতানি আবার আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। কর আদায়সহ সব সূচক যদি বিবেচনায় নেওয়া হয় তাহলে দেখবেন প্রাথমিক সংকেত ভালো না।
তবে এর জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহের নিম্নগতি নিয়ে উদ্বেগ দেখা গেলেও এই প্রবাহ কখনো শেষ হবে না। তিনি বলেন, ২০১৯ সালে যখন আমরা রেমিট্যান্সের বিষয়ে প্রণোদনা দেওয়া শুরু করি তখন থেকেই একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তখন তারা বলেছে, প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স বাড়ানো যাবে না। এখন বলছে ‘রেমিট্যান্স জাদু’ শেষ হতে যাচ্ছে। কিন্তু রেমিট্যান্স তো জাদু নয়। সুতরাং রেমিট্যান্স কখনো শেষও হবে না। রেমিট্যান্স যে জায়গায় ছিল, সেই জায়গাতেই থাকবে। আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ২০১৯ সালে আমাদের প্রণোদনা ঘোষণার আগের বছরে রেমিট্যান্স ছিল ১৩ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার পর প্রথম বছরেই আমরা রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেছি ১৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। এক বছরে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৫ বিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় বছরে রেমিট্যান্স বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। এটি অবিশ্বাস্য। রেমিট্যান্স ২৫ বিলিয়ন ডলার আসার পর আবার তারা বলছে অনেক বেশি এসে গেছে। তারা চায় কম রেমিট্যান্স আসুক।
এদিকে গত জুলাই মাসে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি নেতিবাচক খবর আসে। বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশকে টপকে একক দেশ হিসেবে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে চলে যায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ভিয়েতনাম। আর দীর্ঘদিন দ্বিতীয়স্থানে থাকা বাংলাদেশ নেমে যায় তৃতীয়স্থানে। জুলাইয়ের ৩০ তারিখ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস রিভিউ ২০২১ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২০ সালে ভিয়েতনাম ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। যেখানে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পোশাক। আগের বছর বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। আর ভিয়েতনামের রপ্তানি ছিল ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার।
রপ্তানির পাশাপাশি বৈশ্বিক বাজারে রপ্তানিতে অবদানও কমেছে বাংলাদেশের। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে বিশ্বে যত পোশাক রপ্তানি হয়েছিল তার মধ্যে ৬.৮ শতাংশ ছিল বাংলাদেশী। অন্যদিকে ২০১৯ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনামের অবদান ছিল ৬.২ শতাংশ। যাই হোক ৬.৮ শতাংশ থেকে কমে বাংলাদেশের অবদান ২০২০ সালে হয়েছে ৬.৩ শতাংশ। অন্যদিকে ভিয়েতনামের বেড়ে হয়েছে ৬.৪ শতাংশ। ২০০০ সালে বৈশ্বিক রপ্তানি আয়ের ২.৬ শতাংশ অবদান ছিল বাংলাদেশের, যেখানে ভিয়েতনামের ছিল ০.৯ শতাংশ। ২০১০ সালে বাংলাদেশের ছিল ৪.২ শতাংশ। আর ভিয়েতনামের ছিল ২.৯ শতাংশ। এর মানে ১০ বছরের ব্যবধানে অনেকটাই পিছিয়ে থাকা ভিয়েতনামই টপকে গেছে বাংলাদেশকে! ইপিবির তথ্য বলছে, অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ৫৬৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ২৭ শতাংশ কম।
আগস্টে রপ্তানি আয়ে উন্নতি করলেও সামগ্রিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) রপ্তানি আয় কিছুটা কমেছে। এই দুই মাসে ৬৮৬ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দশমিক ৩১ শতাংশ কম। গত বছরের এই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ৬৮৮ কোটি ডলারের পণ্য। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জন্য ৪ হাজার ৩৫০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য

আপনার মতামত লিখুন :

আরও পড়ুন

মতিঝিল থেকে ২৮ হাজার ইয়াবাসহ শীর্ষ মাদক কারবারি গ্রেফতার
সরকার পতনের ছক আকছে আওয়ামী লীগ !
সব বিভাগে টানা ৫ দিন বৃষ্টির আভাস
৪৪তম বিসিএসে ৪৩০টি পদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলেও এতে সায় দেয়নি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়
ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রে ইসরায়েলের ৩০ হাজার ৮০৯ ভবনের ক্ষতি
সাবেক ৩ সিইসির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ

আরও খবর